ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রুশ বিপ্লবের শতবর্ষ উদ্্যাপন ॥ ডিমাইনিং এ্যান্ড রেসকিউ অপারেশনের প্রিমিয়ার

প্রামাণ্যচিত্রে রাশিয়ার যুদ্ধোত্তর সহায়তার ইতিহাস

প্রকাশিত: ০৬:২৬, ১০ মে ২০১৮

প্রামাণ্যচিত্রে রাশিয়ার যুদ্ধোত্তর সহায়তার ইতিহাস

স্টাফ রিপোর্টার ॥ একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় চট্টগ্রাম বন্দর ও কর্ণফুলী জলসীমায় পাকিস্তানী জান্তা অসংখ্য মাইন পুঁতে রেখেছিল। যুদ্ধের সময় অনেক নৌযান ডুবে যাওয়ায় দেশের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত এ বন্দরটি ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। মুক্তিযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়ন যেমন বাংলাদেশকে নানাভাবে সহযোগিতা করেছিল তেমনি একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত অবকাঠামোগত উন্নয়নেও যথাসাধ্য সহযোগিতা করেছে। আর তাই স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে সোভিয়েত ইউনিয়ন কয়েকটি শিল্পকারখানা তৈরি করে দেয়। যা এখনও বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অবদান রেখে চলেছে। মুক্তিযুদ্ধের পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুরোধে রুশ নৌ-সেনারা ১৯৭২-৭৪ সালে বঙ্গোপসাগরে ‘ডিমাইনিং এ্যান্ড রেসকিউ অপারেশন’পরিচালনা করে সাগর ও সমুদ্রবন্দরকে ব্যবহারের উপযোগী করে তোলে। দুর্গম সমুদ্রে বিপজ্জনক সেই অপারেশনের ওপর মুক্তিযুদ্ধ একাডেমি নির্মাণ করেছে প্রামাণ্যচিত্র ‘Demining And Rescue Operation at Bay of Bengel 1972-1974’। এই প্রামাণ্যচিত্রে তুলে ধরা হয় বাংলাদেশকে সহযোগিতার গোটা ইতিহাস। বুধবার জাতীয় প্রেসক্লাবে রুশ বিপ্লবের শতবর্ষ উদযাপন উপলক্ষে প্রামাণ্যচিত্রটি প্রিমিয়ার শো ও সচিত্র এ্যালবামের প্রকাশনা উৎসবের আয়োজন করা হয়। উল্লেখ্য, ৯ মে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সোভিয়েত রাশিয়ার জনগণের মহান বিজয়ের ৭৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। মুক্তিযুদ্ধ একাডেমি ট্রাস্ট অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রামাণ্যচিত্র ও আলোকচিত্রের এ্যালবামটি উদ্বোধন করেন গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন। রুশ বিপ্লবের শতবর্ষ উদযাপন উপলক্ষে মুক্তিযুদ্ধ একাডেমি ঢাকাস্থ রুশ ফেডারেশন দূতাবাস এবং রুশ বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি কেন্দ্রের সহযোগিতায় মাসব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচী উদযাপন করে। অনুষ্ঠানে বক্তারা, মুক্তিযুদ্ধ ও এর পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন পর্যায়ের সহযোগিতা ও অবদানের কথা তুলে ধরেন। দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আরও জোরদারের করতে আহ্বান জানান বক্তারা। সেইসঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নকে সব সময় পাশে চায় বাংলাদেশ। এমন চাওয়া পাওয়ার কথাও ওঠে আসে বক্তাদের আলোচনায়। বক্তারা বলেন, ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি বাংলাদেশ ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কের যাত্রা শুরু হয়। ’৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু সোভিয়েত সরকারের কাছে সহযোগিতা চেয়ে বার্তা পাঠান। তখন বিশ্বে স্যাটেলাইট ছিল দুদেশ আমেরিকা ও রাশিয়ার। রাশিয়া তখন স্যাটেলাইট রিপোর্টে জানায়, বঙ্গোপসাগরে অজ¯্র মাইন পুঁতে রাখা হয়েছে। এরপর ১৯৭২ সালের মার্চে বঙ্গবন্ধু মস্কো সফর করেন। এই সফরের প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধু চট্টগ্রাম বন্দরের প্রবেশদ্বার কর্ণফুলী নদীর মোহনায় মাইন অপসারণ ও ডুবে যাওয়া জাহাজ অপসারণে সোভিয়েত ইউনিয়নের সহযোগিতা কামনা করেন। সোভিয়েত সরকার বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে ১৯৭২ সালের ২২ মার্চ বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে একটি চুক্তি করেন। যাতে নিঃশর্তভাবে বাংলাদেশকে সহযোগিতার কথা উল্লেখ করা হয়। একই বছরের ২ এপ্রিল প্রথম সোভিয়েত জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে প্রবেশ করে। তখন বন্দরের অবস্থা শোচনীয় ছিল। নদীর তলদেশে ৪০টির বেশি জাহাজ ডুবেছিল। ১৮ জেটির মধ্যে বারোটি ছিল ধ্বংসপ্রাপ্ত। ৩৭ যুদ্ধজাহাজ সোভিয়েত বাহিনীর সদস্যরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে অপসারণ করেন। ১৯৭২ সালের ২ এপ্রিল থেকে ১৯৭৪ সালের ২৪ জুন পর্যন্ত চলে সোভিয়েত নৌ-বাহিনীর এই অভিযান। অভিযান শেষে চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে বহির্বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের যোগাযোগ স্থাপিত হয়। পাশাপাশি দেশের অর্থনীতি দ্রুত নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সুযোগ পায়। খাদ্যশস্য আমদানি করা সম্ভব হয়। ত্রাণসামগ্রী আসতে থাকে। যা যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশের জন্য ছিল খুবই অপরিহার্য। তারা একে একে ৪০টির বেশি ডুবন্ত জাহাজ উদ্ধার করে। ১০০ হাজার টন পলি, এক হাজার ৯০০ টন স্ক্র্যাপ অপসারণ করে। বন্দরের এক হাজার দুই বর্গমাইল জলসীমায় মাইন মুক্ত করা হয়। ঝুঁকিপূর্ণ এই কাজ করতে গিয়ে ১৯৭৩ সালের ১৩ জুলাই ভিক্টোরোভিচ রেডকিন নামে এক সোভিয়েত নাবিক মারা যান। তাকে পতেঙ্গায় নেভাল একাডেমির ভেতরে সমাহিত করা হয়। তবে এই অভিযানে কত নাবিক মারা গিয়েছিল এর সঠিক ইতিহাস পাওয়া যায়নি। সম্প্রতি বাংলাদেশে এসেছিলেন মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ইরিনা। তিনি ১৯৭২ সালে মস্কো সফরের সময় বঙ্গবন্ধুর দোভাষী হিসেবে কাজ করেন। তিনি বলেছেন, ১৯৭৪ সালেও তিনি বঙ্গবন্ধুর আমন্ত্রণে এদেশে এসেছিলেন। তখন তাকে উদ্ধার অভিযান প্রত্যক্ষ করার জন্য এডমিরাল জোয়ানকো হেলিকপ্টারে করে চট্টগ্রামে নিয়ে যান। তখন জোয়ানকো তাকে বলেছিলেন, অভিযানে ১৯ সোভিয়েত নাবিক মারা যান। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের পরিচালক হারুন-অর-রশীদ খান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাবিবুর রহমান, উপব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী তউহীদ উল আলম। উপস্থিত ছিলেন মুক্তিযুদ্ধ একাডেমির চেয়ারম্যান ড. আবুল আজাত সাংবাদিক ইব্রাহিম আজাদ প্রমুখ।
×