ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জাফর ইকবাল ও ঢাবি ভিসির হত্যা চেষ্টা মামলার তদন্ত এবং আগামী দিনের বিপদ -স্বদেশ রায়

প্রকাশিত: ০৬:২৪, ১০ মে ২০১৮

জাফর ইকবাল ও ঢাবি ভিসির হত্যা চেষ্টা মামলার তদন্ত এবং আগামী দিনের বিপদ -স্বদেশ রায়

জাফর ইকবাল মারা যেতে পারতেন। চিকিৎসকদের তাৎক্ষণিক সঠিক সিদ্ধান্ত ও প্রধানমন্ত্রী নিজে তদারকি করাতে তিনি বেঁচে গেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি আকতারুজ্জামানও মারা যেতে পারতেন। কয়েক সাংবাদিক ও কয়েক শিক্ষক-শিক্ষিকার তাকে ঘিরে থাকা এবং পরবর্তী সময়ে জাহাঙ্গীর কবির নানকের পৌঁছানো, ঢাকা কলেজ থেকে ‘প্রকৃত’ ছাত্রলীগের ছেলেদের নিয়ে আসাÑ সব মিলে তিনি বেঁচে গেছেন। এমনকি হত্যার চেষ্টাকারীরা পুরো পরিবারটিকে পুড়িয়ে মারার জন্য গ্যাস পাইপ লাইনে আগুনও লাগিয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিকে তার পুরো পরিবারসহ হত্যার চেষ্টা হয়েছে কোটাবিরোধী আন্দোলনের সময়ে। এ আন্দোলনের নেতৃত্বে ও পেছনে যে মৌলবাদী জামায়াত শিবির ও বিএনপিও ছিল, এ নিয়ে এখন আর কারও সন্দেহ নেই। আন্দোলনের একজন নেতা রাশেদ খান ইসলামী ছাত্রী শিবিরের পোস্ট, জামায়াতের ফেসবুক পেজ ‘বাঁশের কেল্লা’র পোস্ট তার ফেসবুকে শেয়ার করে। তাই বুঝতে কারও বাকি থাকা উচিত নয় যে, সে একজন শিবির কর্মী। যদিও সে বার বার অস্বীকার করেছে সে শিবির কর্মী নয়। সাধারণত শিবির করি, বিএনপি করি এ গুলো খুব একটা ভদ্রলোকের ভেতর কেউ বলতে চায় না। তাই দেখা যায়, কিছু লোক বেশ চতুরভাবে বলে আমি কোন রাজনীতি করি না। এই অতি চতুর মানুষগুলো হয় জামায়াত- শিবির না হয় বিএনপি বা ছাত্রদল করে। আর যারা সত্যিই সক্রিয় রাজনীতি করেন না, তাদের এ ধরনের কোন দলের কাজের সঙ্গে কখনই কোন সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায় না। যা হোক, একটা বিষয় এখন প্রমাণিত যে, কোটাবিরোধী আন্দোলনে সাধারণ ছাত্রদের প্রতারণা করে মৌলবাদী নেতৃত্ব। আর এই মৌলবাদী চক্রেরই কাজ ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিকে সপরিবারে হত্যার চেষ্টা। জাফর ইকবাল হত্যা চেষ্টার বেশ পরেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিকে সপরিবারে এই হত্যা চেষ্টা করা হয়েছে। ভিসির বাসায় যেভাবে আক্রমণ করা হয়েছে তা মূলত সরকারী প্রশাসনকে চ্যালেঞ্জ করেই করা হয়। তাই এখন ভেবে দেখা দরকার, মৌলবাদীরা এতটা সাহস পেল কীভাবে? মৌলবাদীর সাহস পাবার ক্ষেত্রে সব থেকে বেশি কাজ করেছে জাফর ইকবাল হত্যা চেষ্টার পরে কোন মৌলবাদীদের গায়ে ফুলের টোকা না পড়ায়। প্রকাশ্যে জাফর ইকবালের মতো ব্যক্তিত্বকে হত্যা করার চেষ্টার পরেও যখন ওই হত্যাকারীদের শেকড়ে হাত দেয়া হয়নি, তদন্ত কচ্ছপ গতিতে শুধু নয়, ঘেরাটোপে বেঁধে ফেলা হয়েছে মামলার তদন্ত, তখন মৌলবাদীরা মনে করতেই পারে এটা তাদের জন্যে একটা সুসময়। তাই তারা মনে করে এ মুহূর্তে তারা আরও বড় কোন অপারেশনে যেতে পারে। আর যদি জাফর ইকবাল হত্যা চেষ্টার পরে পুলিশ প্রশাসনকে সর্বাত্মক নামানো হতো, সেই ভাবে যদি তৎপরতা চালানো হতো, যে সব মৌলবাদী সংগঠনের পক্ষ থেকে দীর্ঘদিন জাফর ইকবালকে হত্যার হুমকি দিচ্ছে, তাদেরকে যদি খুঁজে খুঁজে ধরা হতো- তাহলে চিত্র হতো ভিন্ন। তাহলে মৌলবাদীরা কোন মতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বাসা আক্রমণ ও ভিসিসহ তার গোটা পরিবারকে হত্যার চেষ্টা করতো না। জাফর ইকবাল হত্যা চেষ্টার ধরন দেখে প্রথমেই র‌্যাবের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, এই আক্রমণের ধরন আনসার উল্লাহ বাংলা টিমের আক্রমণের মতো। আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলোর জানা আছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু শিবির নয়, আনসার উল্লাহ বাংলা টিম, হিযবুত তাহরীরের মতো কট্টর জঙ্গী সংগঠনের অস্তিত্ব আছে। এমনকি পাঠচক্রের নামে সেখানে হিযবুত তাহরীর সদস্য ছাত্র ও শিক্ষকদের বৈঠক হয়, এমন খবরও পত্র পত্রিকায় বিভিন্ন সময়ে এসেছে। তাই কোটা আন্দোলনের নামে মৌলবাদীরা যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রণ এক পর্যায়ে নিয়ে নেয়, সে সময়ে যে শুধু শিবির নামবে বা ছাত্রদল নামবে তা নয়, হিযবুত, আনসারউল্লাহ বাংলা টিমসহ আরও যে সব জঙ্গী সংগঠনের সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গোপনে তাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে, তারাও যে নামবে, তাতে কোন সন্দেহ থাকার কথা নয়। তাই জাফর ইকবাল হত্যা চেষ্টার মূল ব্যক্তিদের খুঁজতে গেলে যেমন শুধু শিবির নয়, জামায়াতে ইসলামী বিভিন্ন নামে দেশে যে শতাধিক মৌলবাদী জঙ্গী গোষ্ঠী গড়ে তুলেছে তাদের সদস্যদেরও খুঁজতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিকে সপরিবারে হত্যার চেষ্টাটিও একই ভাবে খুঁজতে হবে। যেমন, এ মুহূর্তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেককে মনে করা হচ্ছে এরা অরাজনৈতিক। এরা কোন মতেই ভিসির বাসায় হামলা ও তার হত্যা চেষ্টার সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে না। এই ধরনের সাধু ভাবনার সুযোগ এখানে নেই। কারণ, এদের ছদ্মবেশ অনেক বড়। এরা হয়তো কেউ শিবির বা ছাত্রদলের সদস্য নয়। এ কারণে এরা একটি অরাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে ঘুরছে। খোঁজ নিতে হবে এরা আনসারউল্লাহ বাংলা টিম, হিযবুত তাহরীর- এ ধরনের সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত কিনা। নানান নামে হিযবুত বা এ ধরনের সংগঠনগুলোর পাঠচক্রের নামে যে গোপন বৈঠক হয় সেখানে তারা নিয়মিত বা মাঝে মাঝে যায় কিনা? কারণ, যে ঘটনার মধ্য দিয়ে ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের মতো একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিসহ তার পুরো পরিবারকে পুড়িয়ে মারা ও আঘাত করে হত্যার চেষ্টা করা হয়, ওই ঘটনাকে কখনই সামান্য কোন ঘটনা ভাবার কোন কারণ নেই। আর আন্দোলনের ভেতরের একটি অংশের ইন্ধন না থাকলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে এসে শুধুমাত্র বাইরের সন্ত্রাসীরা এ কাজ করে যেতে পারে না। অথচ গোটা জাতিকে দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করতে হচ্ছে, এক মাস হতে চললো, এই হত্যা চেষ্টা ও হামলার তদন্ত চলছে কচ্ছপ গতিতে। সত্যি কথা বলতে কি, এভাবে এ তদন্ত চললে একটা পর্যায়ে তদন্ত থেমে যেতে পারে বলেও মানুষ মনে করছে। আর জাফর ইকবালের হত্যা চেষ্টার পরে তদন্ত ও গ্রেফতার শুধু একটি পরিবার কেন্দ্রিক হওয়ায় জাফর ইকবালের কক্ষে আবারও রহস্যজনক তরুণের উপস্থিতি ঘটেছে। তাকে গ্রেফতারও করা হয়েছে। সত্যি বলতে কী, জাফর ইকবাল এখনও মোটেই নিরাপদ নন। আর এর জন্য দায়ী সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নীতি নির্ধারকরা। তারা এই হত্যা চেষ্টার গুরুত্ব শুরু থেকেই উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হচ্ছেন, না ইচ্ছে করে উপলব্ধি করছেন না, তাও এক মস্ত প্রশ্ন! অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিকে গোটা পরিবারসহ হত্যা চেষ্টার রহস্য উদঘাটনের তদন্ত শুধু যে কচ্ছপ গতিতে চলছে তা নয়, এর ফলও হবে ভয়াবহ। কারণ, মৌলবাদীরা এত বড় অপারেশন চালানোর পরেও তারা যদি নিজেদেরকে অরাজনৈতিকসহ নানান ছদ্মাবরণে ঢেকে রাখতে পারে, তাহলে তারা আবারও অন্য কোন বড় আক্রমণ চালাবে। জাফর ইকবালের ওপর হামলা চালিয়ে অনেকটা পার পেয়েছে বলেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বাসায় এ অপারেশন তারা প্রশাসনকে চ্যালেঞ্জ করে চালাতে পেরেছে। অন্যদিকে এই চক্রান্ত এখনো থেমে যায়নি। চক্রান্তকারীরা নানানভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাটিতে তাদের অবস্থান ধরে রাখতে চাচ্ছে। কেন তারা এ অবস্থান ধরে রাখতে চাচ্ছে? তারা জানে, এপ্রিলে তারা সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের প্রতারণা করে রাস্তায় নামিয়েছিল। তাই ওই কোটা বিরোধীরা এখন প্রজ্ঞাপনের দেরি হচ্ছে এ ধরনের কথা বলে এ মুহূর্তে আর সাধারণ ছাত্রদের রাস্তায় নামাতে পারবে না। তারাও সেজন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাটি ধরে রাখছে না। তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাটি ধরে রাখছে মূলত সেখানে একটি বড় ধরনের কোন নাশকতা ঘটানোর জন্য- যার মাধ্যমে দেশকে অস্থিতিশীল করা সম্ভব হবে। কারণ, তারা ধরেই নিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাটি যেহেতু সেনসেটিভ, তাই এখানেই তাদেরকে কিছু করতে হবে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য। এই সরকারের গত নয় বছরে এই মৌলবাদী শক্তি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এভাবে পা রাখতে পারেনি। এবার পেরেছে মূলত ছাত্রলীগ নেতৃত্বের ব্যর্থতা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী নেতৃত্বের সিদ্ধান্তের দোদুল্যমানতার কারণে। তাই এ মুহূর্তে দেশের স্থিতিশীলতার জন্য সব থেকে বড় বিষয় হলো, সরকারকে এটা নিশ্চিত করতে হবেÑ এই মৌলবাদী চক্র যেন জাফর ইকবালদের মতো ব্যক্তিত্বের জীবনের ওপর আবার আঘাত করতে না পারে আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন বড় ধরনের অঘটন ঘটাতে না পারে। সরকারের মনে থাকা উচিত, ২০১৩তে মাহমুদুর রহমান মান্না ফোনে সাদেক হোসেন খোকাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লাশ ফেলতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। এবারও তারা একই পথে যাবে। তবে গতবারের থেকে এবার তারা সুবিধাজনক অবস্থানে আছে এ কারণে যে, ইতোমধ্যে তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অরাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে তাদের একটি অবস্থান গেড়ে ফেলেছে। অন্যদিকে, গতবার ছাত্রলীগের নেতৃত্ব অনেক ভাল ছিল। এবারের নেতৃত্ব শুরুতেই ব্যর্থ হয়েছে। এই লেখা প্রকাশের একদিন পরেই ছাত্রলীগের সম্মেলন। এবার যখন ছাত্রলীগের সম্মেলন হচ্ছে, সে সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মূলত একটি জটিল পরিবেশে ঢুকে গেছে। এ সময়ে যেন কোন মতেই বেচাকেনার নেতৃত্ব তৈরি না হয়। শেখ হাসিনা নিজে খেয়াল না রাখলে প্রকৃত অর্থে সঠিক নেতৃত্ব আসবে না। আর ওই নেতৃত্বকে শুরুর দিন থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে নিরাপদ রাখার দায়িত্ব নিতে হবে। তাই নেতৃত্ব হতে হবে তেমনটি। কারণ, ওই নেতৃত্বকে একদিকে মৌলবাদীদের ও ছদ্ম মৌলবাদীদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিতাড়িত করতে হবে, অন্যদিকে তথাকথিত মিডিয়ার আঘাতও সহ্য করতে হবে। [email protected]
×