ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসীরা এবার দেশে খেজুর পাঠাতে পারছেন না

প্রকাশিত: ০৬:১৭, ১০ মে ২০১৮

মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসীরা এবার দেশে খেজুর পাঠাতে পারছেন না

এম শাহজাহান ॥ অতিরিক্ত শুল্কের কারণে রমজানেও সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত প্রবাসীরা দেশে খেজুর পাঠাতে পারছে না। রমজানে বিভিন্ন পণ্যের ওপর নানা ধরনের ছাড় দিলেও বিষয়টির দিকে তেমন নজর দেয়া হচ্ছে না। অন্যান্য পণ্যের মতো শুধু রমজানে প্রবাসীদের পাঠানো খেজুর শুল্কমুক্ত কিংবা নামমাত্র শুল্কারোপ হলে রোজাদারদের জন্য অন্যতম প্রয়োজনীয় পণ্যটি সহজলভ্য হতে পারে। মধ্যপ্রাচ্যে প্রবাসীদের সূত্রে জানা গেছে, রমজান সামনে রেখে মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত বিশেষ করে খেজুর বাগান বা খেজুর প্রক্রিয়াজাতকরণ কোম্পানিগুলোতে কর্মরত শ্রমিকদের বিনামূল্যে প্রচুর খেজুর উপহার হিসাবে পেয়ে থাকেন। এই সময় বাগান বা ফ্যাক্টরির মালিকরাই দেশে পাঠানোর জন্য তাদের এসব খেজুর উপহার দেন। প্রবাসীদের দাবি, উচ্চ শুল্কহারের কারণে এই খেজুরগুলো তারা দেশে পাঠাতে পারেন না। বর্তমান নির্ধারিত শুল্কে খেজুরগুলো দেশে এলে তা আমাদিকৃত খেজুরের চেয়ে দাম বেশি পড়ে যায়। খেজুরগুলো তারা শুল্পমুক্ত বা নামমাত্র শুল্কে দেশে পাঠাতে পারলে একদিকে যেমন রমজান মাসে খেজুরের চাহিদা পূরণ হয়, অন্যদিকে তাদের আত্মীয় পরিজনরাও কম মূল্যে খেজুর পেতে পারে। তারা সীমিত পরিসরে হলেও শুধু রমজানে এমন সুবিধা দাবি করে আসছেন। বিষয়টি সম্পর্কে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলছে, রমজান উপলক্ষে প্রজ্ঞাপন (এসআরও) জারি করে প্রবাসীদের পাঠানো খেজুরে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেয়া সম্ভব। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ ও চাহিদা বিবেচনায় নিয়ে এটা করা যেতেই পারে। তবে এনবিআর বলছে, এলসি ছাড়া যে কোন পণ্য কুরিয়ারে আনলে সেটার শুল্কহার বেশি। এটাই হয়ে আসছে, নতুন কিছু নয়। এনবিআর দাবি করছে, একশ টাকার সমপরিমাণ খেজুরে সবমিলে শুল্ক দিতে হচ্ছে ৫৯ টাকা। যদিও প্রবাসীরা বলছে এর পরিমাণ আরও অনেক বেশি। অন্যদিকে ঋণপত্র (এলসি) খুলে বাল্কে খেজুর আমদানিতে শুল্কহার ৪০ শতাংশ। জানা গেছে, সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে প্রায় অর্ধ কোটি প্রবাসী বাংলাদেশী বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান, হোটেল-মোটেল, বাসাবাড়ি, খেজুর বাগান এবং কৃষি জমিতে কাজ করছেন। কর্মরত এসব প্রবাসীরা তাদের প্রতিষ্ঠান ও মালিকদের কাছ থেকে রমজানে উপহার হিসেবে খেজুর পেয়ে থাকেন। পরিমাণে বেশি হওয়ায় নিজেদের টুক রেখে বাকি খেজুর কুরিয়ার করে দেশে পাঠানো হয়। কিন্তু কাস্টমস কর্তৃপক্ষের অতিরিক্ত শুল্কায়নের কারণে প্রবাসীদের খেজুর পাঠানো বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। এতে করে বাজারে খেজুরের দাম বেড়ে যাচ্ছে। গত বছর সবচেয়ে নি¤œমানের খেজুর ৬০-৮০ টাকা বিক্রি হলেও এবার সেই খেজুর ১২০-১৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যদিও বাজারে জাত ও মানভেদে এখন ১২০-১ হাজার টাকা দামে প্রতিকেজি খেজুর বিক্রি হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাণিজ্য সচিব শুভাশিষ বসু জনকণ্ঠ বলেন, রমজানে খেজুরের চাহিদা কয়েকগুণ বাড়ে। এ ক্ষেত্রে ২৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক রয়েছে। তবে এটা ব্যক্তি পর্যায়ে সৌদি আরব বা অন্যান্য দেশ থেকে কুরিয়ারে খেজুর আনলে আমদানি শুল্কের পাশাপাশি অন্যান্য ডিউটি প্রদান করতে হচ্ছে। রমজান বিবেচনায় নিয়ে এনবিআর এসআরও জারি করে শুল্কহার তুলে দিতে পারে। তিনি বলেন, পুরো বিষয়টি এনবিআরের ওপর নির্ভর করছে। তিনি বলেন, রমজানে খেজুর বেশি প্রয়োজন হয় বিধায় রাষ্ট্রীয় বিপণন সংস্থা টিসিবি অন্যান্য পণ্যের সঙ্গে খেজুর বিক্রি করছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্যমতে, বাল্ক ব্যতীত ব্যক্তি পর্যায়ে কুরিয়ার সার্ভিসে যারা খেজুর পাঠান তাদের শুল্কহার অনেক বেশি। ২৫ শতাংশ কাস্টমস শুল্কের সঙ্গে সাপ্লিমেন্টারি উিউটি, ভ্যাট, এ্যাডভান্স ইনকাম ট্যাক্স এবং এ্যাডভান্স ট্রেড ভ্যাট দিতে হয়। সবমিলিয়ে শুল্কহার প্রায় ৫৯ শতাংশ। অন্যদিকে এলসি করে বাল্কে খেজুর আমদানিতে ২৫ শতাংশ কাস্টম ডিউটি রয়েছে। আমদানিকারকদের ভ্যাট, সম্পূরক শুল্ক দিতে হয় না। সবমিলিয়ে ৪০ শতাংশ শুল্ক দিতে হচ্ছে আমদানিকারকদের। এ প্রসঙ্গে জানতে এনবিআরের এক উর্ধতন কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, প্রবাসীদের পাঠানো খেজুরের ওপর ৫৯ শতাংশ শুল্ক আদায় করা হয়। আমদানিতে এ শুল্কহার ৪০ শতাংশ। এই বৈষম্য দূরীকরণে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা প্রয়োজন। জানা গেছে, রমজানে খেজুরের সবচেয়ে বেশি চাহিদা তৈরি হয়। ইফতারির আরও একটি প্রধান খাবার খেজুর। দেশে সারাবছর যে খেজুর বিক্রি হয় তার ৯৮ ভাগের বেশি বিক্রি হয় রমজান মাসে। ট্যারিফ কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, সারা বছর ২০-২৬ হাজার টন খেজুর বিক্রি হয়। এর মধ্যে রমজান মাসে বিক্রি হয় ১৮-২০ হাজার টনের বেশি। ইরাক, ইরান, দুবাই, মিসর, পাকিস্তান, সৌদি আরব ও আলজেরিয়া থেকে সবেচেয়ে বেশি খেজুর আমদানি করা হয়। এসব খেজুর টনপ্রতি ৫০০ থেকে ৬০০ ডলারে শুল্কায়ন হচ্ছে। শুকনো খেজুরের ৫০০ গ্রামের কার্টনের শুল্কহার ২৫ শতাংশ। এছাড়া খেজুর আমদানির বড় বাজার হচ্ছে সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাজধানী দুবাই। মধ্যপ্রাচ্যসহ আশপাশের বিভিন্ন দেশ থেকে সেখানে খেজুরের মজুদ করা হয়। এর পর থেকে সেখান থেকে রফতানি হয়। বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা দুবাই থেকেই খেজুর আমদানি করে থাকেন। বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইমপোর্টার্স এ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম জানান, রমজানে চাহিদার পুরোটা আমদানি হয়ে ইতোমধ্যে গুদামে মজুদ রয়েছে। ফলে সঙ্কটের কোন সুযোগ নেই। ব্যবসায়ীরা জানান, আগে বস্তাভর্তি খোলা খেজুরের চাহিদা বেশি ছিল দেশে। ইদানীং প্যাকেটজাত খেজুরের চাহিদা বেড়েছে। কাস্টমসে টনপ্রতি ৫০০ ডলার থেকে ৬০০ ডলারে এসব খেজুরের শুল্কায়ন হচ্ছে। তবে তিউনিসিয়ার খেজুর শুল্কায়ন হচ্ছে রেকর্ড দামে এক হাজার ২৫০ ডলারে। পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানিয়েছে, বাজারে খালাস, মুসকানি, ওয়াসলি, বেরহি, ডেইরি, সাফাওয়ি, শালাবি, ওয়ান্নহ, সুক্কারি, মাবরুম, খুরমা, মরিয়ম, আমিরাত গোল্ডসহ বিভিন্ন নামের ও জাতের খেজুর পাওয়া যাচ্ছে। মোট বাজারের ৯৫ শতাংশ দখল করা এই খেজুরগুলো পাইকারিতে ৭০-১২০ টাকা পর্যন্ত দামে বিক্রি হচ্ছে, যা খুুচরা পর্যায়ে সর্বোচ্চ ১২০-২০০ টাকার মধ্যেই বিক্রি হওয়ার কথা। জানা গেছে, কাতারে প্রায় এক হাজারের বেশি খেজুর খামার রয়েছে যার মধ্যে ৯০২টি খামার সরাসরি খেজুর উৎপাদন করে থাকে। এসব খামারে উৎপাদনকর্মী ও খেজুর বাগানের মালি হিসেবে কাজ করেন অনেক বাংলাদেশী। গত বছর কাতারে উৎপাদিত খেজুরের পরিমাণ ছিল প্রায় ২৯ হাজার টন। এছাড়া মদিনার বাগানগুলোতেও মালি হিসেবে কাজ করেন বাংলাদেশীরা। রমজানে এসব দাবি খেজুর উপহার হিসেবে পেয়ে থাকেন তারা। এসব বাগানে উৎপাদিত মনোয়ারা খেজুর বাজারের সেরা। এর দাম এক হাজার ২৫০ টাকা কেজি। সংশ্লিষ্টদের মতে, শুল্কায়ন জটিলতা দূর হলে দাবি এসব খেজুর আসবে বাংলাদেশে।
×