ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

এনামুল হক

চীন-মার্কিন বাণিজ্য যুদ্ধ!

প্রকাশিত: ০৭:৫১, ৯ মে ২০১৮

চীন-মার্কিন বাণিজ্য যুদ্ধ!

এক বছর আগে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংকে যুক্তরাষ্ট্রে স্বাগত জানিয়েছিলেন। দুই নেতা শীর্ষ বৈঠকে মিলিত হন। যদিও পূর্বাভাস ছিল এমন যে দুই ভিন্ন মেজাজের এই দুটি মানুষের মুখোমুখি সাক্ষাত অস্বস্তিকর পরিণতি বয়ে আনবে তথাপি এই বৈঠক দুটি দেশকে উত্তর কোরিয়া প্রশ্নে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে এবং বাণিজ্য যুদ্ধ এড়াতে সাহায্য করেছিল। কিন্তু এ বছর হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে কংগ্রেসের নির্বাচনী বছর। এই নির্বাচনী বছরে ট্রাম্প তার সমর্থকদের দেখাতে চান যে চীনও বাণিজ্য ঘাটতি প্রশ্নে তিনি কঠোর ভূমিকা গ্রহণের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তা তিনি রক্ষা করছেন। গত মার্চ মাসে তিনি ইস্পাত ও এ্যালুমিনিয়াম আমদানির ওপর শুল্ক ঘোষণা করার পর বিভিন্ন মহল থেকে তার ওপর বেশ চাপ আসে। এদের মধ্যে ছিলেন মার্কিন ব্যবসায়ীরা যাদের সস্তায় ইস্পাত প্রয়োজন ছিল সেই সব মার্কিন মিত্র যারা ইস্পাত রফতানি করে থাকে, ছিল রিপাবলিকান গবর্নর ও আইন প্রণেতারাও। ট্রাম্প প্রশাসন তখন ইউরোপ এবং কানাডা, মেক্সিকো, ব্রাজিল ও দক্ষিণ কোরিয়াসহ বেশকিছু দেশকে এই শুল্ক থেকে অব্যাহতি দেয়ার কথা ঘোষণা করে। তবে চীনকে নয়। বলা যায় তখন থেকেই দু’দেশের মধ্যে বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। তবে এই যুদ্ধটা শুধু বাণিজ্য যুদ্ধ নয়, তার চেয়েও বেশি কিছু। কারণ শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত ঘোষণার অল্প কিছু দিন আগে ট্রাম্প তাইওয়ান ট্রাভেল এট-এ স্বাক্ষর দিয়ে সেটি আইনে পরিণত করেছিলেন। এই আইনের ফলে মার্কিন সরকারের সব পর্যায়ের কর্মকর্তারা তাদের সমপর্যায়ের তাইওয়ানী কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা সাক্ষাত করার তাইওয়ানে যাওয়ার এবং উচ্চ পর্যায়ের তাইওয়ানী কর্মকর্তারা যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের সুযোগ লাভ করে। গত ৪০ বছর ধরে এ সংক্রান্ত যে নীতি চলে আসছিল এই পদক্ষেপের ফলে তা একেবারে পাল্টে যায়। অথচ আমেরিকার বেশিরভাগ মিডিয়ায় এ ঘটনাটি তেমন কোন গুরুত্ব লাভ করেনি। তবে মার্কিন মিডিয়া না দিলেও চীনের মিডিয়া ব্যাপারটিকে যথেষ্ট গুরুত্বসহকারে পরিবেশন করেছে। চীনের কিছু সরকারী কর্মকর্তা এ ঘটনাকে যুক্তরাষ্ট্রের ‘এক চীন নীতি’ খোলাখুলি প্রত্যাখ্যান হিসেবে দেখেছেন এবং বলেছেন যে এটাই প্রমাণ যে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য শুল্ক আরোপের লক্ষ্য মার্কিন মেনুফ্যাকচারিং শিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করা নয় বরং চীনের ক্রমপ্রসারমান প্রভাব রোধ করা। এসব কিছুর মধ্যে আরেক চমক ঘটেছে উত্তর কোরিয়াকে নিয়ে। সে দেশের প্রেসিডেন্ট কিম জং উন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে বৈঠকে মিলিত হওয়ার জন্য সরাসরি প্রস্তাব দিয়ে বসেছেন এবং ট্রাম্পও সেই প্রস্তাব গ্রহণ করেছেন। মে মাসের মধ্যেই ট্রাম্প এই বৈঠকে মিলিত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন। চীন এই খবরটিকে মোটেই খুশি মনে নেয়নি। আরও নেয়নি এ জন্য যে ওই বৈঠকে চীনের একজন প্রতিনিধি উপস্থিত থাকবেন এ ধরনের কোন বিবৃতিও উত্তর কোরিয়া দেয়নি। এদিকে গত ২২ মার্চ ট্রাম্প ঘোষণা করেন যে তিনি ৫ হাজার কোটি ডলারের শুল্ক আরোপ করতে চান এবং এবার সরাসরি চীনকে টার্গেট করে সেটা দেয়া হয়। ট্রাম্প বলেন, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ঘাটতি থেকে বেজিং ১০ হাজার কোটি ডলার কমিয়ে ফেলার কার্যকর পদক্ষেপ না নিয়ে আরও শুল্ক আরোপ করা হবে। এর জবাবে গত ২ এপ্রিল চীন যুক্তরাষ্ট্রের ১২৮টি পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপ করে যার আর্থিক পরিমাণ ৩ হাজার কোটি ডলার। শুল্ক আরোপের দিক দিয়ে চীনের আনুপাতিক জবাব থেকে এই সঙ্কেত পাওয়া যায় যে চীন বাণিজ্য যুদ্ধ চায় না তবে ট্রাম্প সেই লড়াইয়ের বিস্তার ঘটাতে বেজিংও ছেড়ে কথা কইবে না। ৩ এপ্রিল ট্রাম্প প্রশাসন তাদের বিস্তারিত শুল্ক প্রস্তাবে টার্গেট হিসেবে সুপারিশকৃত চীনা পণ্যের তালিকা প্রকাশ করে যার মধ্যে ছিল ১৩শ’রও বেশি পণ্য। ৪ এপ্রিল চীনও মার্কিন পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপের পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়ে প্রায় ৫ হাজার কোটি ডলারে নিয়ে যায়। শুল্ক নিয়ে এই লড়াই আরও প্রসারিত হওয়ার আশঙ্কা আছে। কারণ দু’পক্ষই মনে করে যে তাদের অবস্থান অধিকতর শক্তিশালী। ট্রাম্প বিশ্বাস করেন যে চীনের অর্থনীতি আমেরিকার এই বাণিজ্যিক পদক্ষেপে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যের ক্ষেত্রে চীনের ওপর যতটা নির্ভরশীল তার চেয়েও বেশি চীন নির্ভরশীল যুক্তরাষ্ট্রের ওপর। বিশ্বব্যাংকের হিসেবে চীনের জিডিপির ৩৭ শতাংশ আসে বাণিজ্য থেকে যদিও সেটা আগের তুলনায় কমে এসেছে। ২০০৬ সালে জিডিপিতে বাণিজ্যের অবদান ছিল ৬৫ শতাংশেরও বেশি। অন্যদিকে আমেরিকার জিডিপির ২৭ শতাংশের জন্য দায়ী হলো বাণিজ্য। এখানেই চীনের পরিস্থিতি অধিকতর বিপন্ন। রাজনৈতিকভাবে কিন্তু এই শুল্ক যুদ্ধ নিয়ে শি জিন পিং যতটা না ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় তার চেয়ে অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছেন ট্রাম্প। এটা কোন আপতিক ব্যাপার নয় যে চীন সে সব মার্কিন পণ্য টার্গেট করেছে তার মধ্যে রয়েছে জিনসেং ও শূকরের মাংস। এই দুটি পণ্যের ওপর শুল্ক বাড়ানো হলে উইসকনসিন ও আইওয়ার মতো রাজ্যগুলোর কৃষক ও ব্যবসায় মালিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অথচ ট্রাম্প যদি ২০২০ সালের নির্বাচনে জিততে চান তাহলে এই দুটি রাজ্যের সমর্থন তার জন্য অপরিহার্য। শুল্ক সংক্রান্ত পদক্ষেপের জন্য শি জিন পিং যতটা না জনগণের কাছে সমালোচিত হবেন তার চেয়ে বেশি হবেন ট্রাম্প। আমেরিকার মতো কোন দোদুল্যমান রাজ্য বা প্রদেশ চীনে নেই। চীনের দ্বিতীয় দফা শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্তে অনেক মার্কিন পণ্যকেই টার্গেট করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে আছে গাড়ি, অরেঞ্জ জুস ও সয়াবিন। এসব পণ্যে প্রতিবছর আমেরিকার ১৪০০ কোটি ডলারের বাণিজ্য হয়। এই শুল্ক ট্রাম্পের ঘাঁটি অঞ্চলের ওপর আরও বৃহত্তর পরিসরে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তবে সেই প্রতিক্রিয়া শুরুও হয়ে গেছে। ট্রাম্প মার্কিন কোম্পানিগুলোর চীনের বিশাল বাজারে অধিকতর প্রবেশের সুযোগ চান। কিন্তু চীনের শুল্ক সেই সুযোগ ব্যাহত করবে। বলা যেতে পারে দু’দেশের বাণিজ্য যুদ্ধ এক অর্থে শুরু হয়ে গেছে। এর পরিণতি কি দাঁড়াবে একমাত্র ভবিষ্যতই বলতে পারে। সূত্র : টাইম
×