ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মোঃ মামুন রশীদ

স্বপ্ন পূরণের লড়াইয়ে লিখন

প্রকাশিত: ০৭:৪৯, ৯ মে ২০১৮

স্বপ্ন পূরণের লড়াইয়ে লিখন

পুরো বিশ্বকে কাঁপিয়ে দেয়া পাকিস্তানী লেগস্পিনার ইয়াসির শাহ তখন ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে। বাংলাদেশ সফরে আসার পর নেটে জুবায়ের হোসেন লিখনকে দেখে বিস্মিত হয়েছিলেন পাকিস্তানের লেগস্পিনার ইয়াসির শাহ। সবেমাত্র তখন পাক দলে কয়েক টেস্ট খেলেছেন তিনি। লিখনের গুগলি দেখে বিস্মিত হয়ে তার কাছ থেকে টিপস নিয়েছিলেন। সেবার দুই টেস্টের সিরিজে লিখন দলে থেকেও খেলার সুযোগ পাননি, ইয়াসির দুই টেস্টেই খেলে মোট ১০ উইকেট শিকার করেছিলেন। অথচ মাত্র ১৮ বছর বয়সে অভিষেক হওয়া লিখন ক্যারিয়ারের তৃতীয় টেস্টে এক ইনিংসে ৫ উইকেট শিকার করেও গত ৩ বছর আর জাতীয় দলেও সুযোগ পাননি। ইয়াসির হয়ে গেছেন বিশ্বের অন্যতম সেরা লেগস্পিনার। তবে হতোদ্যম হননি লিখন। ঘরোয়া ক্রিকেটেও সেভাবে সুযোগ না পাওয়া এ ২২ বছর বয়সী প্রতিভাবান লেগস্পিনার অনুশীলন চালিয়ে যাচ্ছেন কোচ হুমায়ুন কবীর শাহীনের অধীনে। স্বপ্ন দেখছেন আবারও জাতীয় দলে ডাক পাওয়ার। লিখন মনে করছেন এখনও সময় ফুরিয়ে যায়নি, সুযোগ আছে যথেষ্ট। সেজন্যই চেষ্টাটা নিজের মতো করে চালিয়ে যাচ্ছেন। ২০১৪ সালের অক্টোবরে লিখনের টেস্ট অভিষেক হয় জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে। সেবার সিরিজের প্রথম দুই টেস্টে মাত্র ৪ উইকেট পেলেও আস্থা ধরে রাখতে পেরেছিলেন। চট্টগ্রামে হওয়া তৃতীয় টেস্টে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করেন প্রথম ইনিংসে ৫ এবং দ্বিতীয় ইনিংসে ২ উইকেট শিকার করে। পরবর্তী বছর ভারতের সঙ্গে ১টি ও দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে দুই টেস্ট খেলার পরই আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার থেমে গেছে লিখনের। এমনকি দেশে বাঁহাতি স্পিনারদের একচেটিয়া দাপটের কারণে ঘরোয়া আসরগুলোতেও খেলার সুযোগ পাননি তিনি। অথচ, সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বের অন্যতম সেরা টেস্ট লেগস্পিনার হিসেবে ‘ভয়ঙ্কর’ হিসেবে বিবেচিত পাকিস্তানী ইয়াসির তার কাছেই গুগলি ছোঁড়ার পরামর্শ নিয়েছিলেন। লিখনকে বাংলাদেশ সদ্ব্যবহার করতে পারেনি। তাকে সুযোগ দেয়া হয়নি। আর ইয়াসির সুযোগ পেয়ে, পরিচর্যা ও অনুশীলনে নিজেকে উন্নত করতে করতে এখন ক্রিকেট বিশ্বের অন্যতম কার্যকর লেগস্পিনার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তবে লিখন থেমে নেই, চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। যেখানে সুযোগ পাচ্ছেন ম্যাচ খেলছেন এবং এই মুহুর্তে অনুশীলন করছেন কোচ শাহীনের অধীনে। এ বিষয়ে লিখন বলেন, ‘এক মাসের বেশি হচ্ছে আমি কাজ করছি। রানিং করছি, জিম করছি। প্রতিদিন তো বোলিং থাকছেই। এখন অনুশীলন অনেক ভাল হচ্ছে। আগে এতটা ফিট ছিলাম না। এখন শরীরও ফিট হয়েছে অনেকটা, ওজনও কমছে। শুক্রবারের দিনও আমাকে উইকেট দেওয়া হয়। সব কিছু মিলিয়ে ভাল হচ্ছে। বোর্ড কিন্তু সব খেলোয়াড়দের সুযোগ-সুবিধা দেয় না। আমি গত বছর ঘরোয়া লীগেও খেলিনি। আমাকে এইচপিতে রেখেছে। বোর্ডের প্রতি আমি অনেক কৃতজ্ঞ যে তারা আমাকে অনেক সহায়তা করছে। আমার প্রতি তাদের যে প্রত্যাশা আমিও চেষ্টা করব সেটার মান রাখতে।’ প্রতিদিন অনুশীলনে ২০ ওভার করে বোলিং করছেন লিখন। কোচ শাহীন যেভাবে পরামর্শ দিচ্ছেন, সেভাবেই কাজ করে যাচ্ছেন। বোলিংয়ের গতি, একুরেসিও এখন অনেক ভাল হচ্ছে বলে দাবি করেছেন তিনি। এ বিষয়ে লিখন বলেন, ‘যদি কঠোর পরিশ্রম করি, চেষ্টা করি ভাল কিছু দিতে পারব। আমার মূল যে সমস্যাটা আত্মবিশ্বাস একটু ঘাটতি থাকে। যেহেতু ঘরোয়া খেলি নেই। আগে যেটা হতো ম্যাচ খেলা কম হতো, এখন ছোট বড় যেখানেই পাই ম্যাচ খেলছি। আমারও আক্ষেপ লাগে যে আমিও তো কিছু দিতে পারতাম। তবে সময় আসলে শেষ হয়ে যায়নি। যদি সুযোগ আসে চেষ্টা করব দলের জন্য, দেশের জন্য ভাল কিছু করার। আমার মধ্যে যদি ওইরকম প্রতিভা না থাকত তাহলে এত দ্রুত জাতীয় দলে খেলার সুযোগ হতো না। যারা আছেন কোচ, নির্বাচক সবাই বুঝেশুনেই কিন্তু আমাকে নিয়েছিলেন। প্রতিভা ছিল তবু হয়তবা আমার ঘাটতি ছিল। হয়ত পরিশ্রম কম করতাম, তখন পরিণত ছিলাম না। অনেকজন বলার পরেও করতাম না অনেক কিছু। এখন বুঝতে পারছি যে আমার কি ভুল ছিল। দল থেকে বাদ পড়ার পর বুঝেছি, খারাপ সময় না এলে আসলে মানুষ ভালটা বোঝে না। খারাপ সময় এসেছে, ভুলগুলো বুঝেছি। আমার সুযোগ আসলে চেষ্টা করব ভুলগুলো না করতে।’ একেবারেই হারিয়ে গেছেন তিনি। গত ৭ মাসে মাত্র একটি বড় পর্যায়ের প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেট খেলেছেন তিনি। গত বছর অক্টোবরে বাংলাদেশ ‘এ’ দলের হয়ে সর্বশেষ আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে খেলেছেন তিনি। অথচ ২০১৪ সালে সাবেক কোচ চান্দিকা হাতুরাসিংহে তাকে নেটে বোলিং করতে দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন এবং সুযোগ করে দিয়েছিলেন আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার। সেই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে নিজের উন্নতি করতে পারেননি। খামখেয়ালিপনা, চেষ্টার অভাব, ফিটনেসের দিকে মনোযোগী না হওয়া, এ্যাকুরেসি বাড়াতে অসচেতনতা ইত্যাদির কারণে ছিটকে যান এবং হাতুরাসিংহের সুদৃষ্টিও হারিয়ে যায়। দেশের অনেক কোচই দাবি করেন লিখন যা দিতে পারে সেটার মাত্র ৩০ ভাগ তিনি দেখাতে পারেন। আর এসব কারণেই হারিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। সর্বশেষ কিংবদন্তি অস্ট্রেলিয়ান লেগস্পিনার শেন ওয়ার্ন অবসরে যাওয়ার পর বিশ্ব ক্রিকেট অনেক দিন শূন্যতায় ভুগেছে। তেমন কোন লেগস্পিনার দেখা যায়নি। কিন্তু এরপর ইংল্যান্ডের আদিল রশিদ, পাকিস্তানের ইয়াসির শাহ, আফগানিস্তানের রশীদ খান, দক্ষিণ আফ্রিকার ইমরান তাহির, নিউজিল্যান্ডের ইশ সোধি, ভারতের যুবেন্দ্র চাহাল, পাকিস্তানের শাদাব খান ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের স্যামুয়েল বদ্রিরা নিজেদের ভয়ঙ্কর লেগস্পিনার হিসেবে আবির্ভূত করেছেন। এর মধ্যে বর্তমানে টি২০ ক্রিকেটের র‌্যাঙ্কিংয়ে প্রথম ৫জন বোলারই লেগস্পিনার। শীর্ষস্থান থেকে ৫ নম্বর পর্যন্ত আছেন- রশীদ খান, শাদাব, চাহাল, সোধি ও বদ্রি। এছাড়া ৭ নম্বরে আছেন তাহির! কিন্তু বিশ্ব ক্রিকেটে যখন লেগস্পিনারদের এমন দাপট চলছে সেখানে বাংলাদেশ দলে কোন লেগস্পিনার নেই। অথচ লিখনের মতো প্রতিভাবান ক্রিকেটারকে বসিয়ে রাখা হয়েছে যার প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন বিশ্বের ক্রিকেট বোদ্ধারা। সাম্প্রতিক সময়ে ক্রিকেট বিশ্বে লেগস্পিনারদের একচেটিয়া দাপট আবার তাকে মনে করিয়ে দিয়েছে। তবে এ বছর প্রিমিয়ার লীগে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে থাকলেও কোন ম্যাচ খেলার সুযোগ হয়নি। নিজের বিষয়ে লিখন আরও বলেন, ‘হয়ত আমার কোন ভুল আছে যে কারণে আমাকে ঘরোয়া লীগে খেলাচ্ছে না। হয়ত টিম কম্বিনেশনের কারণে হোক বা যেকারণেই হোক আমার উপর ভরসা করতে পারছে না। সিনিয়র ক্রিকেটারদের সঙ্গে আমি খুব কৃতজ্ঞ। সব সময় আমাকে সাপোর্ট করছে। মাশরাফি ভাই, রিয়াদ ভাই, সাকিব ভাই, তামিম ভাই কখনও আমাকে নেতিবাচক কিছু বলেনি। সব সময় ভাল কথা বলছে। আমি আত্মবিশ্বাসী। আসলে খুবই ভাল হচ্ছে। আমি যদি ম্যাচ খেলি দুই/তিনটা আমার আত্মবিশ্বাস পুরোপুরি আবার ফিরে আসবে। যেখানে পারি (খেপ) ম্যাচ খেলছি এবং ভাল করছি। আমার বোলিং যারা দেখছে, যারা ব্যাট করছে সবাই বলছি গতি, একুরেসি সব ভাল হচ্ছে। আমি তো কঠোর পরিশ্রম করছি। আশা তো করি। বোর্ড থেকে আমাকে সাপোর্ট করছে। আমি মনে করি তারা যেটা করবে আমার ভালোর জন্য করবে। সুযোগ আসতে পারে, নাও পারে। যেটা করছি উন্নতি হচ্ছে। চেষ্টা করব যা করছি সেটা করে যাওয়া এবং সুযোগ আসলে সেটা কাজে লাগানো।’
×