ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

এক যুগের কোন উদ্যোগই কার্যকর হয়নি;###;গণপরিবহনে সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই

সড়ক যোগাযোগ খাত এখন আতঙ্কের নাম ॥ পরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরানো যাচ্ছে না

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ৯ মে ২০১৮

সড়ক যোগাযোগ খাত এখন আতঙ্কের নাম ॥ পরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরানো যাচ্ছে না

রাজন ভট্টাচার্য ॥ সড়ক যোগাযোগ খাতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিবহন সেক্টর। অথচ কোন কিছুতেই এই সেক্টরে শৃঙ্খলা ফেরানো সম্ভব হচ্ছে না। গত প্রায় ১২ বছরে এই খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে যত উদ্যোগ নেয়া হয়েছে এর কোনটিই কার্যকর হয়নি। তাছাড়া বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সরকার ও পরিবহন মালিকদের মধ্যে বড় রকমের অনীহা বা সদিচ্ছার অভাব দেখা গেছে। বিশৃঙ্খাল পরিস্থিতির কারণেই একের পর এক সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে। বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল। পঙ্গুত্ব বরণ করছেন বহু মানুষ। শ্রমিকরাও তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। সব মিলিয়ে সড়ক যোগাযোগ খাত এখন আতঙ্কের নাম। যদিও বাংলাদেশের চাইতে অনেক বেশি পরিবহন চলে বিশ্বের অনেক দেশেই। সেখানে শৃঙ্খলার কারণে আমাদের দেশের মতো সঙ্কট তৈরি হয়নি। দুর্ঘটনার মাত্রাও সহনীয়। জানা গেছে, জাপানের আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থা জাইকা ২০১০ ও ২০১১ সালে ঢাকার গণপরিবহন ব্যবস্থা নিয়ে সমীক্ষা (ডিএইচইউটিএস) চালায়। ২০১৪ সালে সংস্থাটি ঢাকার জন্য করা ২০ বছরের কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা (এসটিপি) সংশোধন করতে গিয়ে আরেক দফা সমীক্ষা চালায়। এর আগে ২০০৪ সালে বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে বিদেশী পরামর্শক দিয়ে সরকার স্ট্র্যাটেজিক ট্রান্সপোর্ট প্ল্যান (এসটিপি) প্রণয়ন করে। এসব গবেষণা ও সমীক্ষায় ঢাকার জনসংখ্যার ঘনত্ব, যাত্রীদের যানবাহন ব্যবহারের তথ্য বিশ্লেষণ ও যানজটের কথা বিবেচনা করে বাস রুট ফ্র্যাঞ্চাইজি বা বিশেষ পদ্ধতিতে বাস পরিচালনার পরামর্শ দেয়া হয়। অর্থাৎ বিক্ষিপ্তভাবে বাসের অনুমোদন না দিয়ে পরিকল্পিত ব্যবস্থা চালুর কথা বলা হয়। কিন্তু কোন সময়ই এ বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেয়া হয়নি। ইচ্ছেমত গণপরিবহন ব্যবস্থাকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। রাজনৈতিক বিবেচনায় চলে গেছে গোটা পরিবহন সেক্টর। ইচ্ছেমত মালিকরা গাড়ি নামাচ্ছেন। রাতারাতি নতুন নতুন কোম্পানি গড়ে তোলা হচ্ছে। বিআরটিএ সচিব শওকত আলী বলেন, যে কোন শহরে পরিবহন সেক্টরে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা বা শৃঙ্খলার মধ্যে এনে এই সেক্টরকে নিয়ন্ত্রণ করা হবে এটাই স্বাভাবিক। আমরা নানা কারণে এই কাজটি করতে ব্যর্থ হচ্ছি। তিনি বলেন, পরিবহন সেক্টরে সরকারের অংশীদারিত্ব খুবই কম। অর্থাৎ বেসরকারী খাতে গোটা পরিবহনের নিয়ন্ত্রণ। আমরা চাইলেও হয়ত অনেক কিছু করতে পারি না। আবার সদিচ্ছা নিয়ে আমরা অনেক কিছু করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছি তাও বলা যাবে না। তবে সঙ্কট আছে। এর মধ্যে একটু একটু করে আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় এসেছে। বিশেষজ্ঞরা অনেক আগে থেকেই ঢাকার পরিবহন সেক্টরে শৃঙ্খলা ফেরাতে বিভিন্ন রকমের মতামত দিয়ে আসছিলেন। কিন্তু প্রভাবশালীদের চাপে গণপরিবহন ব্যবস্থাকে জোর না দিয়ে প্রাইভেট কারকে উৎসাহিত করা হয়েছে। এখন রাজধানীর যানজটের অন্যতম কারণ এই প্রাইভেট কার। অথচ সবচেয়ে কম সংখ্যক মানুষ ব্যক্তিগত পরিবহনে যাতায়াত করে। বাস, রিক্সা, অটোরিক্সা, ট্যাক্সিসহ অন্যান্য গণপরিবহনে মানুষের নির্ভরতা সবচেয়ে বেশি। ভুল পরিচালন নীতির কারণে গণপরিবহন ব্যবস্থা সঙ্কুচিত হয়ে এসেছে। মাত্র ৬ হাজার বাস চলছে রাজধানী শহরে। অটোরিক্সা ১৩ হাজার নিবন্ধিত থাকলেও চলছে সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার। সোনার হরিণ ট্যাক্সিক্যাব! অথচ এখন দুই কোটির বেশি মানুষ এই শহরে বসবাস করছে। সর্বশেষ ঢাকার প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক মেয়র হওয়ার পর পরই সব বাস ছয়টি কোম্পানির অধীনে আনার উদ্যোগ নেন। পরিবহন মালিক, সরকারী-বেসরকারী অংশীজনদের সঙ্গে ২৫-২৬টি বৈঠক করে তাদের রাজি করানো হয়। তিনি ঢাকা যানবাহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ) সাবেক নির্বাহী পরিচালক সালেহউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে একটি বিশেষজ্ঞ দলকে পরিকল্পিত বাস পরিচালনার বিষয়ে প্রস্তাব তৈরি করার দায়িত্ব দেন। শুধু তাই নয়, ব্যাংক থেকে কম সুদে টানা নিয়ে বাস নামানোর ব্যবস্থা করেছিলেন তিনি। এতে সম্মতি দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংকসহ অর্থ মন্ত্রণালয়। তার মৃত্যুর পর উদ্যোগটি অনেকটাই থেমে গেছে। এটি আর আলোর মুখ দেখবে কিনা কেউ জানে না। বিশেষজ্ঞরা যে পরিকল্পনা তৈরি করেছেন তাতে বলা হয়েছে, ছয়টি কোম্পানির অধীনে বাসগুলো ছয়টি পথে বিভক্ত করে দিতে হবে। প্রতিটি কোম্পানির বাসের রং থাকবে আলাদা। বিদ্যমান পরিবহন মালিকেরা এই কোম্পানিগুলোতে অন্তর্ভুক্ত হবেন। বিনিয়োগের হার অনুসারে মালিকেরা লভ্যাংশ পাবেন। এটা করা হলে পথে বাসের চালকদের মধ্যে অশুভ প্রতিযোগিতা করার প্রয়োজন হবে না। পরিকল্পনায় আরও বলা হয়, পাঁচ বছরের বেশি পুরনো বাস-মিনিবাসকে বাতিল ঘোষণা করতে হবে। কারণ, এগুলো চলাচলের অনুপযোগী। নতুন করে ৪ হাজার ১৫০টি বাস-মিনিবাস ও জোড়া লাগানো বাস কিনতে হবে। এর জন্য সরকার ৪ শতাংশ সুদে ঋণ সুবিধা দিতে পারে। পুরনো বাসের মধ্যে ৩ হাজার ৭৯০টি মেরামত করে চালানো সম্ভব। সব মিলিয়ে ঢাকার জন্য ৭ হাজার ৯৪০টি বাস-মিনিবাস ও জোড়া লাগানো বাসের একটা বহর থাকবে। সব মিলিয়ে ৩ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পটি সরকার, পরিবহন মালিকদের মূলধন এবং ব্যাংক ঋণের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হবে। এই পরিকল্পনা অবহিত করতে প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক ও পরিবহন নেতারা অর্থমন্ত্রী এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নরের সঙ্গে বৈঠক করেন। গত বছরের মে মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে এই পরিকল্পনা তুলে ধরা হলে তিনি এটি বাস্তবায়নের নির্দেশ দেন। এরপর ২৫ জুলাই মহাখালী বাস টার্মিনালে পরিবহন মালিকেরাও এক সভায় এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সায় দেন। গত নবেম্বর মাসে আনিসুল হক মারা যাওয়ার পর প্রকল্পটি আর এগোয়নি। জানতে চাইলে ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, আমরা মালিকদের পক্ষ থেকে নতুন এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সার্বিক সহযোগিতা করেছিলাম। আমরাও চাই গণপরিবহন ব্যবস্থা একটি শৃঙ্খলার মধ্যে আসুক। কিন্তু নানামুখী জটিলতার কারণে তা হচ্ছে না। তিনি বলেন, মেয়র আনিসুল হকের পরিবহন নিয়ে উদ্যোগটি কবে নাগাদ আলোর মুখ দেখবে তা আমাদের জানা নেই। তবে সরকার চাইলে এ বিষয়ে আমরা প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করতে প্রস্তুত। ঢাকার বাস্তব অবস্থা ॥ গত প্রায় এক যুগে ঢাকার জন্য যত পরিকল্পনা বা সমীক্ষা করা হয়, এর সব কটিই ঢাকার মূল গণপরিবহন হিসেবে বাস-মিনিবাসের কথা উঠে এসেছে। মেট্রোরেল, উড়ালসড়কসহ অন্য প্রকল্প বাস্তবায়নের পরও বাস-মিনিবাসের চাহিদা কমবে না বলে সমীক্ষায় এসেছে। জাইকার সমীক্ষা বলছে, ২০১৪ সালের হিসাবে ঢাকা শহরে যানবাহনে চলাচলকারী যাত্রীদের ৪৭ শতাংশ চলে বাস-মিনিবাসে। ২০২৫ সালে ৫৯ শতাংশ যাত্রী পরিবহন হবে বাস-মিনিবাসে। ২০৩৫ সালে এই সংখ্যা হবে ৫৭ শতাংশ। পরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সামছুল হক বলেন, ঢাকায় বাস চলাচলের অনুমতি দেয়ার পদ্ধতি অবৈজ্ঞানিক। বাস পরিচালনা করা হচ্ছে ভুল পদ্ধতিতে। এ পর্যন্ত হওয়া প্রায় সব গবেষণাতেই বলা হয়েছে, বাসের কোম্পানি হবে কম, অনুমোদন দিতে হবে সড়কের চাহিদা সমীক্ষা করে। এটা নিশ্চিত না করতে পারলে যে যত কথাই বলি, কোন লাভ হবে না। নৌ-সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক আশীষ কুমার দে বলেন, কলকাতা শহরের দিকে যদি তাকাই সেখানে জনসংখ্যা ও পরিবহন কোন দিক থেকেই ঢাকার চেয়ে কম হবে না। সেখানে রাস্তায় এখন যানজট নেই। হর্নের বিকট শব্দও নেই। কারণ সবকিছু শৃঙ্খলার মধ্যে চলছে। স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল পদ্ধতির মধ্য দিয়ে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। কেউ আইনভঙ্গ করলে মামলা দেয়া হচ্ছে। তারা যদি আধুনিক পদ্ধতি অনুসরণ করে সবকিছু বদলে দিতে পারে তাহলে আমরা কেন পারব না। পরিবহন সেক্টরে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে দ্রুত সময়ের মধ্যে বিশেষজ্ঞদের মতামত যাচাই-বাছাই শেষে তা বাস্তবায়নে সরকারের প্রতি অনুরোধ জানান। অব্যাহত সড়ক দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির জন্য গণপরিবহন খাতের বিশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে দায়ী করে সাংবাদিক সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘বাস মালিক সমিতি ও সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের দুই শীর্ষ নেতাই মন্ত্রী। ফলে বাস-ট্রাক মালিক ও শ্রমিকেরা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী। সাধারণ মানুষের সেবা ও নিরাপত্তা নয়, তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য শুধুই মুনাফা অর্জন।’ বাংলাদেশের পরিবহন শ্রমিকেরা পৃথিবীর মধ্যে সব চেয়ে বেশি উচ্ছৃঙ্খল বলেও মন্তব্য করেন তিনি। তিনি বলেন, মালিকদের বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গী আর শ্রমিকদের বেপরোয়া মনোভাবের কারণে সড়ক দুর্ঘটনা কমানো যাচ্ছে না’ সব ধরনের গণপরিবহনে চাঁদাবাজি রোধ এবং বাসের মধ্যে যাত্রীদের কাছ থেকে ভাড়াবাবদ নগদ টাকা নেয়া বন্ধ করে স্টপেজভিত্তিক কাউন্টার থেকে অগ্রিম টিকেট বিক্রির পদ্ধতি চালুর দাবি জানান তিনি।
×