ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

চির তারুণ্যের কবি

প্রকাশিত: ০৭:৫৪, ৮ মে ২০১৮

চির তারুণ্যের কবি

বাংলা সাহিত্যের বিচিত্র আঙ্গিনা যাঁর প্রতিভার আলোকছটায় হয়েছে আলোকিত। যাঁর সাহিত্যসুধা আস্বাদনে পাঠক পেয়েছে পরিপূর্ণ তৃপ্তি। সাহিত্যপরিম-লের প্রতিটি স্তরে যিনি বিচরণ করেছেন সদর্পে। বিশ্ববাসীর সামনে বাংলা সাহিত্যকে তুলে ধরেছেন সগৌরবে। তাঁর লেখনীর প্রতিটি শব্দ যেন জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে তুলির আঁচড়ে বেরিয়ে আসা এক একটি প্রাণ। রচনাজুড়ে তিনি গেয়েছেন তারুণ্যের জয়গান। তিনিই আমাদের বিশ্বকবি, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। চিরসবুজ, চির যৌবনের কবি। জীবনের প্রত্যেকটি ভোর তাঁর কাছে ছিল এক নতুন প্রাণ। জীবনের সকল বেলায়, সকল সময়ে নিজেকে ভেবেছেন তরুণ হিসেবে। ‘পঁচিশে বৈশাখ’ কবিতাটিতে কবি নিজেকে বলেছেন তরুণ বাউল। যা তাঁর কবিতায় প্রকাশ পেয়েছে এভাবে : তরুণ যৌবনের বাউল/সুর বেঁধে নিল আপন একতারাতে,/ডেকে বেড়ালো নিরুদ্দেশ মনের মানুষকে/অনির্দেশ্য বেদনার খেপা সুরে। তাঁর কবিতা যেমন তরুণের চলার ছন্দে হয়েছে ছন্দায়িত। আবার তারুণ্য শক্তির আভায় হয়েছে ঝঙ্কৃত। তিনি তারুন্য কে প্রাধান্য দিয়েছেন সর্বাগ্রে। বিশ্বাস করতেন তারুণ্যের তেজদ্বীপ্ত শক্তি সকল বাঁধা, সকল অপশক্তিকে নিমিষেই ধূলিসাত করে দিতে পারে। সকল ভেদ-বিভেদের উর্ধে তার অবস্থান। নিষেধ আর নিয়মের প্রাচীর ভাঙ্গাই তারুণ্যের ধর্ম। মা, মাটি, দেশই তার ব্রত। সমাজের যত সংস্কার-কুসংস্কার, আর সকল জড়তার উর্ধে তারুণ্যের ঝান্ডা সদা উড্ডীয়মান। তারুণ্য হবে সৎ এবং সততার প্রতীক। সত্য এবং সুন্দরকে গ্রহণের জন্য তরুণ হৃদয় থাকবে সদা উন্মোচিত। তরুণ হবে কৌতূহলী। সৃষ্টিকে জানার ও সত্যানুসন্ধানে সদা চঞ্চল। সুদূরের পিয়াসী। কবি বিশ্বাস করেন তরুণের থাকবে অপার সাহস। যা তাকে সকল কঠিন সময়ে, সম্মুখে ধাবিত করবে। থাকবে দৃঢ় মনোবল। যা তাকে দুঃসময়ে উঠে দাঁড়াতে শক্তি যোগাবে। থাকবে অসীম উৎসাহ। যা তাকে নব সৃষ্টির নেশায় রাখবে জাগ্রত। সে গাইবে মানবতার গান। কবির ‘সবুজের অভিযান’ কবিতাটি তারুণ্যের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। যেখানে কবি নবীনদের জেগে ওঠার কথা তো বলেছেনই একই সাথে যারা পড়ে আছে জরা, আধ-মরা তাদের ঘা মেরে বাঁচিয়ে রাখতে বলেছেন। যা কবিতাটিতে উঠে এসেছে এভাবে : ওরে নবীন, ওরে আমার কাঁচা,/ওরে সবুজ, ওরে অবুঝ,/ আধ-মরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা। এ কবিতাটিতেই তিনি তারুণ্যকে আহ্বান করে উচ্চারণ করেছেন : রক্ত আলোর মদে মাতাল ভোরে/আজকে যে যা বলে বলুক তোরে,/সকল তর্ক হেলায় তুচ্ছ ক’রে/পুচ্ছটি তোর উচ্চে তুলে নাচা।/আয় দুরন্ত, আয় রে আমার কাঁচা ॥ আরো বলেছেন : চিরযুবা তুই যে চিরজীবী/জীর্ণ জরা ঝরিয়ে দিয়ে/প্রাণ অফুরান ছড়িয়ে দেদার দিবি। কবি মনে করেন তরুণেরা সকল জীর্ণ জড়তার জাল ছিন্ন করে ছিনিয়ে আনবে বিজয়। তেপ্পান্ন বছর বয়সে রচিত ‘জ্যোতি’ কবিতায় নবীনের জয়গান গেয়েছেন এভাবে: হে বিজয়ী বীর, নবজীবনের প্রাতে/ নবীন আশার খড়গ তোমার হাতে,/জীর্ণ আবেশ কাটো সুকঠোর ঘাতেÑ/বন্ধন হোক ক্ষয়।/তোমারি হউক জয়। কবির ঋতুভিত্তিক কবিতায় বাংলার প্রত্যেকটি ঋতুর রূপ, মাধুর্য কিংবা প্রলয়ঙ্করী তা-ব, ভাটার টান অথবা জোয়ারের উচ্ছলতা সমস্ত কিছুই পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে প্রকাশিত। যা স্বচ্ছ এবং হৃদয় ছোঁয়া অনুভবের। প্রত্যেকটি ঋতুর বর্ণনায়ও কবি তুলে ধরেছেন তারুণ্য শক্তি, তার চঞ্চলতা। এমনকি উদাহরণ হিসেবেও বেছে নিয়েছেন তারুণ্য ভাবনা, শক্তি, প্রেম। গ্রীষ্মের খড়তাপের প্রচ- তা-বে, বর্ষায় নবধারার নতুন প্রাণের জাগরণে, শরতের সাদা মেঘের ভেলায় উচ্ছলিত আলোর আলোকছটায় আনমনে ভেসে বেড়ানো স্বাধীন দূত কিংবা শীতের ঝরাপাতার ছন্দে নতুন প্রাণের নাচন আর বসন্তের নবপল্লবে আশার সঞ্চার সব কিছুতেই উঠে এসেছে তারুণ্য। উদ্বোধন কবিতায় তিনি বলেছেন : জাগুক মন, কাঁপুক বন, উড়ুক ঝরাপাতাÑ/উঠুক জয়, তোমারি জয়, তোমারি জয়গাথা।/ঋতুর দল নাচিয়া চলে/ভরিয়া ডালি ফুলে ও ফলে,/নৃত্যলোল চরণতলে মুক্তি পায় ধরাÑ/ছন্দে মেতে যৌবনেতে রাঙিয়ে ওঠে জরা ॥ আবার ‘বসন্ত’ কবিতাটিতে বলেছেন : উত্তপ্ত যৌবনমোহ রক্তরৌদ্রে রহিল রঞ্জিত/চৈত্রসন্ধ্যাকাশে ॥ ১৩০৫ সালের ৩০ চৈত্র। কবিগুরুর ৩৭ বছর বয়সে রচিত ‘বর্ষশেষ’ কবিতায় তিনি বলেছেন : হে দুর্দম, হে নিশ্চিত, হে নূতন, নিষ্ঠুর নূতন,/সহজপ্রবল,/জীর্ণ পুষ্পদল যথা ধ্বংস ভ্রংশ করি চতুর্দিকে/বাহিরায় ফল /পুরাতন পর্ণপুট দীর্ঘ করি বিকীর্ণ করিয়া/অপূর্ব আকারে,/তেমনি সবলে তুমি পরিপূর্ণ হয়েছ প্রকাশÑ/প্রণমি তোমারে ॥ পরিবর্তনের ধারায় বিশ্বাসী কবি নূতনের হাতে তুলে দিতে চেয়েছেন কর্মভার। ‘অশেষ’ কবিতায় তিনি বলেছেন : নবীন প্রভাত লাগি দীর্ঘরাত্রি রব জাগি,/দীপ নিবিবে না।/কর্মভার নবপ্রাতে নবসেবকের হাতে/ করি যাব দানÑ/মোর শেষ কন্ঠস্বরে যাইব ঘোষণা করে/তোমার অহ্বান ॥ কবি নূতনের সাথে পাতিয়েছেন মিতালী। খেলেছেন একই কুসুম কাননে। যা তাঁর ‘নুতন’ কবিতায় প্রকাশ পেয়েছে এভাবে : আয় রে নূতন, আয়, সঙ্গে করে নিয়ে আয়/তোর সুখ তোর হাসি গান।/ফোটা নব ফুলচয়, ওঠা নব কিশলয়,/নবীন বসন্ত আয় নিয়ে। আবার ‘পুরাতন’ কবিতাটির শুরুতেই তিনি পুরাতনেরে বিদায় করেছেন সহসায়। কবিতাটির শুরুতে তিনি নিজেই বলেছেন : হেথা হতে যাও পুরাতন,/হেথায় নূতন খেলা আরম্ভ হয়েছে। বয়সের ফ্রেমে কখনই আটকে থাকেনি কবির তারুণ্য। প্রতিনিয়ত তিনি জেগে উঠেছেন নব সৃষ্টির আশায়। তাঁর ‘কবির বয়স’ কবিতাটিতে নিজেকে প্রকাশ করেছেন এভাবে : কেশে আমার পাক ধরেছে বটে,/তাহার পানে নজর এত কেন?/পাড়ায় যত ছেলে এবং বুড়ো/সবার আমি একবয়সি জেনো।/ওষ্ঠে কারো সরল সাদা হাসি/কারো হাসি আঁখির কোণে কোণে,/কারো অশ্রু উছলে পড়ে যায়/কারো অশ্রু শুকায় মনে মনে,/ কেউ-বা থাকে ঘরের কোণে দোঁহে/জগৎ-মাঝে কেউ-বা হাঁকায় রথ,/কেউ-বা মরে একলা ঘরের শোকে/জনারণ্যে কেউ-বা হারায় পথÑ/সবাই মোরে করেন ডাকাডাকি,/কখন্ শুনি পরকালের ডাক?/সবার আমি সমানবয়সি যে/চুলে আমার যত ধরুক পাক ॥ তারুণ্যের সাহস কে সদা জাগ্রত রাখতে, যুদ্ধে, সমরে অকুতোভয় তরুণকে এগিয়ে নিতে কবি তাঁর ‘সুপ্রভাত’ কবিতায় বলেছেন : উদয়ের পথে শুনি কার বাণী,/‘ভয় নাই, ওরে ভয় নাইÑ/নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান/ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই।’ তারণ্যের, যৌবনের শক্তি মৃত্যুকে করে জয়। সত্যকে প্রতিষ্ঠায় সে নির্ভীক। তাই তো কবিগুরু সত্য, সুন্দরকে ভালোবেসে সারাটি জীবন ধারন করেছেন তারুণ্য। নূতনেরে গ্রহণ করেছেন সানন্দে। নূতনকে জানা, আর তারই ছন্দে তাল মিলিয়ে চলার শক্তি সঞ্চয় করেছেন বারবার। পঁচাত্তর বছর বয়সে রচিত ‘পরিচয়’ কবিতায় তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন : ভাঁটার গভীর টানে/তরীখানা ভেসে যায় সমুদ্রের পানে।/নূতন কালের নব যাত্রী ছেলেমেয়ে/ শুধাইছে দূর হতে চেয়ে,/‘সন্ধ্যার তারার দিকে/বহিয়া চলেছে তরণী কে?’/সেতারেতে বাঁধিলাম তার,/গাহিলাম আরবার,/‘মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক,/আমি তোমাদেরই লোক,/আর কিছু নয়Ñ/এই হোক শেষ পরিচয়।’ এ কারণেই তিনি চিরনূতনের, চিরকালের চিরসুন্দর।
×