ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

স্বপ্ন ছুঁয়ে শরীফ আহমেদ

প্রকাশিত: ০৭:৫৩, ৮ মে ২০১৮

স্বপ্ন ছুঁয়ে শরীফ আহমেদ

মানুষ মাত্রই স্বপ্ন দেখে। কিন্তু বাস্তবের জমিনে দাঁড়িয়ে সে স্বপ্নকে ছুঁয়ে দিতে পারে ক’জন? ক’জন পারে স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে? আর এই রূপ দেয়া যদি হয় তারুণ্যে, তবে তো কথাই নেই। শরীফ আহমেদ। উচ্চ শিক্ষার শুরুতে স্বপ্ন ছিল বিশ্বে ‘বিগ ফোর’ বলে পরিচিত কোম্পানিগুলোর একটিতে কাজ করার। শিক্ষা জীবন শেষে বিভিন্ন ধাপ পেরিয়ে এ মুহূর্তে কর্মরত ওয়ার্ল্ড বিগেস্ট প্রফেশনাল সার্ভিসেস ফার্ম প্রাইসওয়াটারহাউস কুপারসে। তাদের হয়ে কাজ করছেন ক্যাম্পাস রিক্রুটমেন্ট টিমে। শরীফ আহমেদের পথ চলার গল্প জানাচ্ছেন- আকিল জামান ইনু ডিপ্রজন্ম : শরীফ আহমেদ, কেমন আছেন শরীফ আহমেদ : ভাল আছি, আপনি... ডিপ্রজন্ম : ভাল, আপনার জন্ম, বড় হওয়া, বেড়ে ওঠার গল্পটা। শরীফ আহমেদ : আমার জন্ম ঢাকার ওয়ারীতে। এই শহরে বড় হওয়া। শিক্ষা জীবন গবর্নমেন্ট মুসলিম হাই স্কুল, নটর ডেম কলেজ হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বিবিএ (ফিন্যান্স) পরবর্তীতে এমবিএ (এ্যাকাউন্টিং)। এখন চাকরীর পাশাপাশি সিপিএ ক্যান্ডিডেট ডিপ্রজন্ম : কর্মজীনের শুরু। শরীফ আহমেদ : বিবিএ শেষে ২০০৫-এ আমি যোগ দেই আইডিএলসিতে। পরের বছর গ্রামীণ ফোন। সেখানে দুই বছর কাজ করা। ২০০৮-এ শেভরন বাংলাদেশে যোগ দেই। ২০১৩তে কানাডা পাড়ি দেয়া। ডিপ্রজন্ম : কানাডায় আপনার শুরু ও সেখান থেকে আপনার স্বপ্ন ‘বিগফোর’-এর একটিতে যোগ দেয়ার গল্পটা... শরীফ আহমেদ : কানাডায় আমার প্রথম জব নর্দান ক্রেনে, ফাইন্যান্স টিম লিড। সিএ করার ইচ্ছে ছিল। পাখির চোখে তাকিয়ে ছিলেম বিগফোর বলে পরিচিত কোম্পানিগুলোর একটিতে সুযোগ করে নেয়ার জন্য। এভাবেই সুযোগ হয় ওয়ার্ল্ড বিগেস্ট প্রফেশনাল সার্ভিসেস ফার্ম পিডব্লিউসি বা প্রাইসওয়াটারহাউসকুপারসে। কর্মী বাছাই করার জন্য ওদের কিছু নির্দিষ্ট পদ্ধতি আছে। যাচাইয়ের ক্ষেত্রেও কিছু বিষয় নেয়া হয় বিবেচনায়। ওদের বাছাই প্রক্রিয়ার শুরুটা নেটওয়ার্কিং ইভেন্ট আয়োজনের মাধ্যমে। আগ্রহীদের ডাকে কথা বলার জন্য। চার পর্বের সাক্ষাতকার পেরিয়ে আমার সেখানে যোগ দেয়া। একটা বিষয় কিন্তু খুব মজার, সেটা হলো; ওরা কোন টেকনিক্যাল প্রশ্ন করে না। ডিপ্রজন্ম : দেশে আপনি কোন্ সংগঠনের সাথে জড়িত ছিলেন কি? শরীফ আহমেদ : হ্যাঁ, আমি নটর ডেম কলেজে বিজনেস ক্লাবে সক্রিয় ছিলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লিও ক্লাবের হয়ে কাজ করেছি। এ ছাড়াও রক্তদান কর্মসূচীতে সক্রিয় ছিলাম। ডি প্রজন্ম : রাজনৈতিক কোন সংগঠন? আর প্রসঙ্গক্রমে জানতে চাইছি আপনি কি ছাত্র রাজনীতির পক্ষপাতি? উন্নত বিশ্বের সঙ্গে আমাদের ছাত্র রাজনীতির পার্থক্য... ডিপ্রজন্ম : না আমি ছাত্রজীবনে কোন ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলাম না। ছাত্র রাজনীতি যদি সুস্থ ধারার হয় তবে বিরোধিতার কোন কারণ দেখি না। আমি সবসময়ই ছাত্র রাজনীতির অতীত গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকার কথা বলি। উন্নত বিশ্বের কথা যদি বলি, যেমন কানাডা, ওখানে একজন ভোটারের রাজনৈতিক মত থাকতেই পারে। তবে ছাত্র হিসেবে দলীয় রাজনীতির সুযোগ সেভাবে দেখিনি। বরং বিষয়টা অনেক সিস্টেমেটিক। ওরা লিডারশিপটা গড়ে তোলে স্কুল পর্যায় থেকে। ধরুন ক্লাস ফোরের একটা বাচ্চা ওয়ানের বাচ্চার বিগ ব্রাদার হয়। ওরা বলে, ‘বিগ বাডি’। স্কুলের সামনে ট্রাফিক কন্ট্রোলেও বাচ্চারা অংশ নেয় শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে। এভাবেই ওদের মধ্যে নেতৃত্ব আর সামাজিক দায়বদ্ধতার বোধটা গড়ে ওঠে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে আছে স্টুডেন্ট কাউন্সিল, তবে তারা কোন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত নয়। ডিপ্রজন্ম : দেশে আপনার প্রতিষ্ঠাকে ছোট করে দেখার উপায় নেই তার পরও বিদেশে কেন। শরীফ আহমেদ : কর্মজীবন শুরু করে স্বল্প সময়ে আমার যেটুকু অর্জন ছিল সে জন্য আমি স্রষ্টার কাছে কৃতজ্ঞ। তার পরও বিদেশ পাড়ি দেয়ার মূল কারণ ছিল পড়াশোনা। আমি সব সময়ই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কাজ করতে চেয়েছি। আরেকটি বিষয় আমি নতুন চ্যালেঞ্জ ভালবাসি। হয়ত সেটাও একটা কারণ। ডিপ্রজন্ম : উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের ফিন্যান্সিয়াল ব্যবস্থাপনার পার্থক্য... শরীফ আহমেদ : খুব সংক্ষেপে বলি, দীর্ঘদিনের প্রাতিষ্ঠানিক চর্চার ফলে উন্নত বিশ্বে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত। যে কারণে প্রতিটি বিষয় স্বচ্ছ। আমরাও সে পথে এগুচ্ছি, নিজেদের স্বার্থেই আমাদের সে পর্যায়ে পৌঁছতে হবে, নিশ্চিত করতে হবে সুশাসন। ডিপ্রজন্ম : আমাদের ফিন্যান্সিয়াল সেক্টরে কোন্ বিষয়গুলোতে প্রাধান্য দেবেন। শরীফ আহমেদ : মানব সম্পদ উন্নয়ন। সেরা ছেলেমেয়েদের আসতে হবে আরও বেশি করে। উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন ভাল দিকগুলো নিতে হবে। প্রফেশনাল ডেসিগনেশনে আগ্রহ খুব জরুরী। যেমন- সিএ, সিএমএ, সিএফএÑ এই তিনটি বিষয়ে মেধাবীদের আরও বেশি আসা উচিত। ডিপ্রজন্ম : সেক্ষেত্রে মানসম্মত প্রতিষ্ঠানের একটা বিষয় কিন্তু আছে। তা কি যথেষ্ট আছে আমাদের। শরীফ আহমেদ : এই পর্যায়ে আমি বলব হ্যাঁ, যথেষ্ট আছে। এ বিষয়ে আরেকটি কথা আমি যোগ করতে চাই। প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি আমরা যারা প্রাক্তন ছাত্রছাত্রী এবং শিক্ষকদেরও ব্যক্তিগত ভূমিকা রাখতে হবে। ডিপ্রজন্ম : আমাদের তরুণ প্রজন্মের অনেকেই বাইরে লেখাপড়া বা কাজের চ্যালেঞ্জ নিতে চায় তাদের জন্য কি বলবেন। শরীফ আহমেদ : প্রথমেই বলব তার একটা স্বচ্ছ ধারণা থাকতে হবে সে কি করতে চায়। সেভাবেই বিষয় নির্বাচন করতে হবে। ভাষাগত দক্ষতা আবশ্যক। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার বাইরে এক্সট্রা ক্যারিকুলার একটিভিটিস তাকে অনেক সাহায্য করবে। আর কানাডার ক্ষেত্রে পার্মানেন্ট রেসিডেন্ট হয়ে গেলে পড়ার খরচ অর্ধেকেরও কমে আসবে। অনেকেই ভাবেন পার্মানেন্ট রেসিডেন্ট হওয়াটা বুঝি খুব কঠিন। বিষয়টি মোটেই তেমন নয়। আইইএলটিএস-এ ভাল স্কোর সঙ্গে ২/৩ বছরের অভিজ্ঞতা সে জন্য যথেষ্ট। নতুনদের বেলায় ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট ক্যাটাগরি। ডিপ্রজন্ম : আপনি নিজে রিক্রুটমেন্ট টিমে আছেন, যে বিষয়গুলো দেখেন... শরীফ আহমেদ : প্রথম কথা। যে কাজটি সে করতে চাচ্ছে তার প্রতি ভালবাসা এবং প্রার্থীর মনোবল। যত যোগ্যতাই থাকুক তাকে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজটি সম্পন্ন করতে হবে, পরিস্থিতি যাই হোক না কেন। এই ইন্ডাস্ট্রিতে সবকিছুই টিম ওয়ার্ক, প্রার্থীর সেই মানসিকতা থাকতে হবে। প্রার্থীর শেখার আগ্রহ, লিডারশিপ স্কিলও আমরা বিবেচনায় নেই। আমাদের পেশা অনেক গতিশীল। এই গতির সঙ্গে যারা সমান তালে চলতে পারবে বাছাইয়ে তাদের প্রাধান্য দেয়া হয়। আমি নিজে ক্যাম্পাস রিক্রুটমেন্ট কমিটিতে আছি। খুব সংক্ষেপে বলি আমরা দেখি প্যাশন, মাইান্ড সেট, লিডারশিপ স্কিল, কমিউনিকেশন উইথ ইমফ্যাক্ট। আরেকটি বিষয় বলি এক্ষেত্রে অনলাইন প্রেজেন্সটা খুব গুরুত্বপূর্ণ বিশেষ করে লিঙ্কডইন প্রোফাইল। ডিপ্রজন্ম : আপনি যেহেতু ফিন্যান্সিয়াল সেক্টরে আছেন সম্পদের সুষম বণ্টন নিয়ে আপনার ধারণা... শরীফ আহমেদ : এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা আরও ভাল বলতে পারবেন। আমার মতে, সত্যি বলতে কিÑ সম্পদের সুষম বণ্টন বিষয়টি বলতে যত সুন্দর শোনায় এর বাস্তবায়ন ততটাই কঠিন। আজ বিশ্ব জুড়ে মুষ্টিমেয় মানুষের হাতে কেন্দ্রীভূত সম্পদ একটি বড় সমস্যা বলেই গণ্য হচ্ছে। একে রোধ করা কতটা সম্ভব প্রশ্ন সেটাও। তার পরও প্রান্তিক মানুষগুলোর জীবনমান উন্নয়নের চেষ্টা আমরা করতে পারি। ডিপ্রজন্ম : কেমন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেন, আপনি তো এ মুহূর্তে প্রবাসে আছেন দেশ নিয়ে ভাবনা... শরীফ আহমেদ : দেখুন প্রবাসে থাকলেও বাংলাদেশ আমার হৃদয় জুড়ে। দেশের প্রয়োজনে আমার সাধ্যমতো সাড়া দিতে আমি সবসময়ই প্রস্তুত। আমার নিজের সেক্টরে দেশে কিছু করার ইচ্ছা আমার আছে। প্রবাসে থাকলেও শেকড় বিচ্ছিন্ন নই। বাংলাদেশ নিয়ে আমার স্বপ্ন, আমি এক ক্ষুধা ও দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ চাই। যেমন আমি দেখতে চাই ক্ষুধা ও যুদ্ধমুক্ত এক পৃথিবী। ডিপ্রজন্ম : আপনার শখ, পছন্দের বিষয়, প্রিয় লেখক... শরীফ আহমেদ : আমি এক কথায় ফুটবল ফ্যানাটিক। ক্লাব ফুটবলে দেশে মোহামেডান বিদেশ চেলসি আর আন্তর্জাতিক ফুটবলে ব্রাজিলের সমর্থক। ফুটবল সংক্রান্ত যে কোন নিউজ, ফিচার, আমি নিয়মিত পড়ি। আমাকে ক্রেজি ট্র্যাভেলরও বলতে পারেন। সময় পেলেই বেড়িয়ে পড়ি ভ্রমণে। আমি গান শুনি, প্রিয় গায়ক জেমস, কিশোর কুমার। এ মুহূর্তে সিপিএ ক্যান্ডিডেট হিসেবে পড়াশোনা বিষয়ভিত্তিক। তবে কোন ব্যস্ততার অজুহাতে আমি রকিব হাসানের তিন গোয়েন্দা পড়া বাদ দিতে রাজি নই। আমি এখনও নিজেকে কিশোর, মুসা, রবিনে হারিয়ে ফেলি। ডিপ্রজন্ম : আমাদের তরুণদের জন্য... শরীফ আহমেদ : আমি বলতে চাই আমাদের সবচেয়ে বড় সম্পদ মানব সম্পদ। এদিক থেকে আমরা অনেক উন্নত দেশের চেয়ে এগিয়ে। এই মানব সম্পদ, যার সংখ্যাগরিষ্ঠ তরুণ, তাদের পরিকল্পিতভাবে কাজে লাগাতে হবে। তাকিয়ে দেখুন মানব সম্পদ ব্যবহার করে চায়না কতটা এগিয়ে গেছে। আমাদের কেবল পুঁথিগত শিক্ষায় আবদ্ধ থাকলে হবে না। পাশাপাশি নৈতিক শিক্ষার মান আরও উন্নত করতে হবে। আমাদের অনেকে খুব সহজেই সাফল্য স্পর্শ করতে চাই। কিন্তু সাফল্যের কোন সংক্ষিপ্ত রাস্তা নেই। পেলেও তা ক্ষণস্থায়ী। সাফল্যের পথে বিকল্প নেই পরিশ্রমের। ডিপ্রজন্ম : শরীফ আহমেদ আপনাকে ধন্যবাদ, ভাল লাগল কথা বলে। শরীফ আহমেদ : আপনাকেও ধন্যবাদ। জনকণ্ঠের সবার জন্য রইল শুভেচ্ছা। সবাই ভাল থাকবেন।
×