ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

নেত্রকোনায় ধান কাটা শেষ

প্রকাশিত: ০৬:২৯, ৮ মে ২০১৮

নেত্রকোনায় ধান কাটা শেষ

সঞ্জয় সরকার, নেত্রকোনা ॥ কখনও মেঘ, কখনও বৃষ্টি। মাঝে মাঝে বাউরি বাতাস। বিদ্যুত চমকিত আকাশের গর্জন। হাওড়াঞ্চলে বৈশাখের এমন বৈরী প্রকৃতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছে বোরো ফসল তোলার মহোৎসব। কৃষক-শ্রমিক, নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ-যুবা, শিশু-কিশোর বা কিশোরীÑকেউ বসে নেই। একটু দম ফেলারও যেন ফুসরত নেই কারও। পুরুষ কৃষক ও শ্রমিকরা দল বেঁধে ধান কাটছেন। মাড়াই দিচ্ছেন। বস্তায় ভরে বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছেন। আর নারী-শিশু, কিশোর-কিশোরীরা তা বাতাসে উড়িয়ে পরিষ্কার করছেন, সেদ্ধ করে রোদে শুকাচ্ছেন। এভাবেই বিশাল কর্মযজ্ঞের মধ্য দিয়ে কৃষকের গোলায় ওঠছে সোনার ধান। নেত্রকোনার হাওড়াঞ্চল তো বটেই, দশ উপজেলার উঁচু এলাকার যে কোন গ্রামে গেলেও এখন দেখা মিলবে এমন চোখ জুড়ানো দৃশ্য। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, এবার নেত্রকোনার দশ উপজেলায় বোরো আবাদ হয়েছিল ১ লাখ ৮৪ হাজার ৯শ ৩০ হেক্টর জমিতে। এর মধ্যে পাঁচ উপজেলার (খালিয়াজুরি, মোহনগঞ্জ, মদন, আটপাড়া ও কলমাকান্দা) হাওড়াঞ্চলে রয়েছে প্রায় ৪১ হাজার ১০ হেক্টর জমি। হাওড়ের এসব জমির শতকরা ৯৮ ভাগ ধান কাটা হয়ে গেছে। বাকি জমিও দু-তিন দিনের মধ্যে কাটা শেষ হয়ে যাবে। আর উঁচু এলাকায় কাটা হয়েছে শতকরা ৫৮ ভাগ জমি। বাকি জমি কাটতে সর্বোচ্চ আরও দু’সপ্তাহ লাগতে পারে। উঁচু এলাকার এসব জমি পাহাড়ী ঢলের কবলে পড়ার কোন আশঙ্কা নেই। তবে কিছু কিছু এলাকায় শ্রমিক সঙ্কট মোকাবেলা করতে হচ্ছে। ধান পাকলেও কাটার অপেক্ষায় থাকতে হয়েছে। পর্যাপ্ত শ্রমিকের অভাবে দৈনিক ৭-৮ শ’ টাকা মজুরি দিয়েও ধান কাটাতে হয়েছে অনেকের। এদিকে যেসব এলাকায় ধান কাটা শেষ হয়েছেÑ সেসব এলাকায় মাড়াই, বাছাই এবং শুকানোর কাজ সম্পূর্ণ শেষ হয়নি এখনও। গত কয়েক দিনের বৃষ্টিপাতে মাড়াই, বাছাই এবং শুকানো কিছুটা বিলম্বিত হয়েছে। খালিয়াজুরির পুরানহাটি গ্রামের কৃষক রাসেল মিয়া জানান, এ বছর তিনি সাড়ে ৯ একর (৯৫ কাঠা) জমি আবাদ করেন। এরই মধ্যে শতভাগ জমির ধান কাটা হয়ে গেছে তার। কিন্তু গত কয়েকদিনের বৃষ্টির কারণে ধান মাড়াই এবং শুকানোর কাজ বিলম্বিত হয়। রাসেল মিয়া জানান, ঠিকমতো রোদ থাকলে সপ্তাহখানেকের মধ্যে তার ‘দাওয়া-মারি’ শেষ হবে। ধানের ফলনেও বেশ খুশি তিনি। এদিকে উৎপাদন ভাল হলেও ধানের দাম নিয়ে খুব একটা খুশিতে নেই কৃষক। রাসেল মিয়া এবং খালিয়াজুরির বলরামপুর গ্রামের শেকুল মিয়া ও মোহগঞ্জের জৈনপুর এলাকার লিটন মিয়াসহ কয়েক কৃষক জানান, সরকারীভাবে ধান সংগ্রহ অভিযান শুরু না হওয়ায় ধানের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছেন ফড়িয়া ব্যবসায়ী ও দালালরা। তারা হাওড় থেকেই সরাসরি ধান কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। প্রকারভেদে কাঁচা ধান বিক্রি হচ্ছে ৫শ ৮০ থেকে ৬শ ৫০ টাকা মণ দরে। কৃষকরা জানান, কাঁচা ধানের দর ৭শ’ টাকার কম হলে খুব একটা পোষাবে না তাদের। বড় কৃষকরা কিছু ধান মজুদ করতে পারলেও প্রান্তিক ও মাঝারি কৃষকদের ধান মজুদের সুযোগ কম। কারণ, অনেকের ঘরে ধান মজুদ করার মতো পর্যাপ্ত জায়গা নেই। এ কারণে নিরুপায়েই অপেক্ষাকৃত কম দামে ধান বেচতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। জানা গেছে, এবার সরকারীভাবে ধানের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে মণ প্রতি ১ হাজার ৪০ টাকা। কৃষকরা বলেন, দ্রুত সময়ের মধ্যে সরকারী ধান কেনা শুরু হলে বাজার কিছুটা চড়বে। এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে হাওড় জনপদ খালিয়াজুরি উপজেলার খাদ্য গুদামের কর্মকর্তা আক্কাছ আলী জানান, ধান কেনার বরাদ্দ ও নির্দেশনা এখনও পাননি তিনি। তবে জেলা প্রশাসক মঈনউল ইসলাম রবিবার দুপুরে জনকণ্ঠকে জানান, খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে এ জেলায় সংগ্রহ অভিযান শুরুর চেষ্টা চলছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের স্থানীয় উপ-পরিচালক বিলাস চন্দ্র পাল জানান, এবার জেলার দশ উপজেলায় ১০ লাখ ৮৭ হাজার ৫শ ৫৫ মেট্রিক টন ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হলেও উৎপাদন অনেক বেশী হবে। খালিয়াজুরির কৃষি কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম বলেন, এবার প্রতি একরে (১০ কাঠা) বিআর-২৮ জাতের ধান ৬০-৬৫ মণ, বিআর-২৯ ধান ৭০-৭৫ মণ এবং উচ্চ ফলনশীল ধান ৭৫-৮০ মণ উৎপাদন হয়েছে। খালিয়াজুরি ছাড়াও কলমাকান্দা, মদন এবং মোহনগঞ্জের কৃষি কর্মকর্তারা জনকণ্ঠকে জানান, এবার প্রত্যেকটি এলাকায় রেকর্ড পরিমাণ ধান হয়েছে। মৌসুমের শুরু থেকেই আবহাওয়া অনুকূলে ছিল। সার ও বীজের কখনও ঘাটতি হয়নি। মাঝে মাঝে বৃষ্টি হওয়ায় সেচ কম লেগেছে। এতে কৃষকদের উৎপাদন খরচও কমেছে। কিছু কিছু এলাকায় নেক ব্লাস্ট রোগ দেখা দিলেও তা ফলন ব্যাহত করতে পারেনি। এদিকে ধান কাটার মৌসুম শেষ হতে চললেও পাহাড়ী ঢলের দেখা দেয়নি এখনও। ভাঙেনি কোন বাঁধও। তাই সব মিলিয়ে বাম্পার ফলন যাকে বলেÑ তাই হয়েছে এবার। কিন্তু গেল বছরের পাহাড়ী ঢল ও অকালবন্যা হাওড়ের কৃষকদের স্বপ্ন-আকাক্সক্ষা চুরমার করে দিয়েছিল। বাগেরহাট স্টাফ রিপোর্টার বাগেরহাট থেকে জানান, বাগেরহাটে পাকা ধান নিয়ে বিপাকে পড়েছেন কৃষকেরা। দেড় মন ধানের বিনিময়েও মিলছে না একজন ধান কাটার মজুর (কামলা)। গত কয়েক দিনের ঝড়-বৃষ্টির কারণে এ সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে। ফলে ক্ষেতেই নষ্ট হচ্ছে শত শত মণ পাকা ধান। জেলার চিতলমারী উপজেলার ৭টি ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে জানা গেছে, কৃষি অধ্যুষিত এ অঞ্চলে এ বছর যেমন রোগ-বালাই কম ছিল। তেমনি ছিল না কোন পোকার উপদ্রব। তাই আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এ বছর বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। আর এ ফলন ঘরে তুলতে পারলে ধান বিক্রি করে মিটবে তাদের ধার-দেনা। সেজন্য প্রায় প্রত্যেক কৃষক পরিবারে সদস্যরা কাকডাকা ভোর থেকেই ধান কাটার কাজ শুরু করেন। বসে নেই পরিবারের মেয়ে-গৃহবধূ ও ছোট্ট শিশুরাও। সবাই কাজে ব্যস্ত, একটুকু ফুসরত নেই কারও। একই চিত্র গোটা বাগেরহাট জেলার। চিতলমারী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ঋতুরাজ সরকার জানিয়েছেন, এ বছর উপজেলার ৭টি ইউনিয়নে মোট ব্লকের সংখ্যা ২১টি। এরমধ্যে বড়বাড়িয়া ব্লকে এক হাজার ৯০১ একর, হাড়িয়ারঘোপ ৯২৬ একর, মাছুয়ারকু এক হাজার ৮৭৭ একর, কলাতলা এক হাজার ৩৫৮ একর, রহমতপুর এক হাজার ২৯৬ একর, শৈলদহ এক হাজার ৩০৯ একর, হিজলা এক হাজার ৯৯ একর, কুড়ালতলা এক হাজার ৩৩৩ একর, শান্তিপুর এক হাজার ১৯৭ একর, শিবপুর ৬১৭ একর, বড়বাক ৬১৭ একর, চিতলমারী দুই হাজার ৭৪ একর, শ্রীরামপুর ৩ হাজার ৩০৯ একর, রায়গ্রাম ৩ হাজার ৮০৩ একর, চরবানিয়ারী ৯৮৮ একর, খড়মখালী এক হাজার ১১১ একর, চরডাকাতিয়া ৯২৬ একর, সন্তোষপুর ৭৯০ একর, দড়িউমাজুড়ি এক হাজার ২২২ একর ও কচুড়িয়া ব্লকে ৯৬৩ একর মোট ২৯ হাজার ৪৩০ একর জমিতে বোরো ধানের চাষ করা হয়েছে। তার মধ্যে ২৮ হাজার ৬৬০ একর জমিতে হাইব্রিড, উফশী ৬৫২ ও স্থানীয় জাতের ধান ১১৮ একর জমিতে চাষাবাদ হয়েছে। যা বিগত বছরগুলোর তুলনায় ১৩৫.৮৫ একর বেশি। আর প্রতিটি ক্ষেতেই এ বছর বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। এ ফলন ঠিকমতো ঘরে তুলতে পারলেও নায্যমূল্য পেলে অবশ্যই কৃষক লাভবান হবেন।
×