ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অভিমত শিক্ষাবিদ ও বিশেষজ্ঞদের

ইংরেজী ও গণিতে দক্ষ শিক্ষক সঙ্কটই ফল বিপর্যয়ের মূল কারণ

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ৮ মে ২০১৮

ইংরেজী ও গণিতে দক্ষ শিক্ষক সঙ্কটই ফল বিপর্যয়ের মূল কারণ

বিভাষ বাড়ৈ ॥ এবারের মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলেও প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে ইংরেজী ও গণিত। অধিকাংশ শিক্ষা বোর্ডেই এবার এ দুটি পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের পাসের হার কমে যাওয়ায় কমেছে মোট পাসের হারও। শিক্ষাবিদসহ সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যে বছর গণিত ও ইংরেজীতে শিক্ষার্থীরা ভাল করছে সে বছর মোট পাসের হারও বেড়েছে। খারাপ করলে কমে যাচ্ছে পাসের হার। মূলত দুটি কারণে ইংরেজী ও গণিতে খারাপ ফল-এমন মন্তব্য করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ দুটি বিষয়ে খারাপ ফলের জন্য সারাদেশে বিশেষত মফস্বল এলাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দক্ষ ও যোগ্য বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকের অভাবই দায়ী। খাতার সঠিক মূল্যায়নে নতুন পদ্ধতির প্রয়োগও একটি বড় কারণ। শিক্ষাবিদ, শিক্ষক ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইংরেজী ও গণিতে খারাপ ফলে একটি নেতিবাচক হলেও আরেকটি কারণ ইতিবাচক। সারাদেশের ইংরেজী ও গণিতের যোগ্য শিক্ষকের অভাব যেমন একটি সঙ্কট তেমনি আগের মতো খাতা মূল্যায়নে উদারতা না থাকার বিষয়টি দেশের শিক্ষার জন্য ইতিবাচক। দীর্ঘদিন ধরে খাতা দেখার ক্ষেত্রে উদার হওয়ার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা বোর্ডের একটি অলিখিত নির্দেশনা ছিল। এর ফলে পাসের হার পাল্লা দিয়ে বেড়েছে। যার প্রভাব ছিল ইংরেজী ও গণিতেও। সঠিকভাবে খাতা মূল্যায়ন না হওয়ায় এ দুটি বিষয়েও পাসের হার চলে যায় শতভাগের কাছে। কিন্তু গত বছর খাতার সঠিক মূল্যায়নে নতুন পদ্ধতির প্রয়োগের ফলে মোট পাসের হার যেমন কমেছে তেমনি সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়েছে ইংরেজী ও গণিতে। গত বছর আগের তুলনায় কঠোর সঠিক খাতা মূল্যায়নের প্রথম বছর তার আগের বছরের তুলনায় পাসের হার কমেছিল প্রায় ৮ শতাংশ। জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যাও কমে যায় পাঁচ হাজার। এবার ১০ শিক্ষা বোর্ডে পাসের হার কমেছে ২ শতাংশ। পাসের হার কমার পরিমাণ সামান্য হলেও শিক্ষা বোর্ডগুলোর দেয়া তথ্য বলছে, ২ শতাংশ পাসের হার কমার কারণ এবারও ইংরেজী ও গণিত। যদিও অন্তত চারটি শিক্ষা বোর্ডের শিক্ষার্থীরা ইংরেজী ও গণিতে গত বছরের শিক্ষার্থীদের তুলনায় এবার ভাল করেছে। খোদ শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদও আগের খাতা মূল্যায়ন নিয়ে হতাশার কথা শোনালেন। তিনি বলেছেন, আগের অনেক সময়ে খাতা না দেখে নম্বর দেয়ার কথা উঠেছে। হয়েছেও এমন। খাতা দেখার অতীতের যে ত্রুটি ছিল, সেগুলো কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা নেয়ায় একটা মান আমরা অর্জন করেছি। তবে আরও উন্নত করতে হবে এতে কোন সন্দেহ নেই। খাতার সঠিক মূল্যায়নের কারণে ফল সামান্য খারাপ হয়েছে উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, আসলে ইতিবাচক দিক হলো পাসের হার কমেছে। আমরা মূল্যায়নের ক্ষেত্রে পরিবর্তন এনেছি। মূল্যায়নে সমতা আনার জন্য এই পরিবর্তন। শিক্ষকরা যাতে ভাল করে খাতা দেখেন, ভাল করে না দেখেই যেন নম্বর না দেন। সেদিক থেকে ভাল করে খাতা দেখার ফলে পাসের হার কমেছে। গতবারও পাসের হার কমেছে, এবারও পাসের হার কমেছে। তবে দেখা দরকার মূল্যায়নটা সঠিক হয় কিনা। ফলের পরিসংখ্যান বলছে, এবারও ইংরেজী ও গণিত বিষয়ে খারাপ করেছে শিক্ষার্থীরা। যদিও খারাপের পরিমাণ খুবই সামান্য। এ কারণে সিলেট ও দিনাজপুর, চট্টগ্রাম বোর্ড ফলে সামান্য পিছিয়ে পড়েছে। দেখা গেছে, ইংরেজী ও গণিত পরীক্ষার ফল খারাপ হওয়ায় সিলেট বোর্ড পিছিয়ে গেছে সবচেয়ে বেশি। সিলেট বোর্ডে ইংরেজী বিষয়ে পাসের হার ৯০ দশমিক ৪৫ শতাংশ। যা গত বছর ছিল ৯৫ দশমিক ২৬ শতাংশ। গণিত এ বোর্ডের পাসের হার ৭৬ দশমিক ৬১ শতাংশ, যা গত বছর ছিল ৯১ দশমিক ১৯ শতাংশ। সিলেট বোর্ডে মোট পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ১ লাখ ৮৯ হাজার ২৮। জিপিএ-৫ পেয়েছে ৩ হাজার ১৯১ শিক্ষার্থী। এ বোর্ডে পাসের হার সর্বনি¤œ ৭০.৪২ শতাংশ। দিনাজপুর বোর্ড পিছিয়ে পড়ার কারণ গণিত ও ইংরেজী বিষয়ের খারাপ ফল। গণিতে পাসের হার ৮৫ দশমিক ৪৬ শতাংশ, যা গত বছর ছিল ৯১ দশমিক ২০ শতাংশ। ইংরেজীতে পাসের হার ৯১ দশমিক ০৫ শতাংশ, যা গত বছর ছিল ৯৩ দশমিক ৮৬ শতাংশ। দিনাজপুর বোর্ডে মোট পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ১ লাখ ৮৬ হাজার ৬৪৪। জিপিএ-৫ পেয়েছে ১০ হাজার ৭৫৫ শিক্ষার্থী। এ বোর্ডে পাসের হার ৭৭.৬২ শতাংশ। গণিতে ফল খারাপের প্রভাব পড়েছে চট্টগ্রাম বোর্ডের সার্বিক ফলেও। এ বোর্ডে বিজ্ঞান-মানবিক-ব্যবসায় শিক্ষা তিন বিভাগেই পাসের হার কমেছে। বিজ্ঞানে বিভাগে পাসের হার ৯০ দশমিক শূন্য শতাংশ। যা গত বছর ছিল ৯২ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ। ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে পাসের হার ৭৮ দশমিক ৮৬ শতাংশ। যা গত বছর ছিল ৮৬ দশমিক ৪৪ শতাংশ। মানবিক বিভাগে পাসের হার ৬০ দশমিক ১৩ শতাংশ। যা গত বছর ছিল ৭৩ দশমিক ৩৬ শতাংশ। এবার ১০ শিক্ষা বোর্ডের ফল ঘেঁটে দেখা গেছে, ফেল করা চার লাখ শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রায় তিন লাখই মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থী। প্রতিটি বোর্ডেই মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থীরা ইংরেজী ও গণিতে ফল খারাপ করেছে। বিভিন্ন বোর্ডের মানবিক বিভাগের ফল খারাপের ধাক্কা সার্বিক পাসের হারে লেগেছে। জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির সদস্য সচিব ও নায়েমের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক শেখ একরামুল কবির বলছিলেন, দুটি কারণে ইংরেজী গণিতে পাসের হার সামান্য কমেছে। কারণের একটি নেতিবাচক হলেও আরেকটি ইতিবাচক। সারাদেশের ইংরেজী ও গণিতের যোগ্য শিক্ষকের অভাব যেমন একটি সঙ্কট তেমনি আগের মতো খাতা মূল্যায়নে উদারতা না থাকার বিষয়টি দেশের শিক্ষার জন্য ইতিবাচক। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে খাতার সঠিক মূল্যায়ন না হওয়ায় পাসের হার পাল্লা দিয়ে বেড়েছে। যার প্রভাব ছিল ইংরেজী ও গণিতেও। সঠিক খাতা মূল্যায়ন না হওয়ায় এ দুটি বিষয়েও পাসের হার চলে যায় শতভাগের কাছে। এখন সঠিক মূল্যায়নে নতুন পদ্ধতির প্রয়োগের ফলে মোট পাসের হার যেমন কমেছে তেমনি সবচেয়ে বড় প্রভাব পরেছে ইংরেজী ও গণিতে। দীর্ঘদিন ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে এসব বিষয় দেখছেন বোর্ডের সচিব সাহেদুল খবীর চৌধুরী। তিনি বলছিলেন, আসলে সার্বিক ফল বা ইংরেজী ও গণিতের ফল খুব খারাপ হয়েছে তা কিন্তু বলা যাবে না। পাসের হার দুই শতাংশ এদিক ওদিক হতেই পারে। তার পরেও এটা ঠিক যে ইংরেজী ও গণিতে খারাপ করার কারণেই পাসের হার সামান্য কমেছে। এর পেছনে দু‘টি কারণ আছে উল্লেখ করে সচিব বলেন, এটা তো বাস্তব যে সারাদেশে বিশেষত মফস্বল এলাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দক্ষ ও যোগ্য বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকের অভাব আছে। এখন বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগ হলেও এগোত তা ছিল না। আগে ডিগ্রী পাস করা শিক্ষক হতো কিন্তু কোন নির্দিষ্ট বিষয়ে ডিগ্রীধারী শিক্ষক নিয়োগ হতো না। একটু সময়তো লাগবেই। নতুন কোন পদ্ধতি আয়ত্ত করতে তো একটু সময় লাগবেই। তবে খাতার সঠিক মূল্যায়ন তো পাসের হার সামান্য কমার একটি বড় কারণ-এমন মন্তব্য করে সাহেদুল খবীর চৌধুরী বলেন, ইংরেজী ও গণিতে কিন্তু সকল বোর্ডের ফল খারাপ নয়। কয়েক বোর্ড আগের তুলনায় ভালও করেছে। অন্য অনেক বিষয়েও পাাসের হার কোথাও কমেছে আবার কোথাও বেড়েছে। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক তপন কুমার সরকার বলছিলেন, ঢাকা বোর্ডে গণিত ও ইংরেজীতে পাসের হার অনেক কমেছে। গত বছর ইংরেজীতে ৯৫ দশমিক ৪৬ শতাংশ ছাত্রছাত্রী পাস করলেও এবার করেছে ৯১ দশমিক ১৮ শতাংশ। অর্থাৎ ইংরেজীতে পাস ৪ শতাংশ কমেছে। আবার গণিতে গতবার পাস করেছিল ৯০ দশমিক ৪০ শতাংশ, এবার করেছে ৮৭ দশমিক ৭৬ শতাংশ। অর্থাৎ এ বিষয়েও পাস প্রায় ৪ শতাংশ কমেছে। পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়নেও ১ শতাংশ করে পাসের হার কমেছে। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের সাবেক পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক বর্তমান খুলনার সরকারী বিএল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক সৈয়দ সাদিক জাহিদুল ইসলাম বলছিলেন, ফল যে খারাপ হয়েছে তা কিন্তু বলা যাবে না। বরং এই ফলই ইতিবাচক। খাতা মূল্যায়নে একটা ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। এর প্রভাব স্বাভাবিকভাবেই তুলনামূলকভাবে কঠিন বিষয়গুলোতে পড়বে। পাসের হার কমার কারণ জানতে চাইলে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক (ভারপ্রাপ্ত) তাওয়ারিক আলম বলেন, এবার শিক্ষার্থীরা গণিতে তেমন একটা ভাল করেনি। যার প্রভাব বোর্ডের সার্বিক ফলে দেখা যাচ্ছে। এছাড়া বরাবরের মতই এবারও তিন পার্বত্য জেলার ফল তেমন ভাল নয়। তাই এর একটি প্রভাবও রয়েছে। তিন পার্বত্য জেলায় গণিতে পাসের হার বিষয়ে তিনি বলেন, রাঙ্গামাটিতে গণিতে পাসের হার ৭৯ দশমিক ১৮ শতাংশ, খাগড়াছড়িতে ৭২ দশমিক ৫৮ শতাংশ, বান্দরবানে মাত্র ৬৩ দশমিক ৬৭ শতাংশ। বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়েছে ৭ হাজার ২৮৫। ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়েছে ৭৮৩। এ বছর মানবিক বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়েছে ২৬।
×