ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

খুব বেশি ক্ষতি হবে না- আশা কৃষি কর্মকর্তাদের;###;রোদ না থাকায় নষ্ট হচ্ছে মাড়াই ধান

দুশ্চিন্তায় চাষী ॥ বৃষ্টিতে ভাসছে বাম্পার ফলনের বোরোধান

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ৮ মে ২০১৮

দুশ্চিন্তায় চাষী ॥ বৃষ্টিতে ভাসছে বাম্পার ফলনের বোরোধান

ওয়াজেদ হীরা ॥ চারদিকে সোনালী ধানে ভরা মাঠ। বিস্তীর্ণ ক্ষেতের অধিকাংশ জায়গায় ধান পেকে সোনালি রং ধারণ করেছে। কোথাও আবার দানা পুষ্ট হলেও পুরোপুরি পাক ধরেনি সব ধানে। এবার প্রতিটি মাঠেই বাম্পার ফলন হয়েছে বোরোর। গত বছরের বন্যার ক্ষতি কিছুটা কাটানোর স্বপ্ন দেখার সময় হঠাৎ দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়েছে কৃষকের কপালে। গোলা ভরার পরিবর্তে কৃষকের সেই স্বপ্ন এখন জলের নিচে। কয়েকদিনের বৃষ্টিপাত ও ঝড়োহাওয়ায় জমির উঠতি ফসল মাটিতে লুটে পড়ায় কৃষকের স্বপ্ন এখন দুঃস্বপ্ন। অনেকস্থানে ক্ষেতের ফসল হাবুডুবু খাচ্ছে জলে। এতে বৃষ্টির জলে ভাসছে লাখো কৃষকের স্বপ্ন। কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা বলেছেন, বৃষ্টি হয়েছে তবে ক্ষতির পরিমাণ খুব বেশি হবে না। অবশ্য কৃষকদের মতে, আবহাওয়া অনুকূলে না এলে পানিতে নিমজ্জিত ধান পচতে শুরু করবে। যা ধানের ফলনে প্রভাব ফেলবে। আশার তুলনায় অনেক কম ফলন হবে বলে মনে করছেন কৃষক। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের (ডিএই) তথ্য অনুযায়ী, এ বছর সরকার বোরোর উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে; এক কোটি ৯৪ লাখ ৪৮ হাজার ৪শ’ টন। আর বোরো আবাদের জন্য জমির পরিমাণ ধরা হয়েছে ৪৭ লাখ ২৪ হাজার হেক্টর। বজ্রবৃষ্টি আর ফসলের ক্ষতির আশঙ্কা থাকলেও লক্ষ্যপূরণের কথা বলছেন কৃষি কর্মকর্তারা। গাজীপুরের শ্রীপুরের কৃষক হাসেম আলী (৪৫)। প্রতিদিন ক্ষেতের দিকে তাকান আর আকাশের দিকে তাকান। বৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে তার সোনালি ধান। অন্য একটি ক্ষেতে কিছুটা মাথা উঁচিয়ে আছে ধানের শীষ। তবে যেকোন সময় তা তলিয়ে যাবে সে আশঙ্কা রয়েছে। পাশের উপজেলা শিল্প এলাকা ভালুকা। কৃষক নাজিমউদ্দিন হাত দিয়ে দেখিয়ে বলেন ঐটা আমার ক্ষেত। যতদূর দৃষ্টি গেল ধান চোখে পড়ল না। মনে হচ্ছে একটা বিল। পানি নেমে গেলেই তারা ধান কাটবে সে আশায় দিন গুনছে। শিল্প কিংবা বাণিজ্যিক এলাকা নয় বৃষ্টিপাতের প্রভাব পড়েছে কমবেশি সারাদেশেই। কোন কোন জেলায় মাত্রা অনেক বেশি। একাধিক জেলায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সোনার ফসল হারানোর আশঙ্কায় বৃষ্টিপাতের মধ্যেই আধাপাকা ধান কেটে ফেলা হয়েছে। কৃষকের ঘাম আর নিরলস শ্রমের স্বপ্ন ভাসছে বৃষ্টির পানিতে। প্রকৃতির এই খেলায় কেউ বলতেও পারছে না কিছু করতেও পারছে না। শুধু নীরবে চোখের জল মুছছেন কৃষক। ‘শস্যভা-ার’ খ্যাত দেশের সর্ববৃহৎ বিল চলনবিল। টানা কয়েকদিনের ভারি বর্ষণে চলনবিলের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া আত্রাই ও নাগর নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় এই অঞ্চলের লক্ষাধিক কৃষক এখন আতঙ্কিত। অনেক বোরো ধানের ক্ষেত তলিয়ে গেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কাঁচা-আধাপাকা ধান কাটতে বাধ্য হচ্ছেন অনেক কৃষক। আবার ধান কাটলেও রোদ না থাকায় তা নিয়েও আছে বিপত্তি। উজানের ঢলের পানি নাগর নদীর সারদানগর বাঁধ দিয়ে চলনবিলে ঢুকে তাড়াশ উপজেলার কুন্দইল, লালুয়ামাঝিড়া, মাকোরসোন, কামাসোন, ভেটুয়া; সিংড়া উপজেলার আয়েশ, বিয়াস, কদমতলী; গুরুদাসপুর উপজেলার বিলসা, রুহাই ও খুবজিপুর গ্রামের প্রায় দুই শতাধিক কৃষকের স্বপ্ন এখন পানির নিচে। এদিকে শ্রমিক সঙ্কটের কারণে উচ্চ মজুরি দিয়েও ক্ষেত থেকে ধান ঘরে তুলতে পারছেন না অনেক কৃষক। সিংড়া উপজেলার বিভিন্ন খাল পানিতে ডুবে প্রায় ৫ হাজার হেক্টর জমির ধান হুমকির মুখে রয়েছে। চলনবিলের তাড়াশ ও সিংড়া উপজেলার কৃষি অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, এ বছর চলনবিলে মিনিকেট, কাটারিভোগ, বি-আর ২৮, বি-আর ২৯ জাতের বোরো ধান বাম্পার ফলনের সম্ভাবনা থাকলেও ধান কাটার ভরা মৌসুমে কয়েকদিনের টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে ডুবে গেছে নিম্ন অঞ্চলের পাকা বোরো ধান। সিংড়া উপজেলার কদ্দুস, মনসুর আলী, সোজাউদ্দিন জানান, ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে চাষাবাদ করেন। হঠাৎ টানা বর্ষণ ও ঢলের পানিতে ফসল ডুবে যাওয়ায় তাদের স্বপ্ন এখন পানির নিচে। ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ নিয়ে দুশ্চিন্তায় তারা। এদিকে কয়েকদিনের টানা বৃষ্টিপাত ও ঝড়োবাতাসে বগুড়ার ১২ উপজেলায় কমবেশি ধান ক্ষেতের চিত্রটা পানির নিচে। উপজেলার কৃষক ও কৃষি বিভাগের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এমনই তথ্য উঠে এসেছে। কৃষি বিভাগ বলছে, ক্ষতির পরিমাণ সামান্য। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে ১ লাখ ৯০ হাজার হেক্টর জমিতে বোরোর আবাদ হয়েছে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭ লাখ ৭০ মেট্রিক টন। চলতি মৌসুমে এ জেলায় যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে তা পূরণে সমস্যা হবে বলে কৃষকরা জানিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে বগুড়া জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক প্রতুল চন্দ্র সরকার বলেন, এখন বোরো ধান পাকা ও শক্ত অবস্থায় আছে। আশা করা যায় ফলনে তেমন কোন প্রভাব পড়বে না। রাজশাহীতেও একই অবস্থা। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর জানায়, জেলায় এ বছর বোরো চাষের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬৬ হাজার ২১২ হেক্টর। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে তিন হাজার হেক্টর বেশি জমিতে চাষ হয়েছে ধান। এবার চার লাখ ১১ হাজার ৭৭ মেট্রিক টন ধান এবং তা থেকে দুই লাখ ৭৪ হাজার ৫১ মেট্রিক টন চাল উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরে কৃষি দফতর। তবে শেষ মুহূর্তের দুর্যোগে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা পূরণ নিয়ে শঙ্কায় কৃষি দফতর। কৃষকরা বলছেন, এবার প্রথম থেকেই আবহাওয়া অনেকটাই অনুকূলে ছিল। ফলনও ভাল প্রত্যাশা করছিলেন চাষিরা। তবে ধানের শীষ বের হওয়ার সময় দুই দফা শিলাবৃষ্টির কবলে পড়ে বোরো ধান। অনেক জায়গায় ব্লাস্ট রোগের ক্ষতি কাটিয়ে সেই ফসল ঘরে তুলতে শুরু করেছিলেন চাষিরা। কিন্তু কয়েকদিন প্রচ- কালবৈশাখীতে নুয়ে পড়ে ধান। সঙ্গে ভারি বৃষ্টিতে তলিয়ে যায় ধানক্ষেত। এতে ঋণ নিয়ে ধান চাষ করে বিপাকে পড়েছেন ভূমিহীন ও প্রান্তিক চাষিরা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বৃষ্টির পানিতে জেলার তানোর উপজেলার শিবনদী ও বিলকুমারী বিলের পানি বেড়ে কয়েক শ’ হেক্টর বোরো ধানের জমি তলিয়ে গেছে। এতে দিশাহারা হয়ে পড়েছেন কৃষক। তানোরের শিবনদী সংলগ্ন চৌবাড়িয়া, কামারগাঁ, তালন্দ, চাপড়া, গোকুল, শিতলীপাড়া, কুঠিপাড়া, আমশো, বুরুজ, কালীগঞ্জ ও চাঁন্দুড়িয়ার অনেক ধানক্ষেত পানিতে তলিয়ে গেছে। স্থানীয় উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা ডিএফএম এমদাদুল ইসলাম বলেন, পানিতে বোরো ধান তলিয়ে যাচ্ছে। তারপরও কৃষক সেসব ধান কাটার চেষ্টা করছেন। বিঘাপ্রতি ১৫ থেকে ১৮ মণ ফলন হচ্ছে। তবে পানি না থাকলে ২০ থেকে ২২ মণ ফলন হতো। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক দেব দুলাল ঢালী বলেন, শুধু রাজশাহী জেলা নয়, বরেন্দ্র অঞ্চলের নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জেও বৃষ্টি হয়েছে। এতে ফলন পাঁচ থেকে ১০ ভাগ কমতে পারে। তবে এতে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে কোন ঘাটতি থাকবে না। গত বছরের বন্যায় একমুঠো ধানও গোলায় তুলতে পারেননি সুনামগঞ্জ অঞ্চলের কৃষকরা। চলতি বোরো মৌসুমে ধানের বাম্পার ফলনে তাই ভুলে গিয়েছিলেন সেই দুঃখ। কিন্তু এবারও টানা বৃষ্টিপাতে আবার চিন্তার ভাঁজ কপালে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, কয়েকদিন বৃষ্টি হওয়ায় ধান কাটা ও শুকোতে কিছু সমস্যা হয়েছে। তবে কোথাও বৃষ্টির পানিতে ধান তলিয়ে বা জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়নি। কয়েক দিনের ঝড় ও ভারি বর্ষণে তলিয়ে গেছে বাগেরহাটের অধিকাংশ জমির ফসল। স্বপ্নের সোনালি ধান নিয়ে দিশাহারা বিভিন্ন উপজেলার শত শত কৃষক। চিতলমারী সদর, বড়বাড়িয়া, কলাতলা, হিজলা, শিবপুর, চরবানিয়ারী ও সন্তোষপুর ইউনিয়নে ১১ হাজার ৯১৫ হেক্টর জমিতে উচ্চ ফলনশীল ও উফশী জাতের বোরো আবাদ করা হয়। ফলনও হয়েছে বাম্পার। কিন্তু এসব ফসল ঘরে তোলার সময় হলেও হঠাৎ করে ঝড়-বৃষ্টিতে অধিকাংশ জমি তলিয়ে গেছে। পানিতে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে শত শত হেক্টর জমির ফসল। কৃষি কর্মকর্তারা জানান, ধান দ্রুত কেটে ফেলার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। তবে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সমস্যা হবে না। এদিকে, সপ্তাহের টানা বৃষ্টিতে হবিগঞ্জের অনেক এলাকায় বোরো ফসল পানিতে নিমজ্জিত। এছাড়াও বজ্রপাত নিয়ে কৃষকরা কিছুটা আতঙ্কিত ফলে বৈরী আবহাওয়ায় প্রচুর টাকা দিয়েও মিলছে না শ্রমিক। জানা গেছে, বানিয়াচং উপজেলার চাতল, খরতি, আড়িয়ামুগুর, নলাইর হাওরে পাকা ধানের ৯০ শতাংশ ফসলই পানির নিচে। নলাই ও সিঙ্গুয়ার হাওরে প্লাবিত হয়েছে প্রায় ১০৩ হেক্টর বোরো ধান। ময়মনসিংহের শিল্প এলাকা ভালুকার পাশাপাশি মুক্তাগাছা, গফরগাঁও, ফুলবাড়িয়ায়ও ধান পানির নিচে বলে জানা গেছে। ভালুকা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সঞ্জয় কুমার পাল জানান, প্রায় ৪০/৫০ হেক্টর বোরো ধানের জমি পানিতে তলিয়ে আছে। পানিবন্দীর কারণ হিসেবে তিনি অতিবৃষ্টি ও ফ্যাক্টরি ও বিভিন্নভাবে খাল ভরাট হওয়াকে দায়ী বলছেন। যমুনা নদীর পানি টাঙ্গাইলের বিভিন্ন ছোট নদী ও খালে প্রবেশ করে আশপাশের শস্য ক্ষেতেও ছড়িয়ে পড়ে। আর শস্য নিয়ে বেকায়দায় পড়েছেন কৃষকরা। নেত্রকোনাসহ দেশের উত্তর এলাকার কিছু জায়গায় বৃষ্টির পানিতে ধানের ক্ষতি হয়েছে বলে জানা গেছে। কৃষি সম্প্রসারণের মহাপরিচালক কৃষিবিদ মোহাম্মদ মহসীন জনকণ্ঠকে বলেন, আমাদের লক্ষ্য ছিল ৪৭ লাখ হেক্টরের কিছু বেশি জমিতে আবাদ; সেখানে লক্ষ্যের চেয়ে অনেক বেশি জমিতে আবাদ হয়েছে। ৫০ লাখ হেক্টরের মতো জমিতে আবাদ হয়েছে। আবার উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রাও এবার দুই কোটি ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি। সরকারী কর্মকর্তারা যেখানে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে চাচ্ছেন কৃষক সেখানে সোনার ফসল ঘরে ওঠাতে পারলেই যেন স্বস্তি পায়। বৈরী আবহাওয়ায় আকাশ আর ধান ক্ষেতের দিকে বার বার তাকিয়ে দেখছেন কৃষক। এদিকে আবহাওয়া অধিদফতর জানিয়েছে রবিবার থেকে খুলনা, বরিশাল, ঢাকা, চট্টগ্রাম, রংপুর ও রাজশাহী বিভাগের অনেক জায়গায় বৃষ্টিপাত কমে যাবে। তবে সিলেট ও ময়মনসিংহের অনেক জায়গায় বৃষ্টি ও ছোট আকারের কালবৈশাখী অব্যাহত থাকতে পারে। সেই সঙ্গে বজ্রবৃষ্টির সম্ভাবনাও রয়েছে। আবহাওয়াবিদ আরিফ হোসেন জানান, শনিবার বৃষ্টিপাতের প্রবণতা অনেকটা কমে গেছে। রবিবার থেকে দেশের অনেক জায়গায় বৃষ্টিপাতের প্রবণতা আরও কমে যাবে। কৃষকও অপেক্ষায় বৃষ্টিপাত কমার আর সোনালি ফসল ঘরে তোলার।
×