রাজন ভট্টাচার্য ॥ মালিবাগ রেলগেট। ঘটনা শুক্রবার রাত আটটায়। বেশ কয়েকটি তুরাগ পরিবহনের বাস দাঁড়িয়েছিল। বেশিরভাগ বাসে যাত্রী ছিল কম। তাই প্রতিটি বাসে যাত্রী তোলার প্রতিযোগিতা। ছুটির দিন হওয়ায় যাত্রীও ছিল কম। পেছনে একই কোম্পানির বাস আসার পরই সামনের গাড়িকে সজোরে ধাক্কা! যাত্রীদের কি হবে এ নিয়ে চালকদের কোন মাথাব্যথা নেই। চালকদের বক্তব্য এটাই নাকি ‘নিয়ম’। ২০ মিনিটে এরকম ঘটনা চোখে পড়ল অন্তত দশটি।
কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত কন্ডাক্টর, চালকসহ যাত্রীরা জানিয়েছেন, যাত্রী উঠানোর প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব থেকেই এক বাসকে আরেক বাসের ধাক্কা দেয়ার প্রবণতা এখন নিয়মে দাঁড়িয়েছে। টঙ্গী স্টেশন রুট থেকে যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত পুরো রুটেই এই কোম্পানির বাসের চিত্র একই। শুধু তাই নয় একটি বাসও পাওয়া যাবে না যেগুলোর দু’পাশের বডি অক্ষত! চলতি পথে রেষারেষির কারণে বাসের বাইরের অংশের ছাল-বাকল বলতে কিছু নেই। প্রতিটি বাসের সামনে ও পেছনের অংশ থেতলানো। লাইট নষ্ট। ফ্যান নেই। জানালা ভাঙ্গা। এ চিত্রই বলে দেয় কোম্পানির গাড়িগুলোর বেপরোয়া চলনের কথা।
মালিবাগ রেলগেট থেকে এবারের যাত্রা বাসাবোর দিকে। মালিবাগ মোড় থেকে কমিউনিটি সেন্টার পর্যন্ত সড়কের পাশে একাধিক সারিতে সোহাগ পরিবহনের পার্কিং। একদিকে ব্যস্ততম মালিবাগ মোড়। সেখানে সোহাগের কাউন্টারের সামনে কিছু সময় পর-পর যাত্রী উঠানো হয়। এর একটু সামনেই পার্কিং! স্থানীয় লোকজন জানালেন এই পয়েন্টে যানজট ও যাত্রী ভোগান্তির অন্যতম কারণ সোহাগ পরিবহনের স্বেচ্ছাচারিতা। পুলিশের নাকের ডগায় বছরের পর বছর এসব হচ্ছে। অথচ কারও যেন দেখার নেই। এর একটু সামনে খিলগাঁও পর্যন্ত রাস্তার বাম পাশে একাধিক সারিতে মিডওয়ে ও বাহন পরিবহনের পার্কিং!
এই রুটে এখন লাব্বাইক, রাইদা, অনাবিল, ছালছাবিল, নূর-ই মক্কাসহ আরও বেশ কয়েকটি কোম্পানির বাস চলাচল করে। প্রশ্ন হলো বেপরোয়া চলাচলে শুধু কি ‘তুরাগ’ পরিবহনই। না। মালিবাগ মোড় থেকে একটু সামনে আনসার ক্যাম্প। এই পয়েন্টে ঢাকা মেট্রোপলিটন ট্রাফিক পুলিশের পক্ষ থেকে সড়কের পাশে সাইনবোর্ড ঝোলানো আছে। এতে লেখা আছে, ‘এখানে বাস থামানো নিষেধ’। কে শোনে কার কথা। এই পয়েন্টে রাত দিন বাস থামানো হচ্ছে। অন্য কোম্পানির বাসগুলোর মধ্যেও চলছে পাল্টাপাল্টি যাত্রী তোলার প্রতিযোগিতা। ছালছাবিল পরিবহনের দুই বাসের রেষারেষিতে জানালার কাঁচ ভাঙ্গার দৃশ্যও চোখে পড়ে। ধাক্কার চোটে বাসের ফ্যানের খাঁচাও খুলে যায় অহরহ। ফ্লাইওভারের গোড়া থেকে শুরু করে বাসাবো, বৌদ্ধ মন্দির, কমলাপুর, মুগদা, টিটিপাড়া, মানিকনগর, সায়েদাবাদ পয়েন্ট পর্যন্ত এই রুটের বাসগুলোর চলাচলের চিত্র একই রকম।
পথে পথে পরিবহনের নৈরাজ্য আর আইন না মানার প্রবণতা চোখে পড়ে। কিন্তু ট্রাফিক পুলিশের এ নিয়ে কোন মাথাব্যথা নেই। তারা তাদের মতো দিব্যি আছেন। আইন মানতে চালকদের বাধ্য করতেও দেখা যায়নি। এ নিয়ে সরাসরি কোন কথা বলতেও সম্মত নন ট্রাফিক বিভাগের কেউ। রাস্তায় যারা ডিউটি করছিলেন তাদের সঙ্গে কয়েক দফা কথা বলার চেষ্টা করা হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা জানিয়েছেন, ট্রাফিক বিভাগের পক্ষ থেকে রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে বাস স্টপেজ যেমন নির্ধারণ করা হয়েছে তেমনি বাস না থামানোর জন্য নির্দেশনা দিয়ে শত-শত সাইনবোর্ড টাঙ্গানো হয়েছে। মূলত যানজট নিরসন ও পরিবহনে শৃঙ্খলা আনার চেষ্টা থেকেই এই উদ্যোগ। কিন্তু কে শোনে কার কথা। কোন নির্দেশনাই কার্যকর হচ্ছে না। বলতে গেলে, সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দায় সারছে ট্রাফিক বিভাগ।
তারা জানান, পরিবহন সেক্টরের সঙ্গে প্রভাবশালীরা জড়িত। এখন কাউকে কিছু বলা যায় না। তাছাড়া ট্রাফিক বিভাগের কর্মকর্তাদের নানা রকম বিধি নিষেধ থাকে আমাদের ওপর। তাই রাস্তায় এত নৈরাজ্য। চালক, মালিকসহ যাত্রীরা বলছেন, ট্রাফিক সিগন্যাল দিলে চালকরা তা মানেন না। ভাড়া নিয়ে বাড়াবাড়ি তো আছেই। আছে সিটিং সার্ভিসের নামে দ্বিগুণ অথবা তিনগুণ ভাড়া আদায়ের অভিযোগ। পাশাপাশি সিটিং সার্ভিসের ভাড়া নেয়া হলেও দাঁড়িয়ে যাত্রী তুলছে ছালছাবিল, রাইদা, অনাবিল, লাব্বাইক পরিবহন। চেকিং সিস্টেমের নামে যাত্রীদের গলাকাটা হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
এর উদাহরণ হিসেবে এক যাত্রী জানান, মৌচাক থেকে মগবাজারের ভাড়া ১০ টাকা। আর ইস্কাটন ছাড়িয়ে বাংলামোটর গেলেই লাব্বাইক পরিবহনে ২০টাকা গুনতে হচ্ছে। অর্থাৎ এক কিলোমিটারের কম রাস্তার জন্য ১০ টাকা বাড়তি ভাড়া নেয়া হচ্ছে।
লাব্বাইক, তুরাগসহ একাধিক কোম্পানির চালকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এক সপ্তাহের কম সময়ের প্রশিক্ষণে তারা ড্রাইভিং লাইসেন্স পেয়েছেন। লাইসেন্স নেয়ার সময় সামাজিক বাস্তবতা ও রাস্তা সম্পর্কে কোন ধারণা দেয়া হয়নি। গাড়ি চালাতে পারে এই বিবেচনায় মিলেছে লাইসেন্স। চালক সোহাগের বক্তব্য হলো, লাইসেন্স পাওয়ার আর গত আট বছরে তাদের কোন প্রশিক্ষণ দেয়া হয়নি। সড়ক দুর্ঘটনা সম্পর্কেও তাদের সচেতন করা হয়নি। সড়ক দুর্ঘটনা ও সামাজিক বাস্তবতা সম্পর্কে চালকদের অনেকেই জানতে চান। কিন্তু এ নিয়ে মালিক বা বিআরটিএর কোন ভাবনা নেই।
অপর চালক রাশেদ জানালেন, প্রতিটি কোম্পানি থেকে ট্রাফিক পুলিশ মাসোহারা নেয়। তাছাড়া দুর্ঘটনা হলে দ্রুত সমস্যার সমাধান মেলে। তাই চালকদের অনেকেই রাস্তায় কোন কিছু পরোয়া করে না। পাশাপাশি চালকদের মানবিক বিষয়ে কোন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই। অনেক চালক থাকেন মাদকাসক্ত। পাশাপাশি চুক্তিতে গাড়ি ভাড়ার প্রবণতাও চালকদের বেপরোয়া হওয়ার কারণ বলছেন অনেক চালকই।
যাত্রী অধিকার সংরক্ষণে কাজ করা যাত্রী কল্যাণ সমিতি বলছে, রাজধানীতে ৮৭ শতাংশ বাস-মিনিবাস নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলার সঙ্গে জড়িত। সংগঠনের মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, রাজধানীসহ সারাদেশের গণপরিবহনে নৈরাজ্য চলছে। বাসে-বাসে রেষারেষি করে বেপরোয়া চলাচল ও পাল্লা-পাল্লির কারণে দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছেন যাত্রীরা। যত্রতত্র বাস থামানো, রাস্তার মাঝ পথে গতি কমিয়ে, চলন্ত বাসে যাত্রী উঠানামা করানো, ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন, যাত্রী ধরার জন্য বাসে বাসে ভয়ঙ্কর প্রতিযোগিতা, অব্যবস্থাপনা ও বিশৃঙ্খলা ঢাকার গণপরিবহনের নিত্যদিনের চিত্র।
সম্প্রতি সরকারী তিতুমীর কলেজের ছাত্র রাজীব হোসেন নিহতের ঘটনায় সারাদেশ কেঁদে উঠলেও প্রতিদিন বাংলাদেশের সড়ক মহাসড়কে ঝরছে কমপক্ষে ৬৪ তাজা প্রাণ। আহত ও পঙ্গুত্বের তালিকায় যুক্ত হচ্ছে ১৫০ এর বেশি মানুষ। সড়ক ব্যবস্থাপনা, সড়কের শৃঙ্খলা মারাত্মকভাবে ভেঙ্গে পড়েছে বলে দাবি করেন তিনি।
সমিতির এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, বর্তমানে সারাদেশে নিবন্ধিত ৩১ লাখ যানবাহনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অনিবন্ধিত, ভুয়া নাম্বারধারী ও অযান্ত্রিক যান মিলে প্রায় ৫০ লাখ যানবাহন রাস্তায় চলছে। যার ৭২ শতাংশ ফিটনেস অযোগ্য। অন্যদিকে সারাদেশে ৭০ লাখ চালকের মধ্যে বিআরটিএ লাইসেন্স আছে মাত্র ১৬ লাখ চালকের হাতে। রাজধানীতে ৮৭ শতাংশ বাস-মিনিবাস ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন করে বেপরোয়া চলাচল করে। ফলে এসব বাসে দুর্ঘটনায় কারও হাত, কারও পা, কারও মাথা, বা কারও জীবন পর্যন্ত চলে যাচ্ছে। সংগঠনের সড়ক দুর্ঘটনা পর্যবেক্ষণ সেলের তথ্যমতে, সারাদেশে জানুয়ারি ২০১৮ থেকে ২০ এপ্রিল ২০১৮ পর্যন্ত ১ হাজার ৭৭৯ সড়ক দুর্ঘটনায় ১ হাজার ৮৪১ জনের প্রাণহানি ৫ হাজার ৪৭৭ আহত হয়েছে। পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন ২৮৮ মানুষ।
তিনি বলেন, আমরা এসব দুর্ঘটনাকে দুর্ঘটনা নয় পরিকল্পিত হত্যাকা- বলতে চাই। কেননা আমাদের সড়কে সমস্ত অব্যবস্থাপনা ও বিশৃঙ্খলা জিইয়ে রেখে নৈরাজ্যকর পরিবেশে আমাদের যাতায়াতে বাধ্য করা হচ্ছে। নগরীর প্রতিটি বাস-মিনিবাসের ব্যবসা মূলত চালকরা নিয়ন্ত্রণ করছে। দৈনিক চুক্তিভিক্তিক ইজারায় প্রতিটি মালিক তার বাসটি চালকের হাতে তুলে দিয়েছে। এতেই চালকরা যাত্রী ধরার জন্য বাসে বাসে ভয়ঙ্কর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। এহেন পরিস্থিতিতে বাস চালাতে গিয়ে বাসের নিচে কে পড়ল বা কার হাত বা পা গেল তা দেখার সময় নেই চালকদের।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক এক সেমিনারে বলেন, মানবাধিকারের অন্যতম শর্ত মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার। আমাদের সড়কে এই অধিকার অব্যবস্থাপনা ও নৈরাজ্যের চাকায় পৃষ্ট হচ্ছে। উন্নত বিশ্বে আইনের প্রয়োগ থাকলেও আমাদের এখানে প্রকৃতপক্ষে আইনের কোন প্রয়োগ নেই।
সড়ক পরিবহন সেক্টরে নতুন যে আইন করা হচ্ছে তাতে সকলের মতামতের প্রতিফলন হয়নি। তাই এই সেক্টরের সমস্যা সমাধানের উপায় খুঁজে বের করা কঠিন। তিনি প্রস্তাবিত সড়ক পরিবহন আইন বিল আকারে পাস করার আগে সবার মতামত নিয়ে সব কিছু বিচার বিশ্লেষণ করে আইনের সন্নিবেশনের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
জানতে চাইলে বিআরটিএ সচিব শওকত আলী বলেন, পরিবহন সেক্টরে শৃঙ্খলা ফেরাতে আমরা কাজ করছি। ইতোমধ্যে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে জনসচেতনতামূলক মাইকিং ও লিফলেট বিতরণ চলছে। এছাড়া মোবাইল কোর্টের অভিযানও বৃদ্ধি করা হয়েছে।