ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

পাহাড়ী-বাঙালী সৌহার্দ্য বজায় রাখতে হবে ॥ প্রধানমন্ত্রী

প্রকাশিত: ০৫:৫৩, ৭ মে ২০১৮

পাহাড়ী-বাঙালী সৌহার্দ্য বজায় রাখতে হবে ॥ প্রধানমন্ত্রী

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পাহাড়ী-বাঙালীদের মধ্যে সৌহার্দ্য বজায় রাখার ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেছেন, আমরা চাই পাহাড়ে শান্তি বজায় থাকুক। সবার জন্য একটি অনুকূল পরিবেশ বজায় রাখা আবশ্যক। এখানে কে পাহাড়ী, কে বাঙালী সেটা বড় কথা না। মানুষ মানুষই। পাহাড়ী ও বাঙালী সবাই মানুষ। প্রত্যেক মানুষের মৌলিক অধিকার আছে। মানুষের এই মৌলিক অধিকার পূরণ করতে হবে আমাদের। রবিবার গণভবনে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ এ বছরের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফলের সারসংক্ষেপ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে তুলে দেন। পরে দশটি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানরা পৃথকভাবে স্ব-স্ব শিক্ষা বোর্ডের ফলের কপি প্রধানমন্ত্রীর কাছে হস্তান্তর করেন। ওই অনুষ্ঠানে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বরিশাল ও বান্দরবান জেলার সঙ্গে যুক্ত হন প্রধানমন্ত্রী। এ সময় প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখার স্বার্থে পার্বত্য জেলাগুলোর পাশাপাশি সারা দেশে শান্তি ও সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখতে হবে। ভিডিও কনফারেন্সে বান্দরবানের জেলা প্রশাসক আসলাম হোসেন বলেন, বান্দরবান এক সময় অশান্ত বান্দরবান ছিল। এখন শান্তির বান্দরবানে রূপান্তরিত হয়েছে। উন্নয়ন এবং সমৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে এগিয়ে চলেছে। সর্বশেষ ২০১২ সালে এই পার্বত্য জেলায় প্রধানমন্ত্রীর সফরের কথা মনে করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, আবারও আপনাকে দেখার জন্য মানুষ উন্মুখ হয়ে আছে। জবাবে প্রধানমন্ত্রী বান্দরবান সফরের চেষ্টা করবেন জানিয়ে সবার মৌলিক অধিকার পূরণে শান্তি আর নিরাপত্তার ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, সমগ্র বাংলাদেশব্যাপী আমি বলব, শান্তি, নিরাপত্তা এবং একটা স্বস্তিমূলক পরিবেশ আমাদের একান্তভাবে দরকার। জাতির পিতা দেশ স্বাধীন করে দিয়ে গেছেন। এই দেশকে গড়ে তুলতে হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়; ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলাদেশ হিসেবে। সেই সোনার বাংলাদেশই আমরা গড়তে চাই। পার্বত্য চট্টগ্রামে শিক্ষার হার বাড়াতে আবাসিক স্কুল তৈরি করে দেয়ার পরিকল্পনার কথা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যদিও আমরা যোগাযোগ ব্যবস্থার অনেক উন্নতি করেছি, ছেলেমেয়েরা যাচ্ছে। তবে আমি মনে করি, আবাসিক স্কুল থাকলে পরে তাদের এত দূর দূরান্ত থেকে যাওয়ার প্রয়োজন হবে না। সেখানে থেকে তারা পড়াশোনা করতে পারবে। ইতোমধ্যে কয়েকটি আবাসিক স্কুল চালু হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা চাচ্ছি আরও বেশি আবাসিক স্কুল হোক। সমাজে শান্তি এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সকলকে ভূমিকা পালনের আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সমাজের সর্বস্তরে শান্তি এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই দেশের উন্নয়নের পূর্বশর্ত। একদিন বাংলাদেশ বিশ্বে একটি উন্নত দেশ হিসেবে স্থান করে নিতে সক্ষম হবে- কেননা লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা কখনও ব্যর্থ হতে পারে না। দারিদ্র্য এবং ক্ষুধামুক্ত বাংলাদেশ গড়ার জন্য শিক্ষার হার শতভাগে উন্নীত হওয়া জরুরী উল্লেখ করে তিনি বলেন, আগামীতে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে বাংলাদেশের আরও অনেক সোনার ছেলের প্রয়োজন রয়েছে। দেশের শিক্ষা খাতের উন্নয়নে তাঁর সরকারের সহযোগিতার কথা উল্লেখ করে সরকারপ্রধান আরও বলেন, সরকার প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত বৃত্তি-উপবৃত্তি প্রদান করছে। প্রধানমন্ত্রী এ বছর এসএসসি এবং সমমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের অভিনন্দন জানান। তিনি বলেন, কে পাহাড়ী কে বাঙালী এটা আমাদের কাছে কোন বিবেচ্য নয়, আমরা প্রত্যেকের শিক্ষা ও কল্যাণ নিশ্চিত করতে চাই। প্রধানমন্ত্রী এ সময় সব স্কুলে মিড ডে মিলের ব্যবস্থা করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানান। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ এবং মাদ্রাসা এবং কারিগরি শিক্ষা বিভাগ সংক্রান্ত প্রতিমন্ত্রী কাজী কেরামত আলী অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন। প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মোঃ নজিবুর রহমান অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন। পরিবারে খাদ্যের আপতকালীন মজুদ গড়ুন ॥ এদিকে প্রধানমন্ত্রী গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে পারিবারিক সাইলো বিতরণ কর্মসূচীর উদ্বোধনকালে প্রাকৃতিক দুর্যোগে সম্ভাব্য খাদ্য সংকট মোকাবেলায় ঘরে ঘরে খাদ্যের আপদকালীন মজুদ গড়তে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, আমাদের লক্ষ্যটা যেন থাকে, যে কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগে খাদ্য মজুদটা যেন নিশ্চিত থাকে। যাতে কোনমতেই আমরা খাদ্য ঘাটতিতে না পড়ি কখনও। প্রধানমন্ত্রী এমন এক ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন যেখানে শিক্ষার্থীরা বিদ্যার্জন শেষে নিজেদের কৃষিকাজে সম্পৃক্ত করতে অনিহা প্রকাশ করবে না এবং ফসল কাটার মৌসুমে সেখানে মাঠে কাজ করার সুযোগ থাকবে। তিনি বলেন, ‘শিক্ষিত হয়ে গেলেই তো আবার অনেকে ক্ষেতে নামতে চায় না। এজন্য ধান কাটার মৌসুমে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিশেষ করে কলেজের ছেলেদের অন্তত ক্ষেতের সঙ্গে পরিচয় করাতে ক্ষেতে নামানো যায় কিনা সে বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রবিবার তাঁর সরকারী বাসভবন গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে দেশের ১৯টি জেলার ৬৩টি উপজেলায় পাঁচ লাখ পরিবারের মাঝে পাঁচ লাখ পারিবারিক সাইলো বিতরণ কর্মসূচীর উদ্বোধনকালে এ কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী খাদ্য মন্ত্রণালয়ের আধুনিক খাদ্য সংরক্ষণ প্রকল্পের আওতায় দুর্যোগ প্রবণ এলাকায় খাদ্য সংরক্ষণের জন্য ঝালকাঠি জেলার সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত হয়ে এই প্রকল্পের উদ্বোধন করেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের অর্থনীতিটা কৃষিভিত্তিক। এই অর্থনীতিটাকে আমাদের ধরে রাখতে হবে, খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে হবে এটা আমাদের অব্যাহত রাখতে হবে। কৃষি কাজটাকে যান্ত্রিকীকরণ করতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ জন্য আমরা শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছি। যাতে কেউ যেন কৃষিকাজে বিমুখ না হয়। আর শিক্ষিত হয়ে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে তারা আরও ভালভাবে কৃষিকাজ করতে পারে, বাবা-মাকে সাহায্য করতে পারে, সেভাবে তাদের মানসিকতাটাকে গড়ে তুলতে হবে। সেটাও আমাদের শিক্ষার সঙ্গে থাকা উচিত। খাদ্যমন্ত্রী এ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম, খাদ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি কাজী আব্দুল ওয়াদুদ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব সাহাবুদ্দিন আহমেদ অনুষ্ঠানে ভিডিও চিত্রের মাধ্যমে পারিবারিক সাইলোর বিভিন্ন ব্যবহারিক দিক তুলে ধরেন। প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মোঃ নজিবুর রহমান অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন। ঝালকাঠির জেলা প্রশাকের কার্যালয়ে উপস্থিত প্রকল্পের অনেক উপকারভোগী ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে তাদের অনুভূতি ব্যক্ত করেন। ফুড গ্রেড প্লাস্টিকের তৈরি মটকা সদৃশ্য এই পারিবারিক সাইলোতে দুর্যোগপ্রবণ সময়ে বিশেষ করে সাইক্লোন, জলোচ্ছ্বাস ও বন্যার সময়ে বিভিন্ন খাদ্য দ্রব্য- ধান, চিড়া, মুড়ি, ফসলের বীজ সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে। সাইলোগুলোকে মাটির নিচে পুঁতে বা গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে রেখেও খাদ্যের গুণাগুণ রক্ষা করে এখানে খাদ্য সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে। যেখানে ৫৬ কেজি পর্যন্ত চাল এবং ৪০ কেজি বীজ একসঙ্গে সংরক্ষণ করা যাবে। প্রতিটি সাইলো নির্মাণে এক হাজার ৩শ’ ৭৭ টাকা ব্যয় হলেও নামমাত্র ৮০ টাকা মূল্যে এগুলো কৃষকদের মধ্যে বিতরণ করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর সরকার দেশের শিল্পোন্নয়নেও গুরুত্ব দিচ্ছে। তবে আমাদের লক্ষ্য থাকবে যে কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগে আমাদের যেন খাদ্য মজুদটা নিশ্চিত থাকে। যাতে কোনমতেই কখনও আমরা খাদ্য ঘাটতিতে না পড়ি। পারিবারিকভাবে এই সাইলো বিতরণের উদ্যোগকে যুগান্তকারী আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, এর মাধ্যমে প্রতিটি পরিবার খাদ্যের নিজস্ব আপদকালীন খাদ্য মজুদ গড়ে তুলতে সক্ষম হবে। ৭৪ এর দুর্ভিক্ষ একটি ষড়যন্ত্রের ফসল ছিল উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এরপরই জাতির পিতা বিভিন্ন এলাকাভিত্তিক খাদ্য মজুদের জন্য গুদাম গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন। যাতে খাদ্যটা নিরাপদে থাকে এবং দুর্যোগকালীন এর ব্যবহার করা যায়। তিনি বলেন, দুর্যোগের সময় আমাদের সবকিছুই ভেসে যায়, নষ্ট হয়। এজন্য এখন চিলিং সিস্টেমের সাইলো (খাদ্য গুদাম) করা হচ্ছে, ২/৩ বছরেও যেটাতে খাদ্য রাখলে নষ্ট হবে না। বগুড়ার সান্তাহারে এমন একটি খাদ্য গুদাম করা হয়েছে। মোংলাতে করছি, এ রকম বিভিন্ন এলাকাভিত্তিক করা হচ্ছে। দেশে বর্তমানে ২১ লাখ টন খাদ্য মজুদের সক্ষমতা রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এবারেও যখন বন্যা, হলো অতিবৃষ্টি হলো আমাদের হাওড়াঞ্চলসহ বিভিন্ন এলাকায় খাদ্য নষ্ট হলো। সঙ্গে সঙ্গে আমরা খাদ্যের ওপর ট্যাক্স কমিয়ে দিয়ে, খাদ্য কিনে মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা আমরা নিশ্চিত করেছি। সেখানে আমরা এতটুকুও কালক্ষেপণ করিনি। কেননা মানুষের খাদ্য চাহিদা হচ্ছে তার মৌলিক চাহিদা। সর্বপ্রথম তার খাদ্য চাহিদাটা পূরণ করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী এ সময় দেশকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে তাঁর সরকারের পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা এবং ১০ বছর মেয়াদী পরিপ্রেক্ষিত পরিকল্পনার উল্লেখ করেন এবং বিএনপি আমলে তাদের স্বল্পমেয়াদী এ্যাডহক ভিত্তিক পরিকল্পনা গ্রহণের কঠোর সমালোচনা করেন। দেশকে ভিক্ষুক বানিয়ে রাখতে আর বিদেশ থেকে এই কঙ্কাল সার রুগ্ণ জনগণকে দেখিয়ে টাকা নিয়ে এসে নিজেদের আখের গোছাতেই বিএনপি এমনটা করেছিল উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এটা হচ্ছে নীতির প্রশ্ন। বিএনপি সরকারের নীতিটাই ছিল তারা ভিক্ষুকের সর্দার হয়ে থাকতে চায়। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই দেশের মানুষের খাদ্য, পুষ্টি এবং স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করাসহ সার্বিক জীবন-যাত্রার মানোন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। মানুষকে উন্নত জীবন দেয়াই আমাদের লক্ষ্য। আর সে কারণে সরকার একের পর এক বিভিন্ন স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে।
×