ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

পররাষ্ট্রমন্ত্রী সম্মেলন শেষে যৌথ সংবাদ সম্মেলন রোহিঙ্গা নির্যাতনের ঘটনায় মিয়ানমারের জবাবদিহিতার জন্য মন্ত্রী ;###;পর্যায়ের কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত

ওআইসি শক্তিশালী করতে ৪ দফা প্রস্তাব বাংলাদেশের

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ৭ মে ২০১৮

 ওআইসি শক্তিশালী করতে ৪ দফা প্রস্তাব বাংলাদেশের

কূটনৈতিক রিপোর্টার ॥ রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের ঘটনায় মিয়ানমারের জবাবদিহিতার জন্য ইসলামী সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি) মন্ত্রীপর্যায়ের কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই কমিটি জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে একযোগে কাজ করবে। এছাড়া ওআইসির সংস্কার ও শক্তিশালী করতে চার দফা প্রস্তাব পেশ করেছে বাংলাদেশ। রবিবার ওআইসির ৪৫তম পররাষ্ট্র মন্ত্রীদের সম্মেলন শেষে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে এসব জানানো হয়। আগামী বছর ওআইসির পররাষ্ট্র মন্ত্রীদের সম্মেলন সংযুক্ত আরব আমিরাতে অনুষ্ঠিত হবে। রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে দুই দিনব্যাপী পররাষ্ট্র মন্ত্রীদের সম্মেলন (সিএফএম) রবিবার শেষ হয়েছে। সম্মেলন শেষে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন ওআইসির সিএফম চেয়ার ও পররাষ্ট্র মন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। এতে আরও বক্তব্য রাখেন ওআইসি মহাসচিব ইউসুফ এ আল ওথাইমিন। যৌথ সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্র মন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী জানান, আমরা সফলভাবে ৪৫তম ওআইসি পররাষ্ট্র মন্ত্রীদের সম্মেলন শেষ করতে সক্ষম হয়েছি। সম্মেলনে ৫৮টি দেশের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। এর মধ্যে ৫৩টি সদস্য রাষ্ট্র, তিনটি পর্যবেক্ষক রাষ্ট্র ও দুইটি অতিথি রাষ্ট্রের সদস্য ছিলেন। সম্মেলনে ২২ জন মন্ত্রী যোগ দিয়েছেন। ১৩ জন প্রতিমন্ত্রী-উপমন্ত্রী যোগ দিয়েছেন। এছাড়া ৫২টি সংস্থার প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রী জানান, সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রেখেছেন। তিনি তার রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে মিয়ানমারের ওপর চাপ দেয়ার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আহ্বান জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী মুসলিম বিশ্বের শান্তি ও উন্নয়নের লক্ষ্যে ৫ দফা পেশ করেছেন। এই ৫ দফা হলো- এক. ইসলামের মৌলিক বিশ্বাসের ওপর সকলকে আস্থাশীল হতে হবে। দুই. শান্তিপূর্ণ উপায়ে সকল বিবাদের সমাধান করতে হবে। আমাদের নিন্দুকদের কোন ধরনের হস্তক্ষেপ বা প্রভাব বিস্তারের সুযোগ না দিয়ে নিজেদের সমস্যা নিজেদেরই সমাধান করতে হবে। তিন. আমাদের আত্মসচেতন আলোকিত জীবনযাপন করতে হবে। আমাদের মৌলিক বিশ্বাসকে অটুট রেখে আজকের আধুনিক সমাজের সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রেখে জীবনযাপন করতে হবে। চার. দারিদ্র্য ও ক্ষুধা দূরীকরণ এবং জরুরী মানবিক দুরবস্থা মোকাবিলার জন্য ইসলামী সম্মেলন সংস্থার বলিষ্ঠ কর্মসূচীসহ একটি দ্রুত কার্যকর উন্নয়নমূলক কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা আবশ্যক। পাঁচ. ইসলামের শাশ্বত মূল্যবোধ যেমন শান্তি, সংযম, ভ্রাতৃত্ব, সমতা, ন্যায়বিচার ও সমবেদনা থেকে আমাদের সর্বদা অনুপ্রেরণা ও শক্তি আহরণ করতে হবে। আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেন, দুই দিনের সম্মেলনে মুসলিম বিশ্বের বর্তমান চ্যালেঞ্জ ও আগামী দিনের লক্ষ্য নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। সম্মেলনে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সহযোগিতা বাড়ানোর লক্ষ্যে ১২০টির বেশি রেজ্যুলেশন নেয়া হয়েছে। এরমধ্যে ২০টিরও বেশি রেজ্যুলেশন নেয়া হয়েছে রোহিঙ্গা সংকট, ফিলিস্তিন সমস্যা, সিরিয়া পরিস্থিতি, ওআইসি সংস্কার, নারীর ক্ষমতায়ন ও যুব উন্নয়ন বিষয়ে। সম্মেলনে বাংলাদেশ চার দফা পেশ করেছে। এই চার দফা হলো ওআইসি দেশগুলোর মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতা ও যোগাযোগ বৃদ্ধি। এসডিজি বাস্তবায়নের গণমাধ্যমের সহযোগিতা বৃদ্ধি। ওআইসির সংস্কার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ওআইসির বিশেষ চেয়ার প্রতিষ্ঠা। যৌথ সংবাদ সম্মেলনে ওআইসির মহাসচিব ইউসুফ এ আল ওথাইমিন বলেন, রোহিঙ্গা সংকট ও রাখাইনে নির্যাতনের জন্য মিয়ানমারকে জবাবদিহিতার মধ্যে আনার জন্য ওআইসি সম্মেলন থেকে মন্ত্রী পর্যায়ের এ্যাডহক কমিটি গঠন করা হবে। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত। এই কমিটি আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে কাজ করবে। তিনি আরও বলেন, শুধু মুসলিম বলেই রোহিঙ্গা সংকট গুরুত্বপূর্ণ নয়। এটা সমগ্র বিশ্বের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, কেননা এটা কোনো ধর্মীয় সংঘাত নয়। এটা মানবিক ও মানবাধিকারের বিষয়। সে কারণে বিশ্বের সকলেই রোহিঙ্গা সংকটের জন্য উদ্বিগ্ন। সূত্র জানায়, রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে ওআইসি দেশগুলো মন্ত্রী পর্যায়ের যে কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেখানে ১০ জন সদস্য থাকবে। তবে কোন কোন দেশ সদস্য থাকবে, সেটা পরবর্তীতে ঠিক করা হবে। যৌথ সংবাদ সম্মেলন শেষে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেন, ঢাকায় অনুষ্ঠিত ওআইসির পররাষ্ট্র মন্ত্রীদের ৪৫তম সম্মেলন সফল ভাবে সম্পন্ন হয়েছে। এর আগে ওআইসির সম্মলনগুলোতে একই সঙ্গে এতো দেশ অংশগ্রহণ করেনি। কারণ, এক দেশের সঙ্গে আরেক দেশের সম্পর্ক টানে পড়েন থাকায় তখন সেটি হয়নি। যা বংলাদেশের ক্ষেত্রে সম্ভব হয়েছে। শাহরিয়ার আলম বলেন, বাংলাদেশে এ সম্মেলন হওয়াটা আমাদের জন্য বড় অর্জন। প্রায় ৬ শতাধিক অতিথির ও বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিরা সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেছেন। এছাড়া ওআইসি সংস্কারে তুরস্কর সঙ্গে কাজ করবে বাংলাদেশ। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আগামীতে মুসলিম জনসংখ্যা বেশি আছে এমন দেশগুলোতে ওআইসির পর্যবেক্ষক হিসেবে রাখতে সংস্থাটিকে প্রস্তাব করেছে বাংলাদেশ। যেহেতু ওআইসি এখন শুধু মুসলিম দেশগুলোর মধ্যই আবদ্ধ নয়। ওআইসি এখন মুসলিম বিশ্বের সহযোগী হয়ে কাজ করছে। অনেক মুসলিম দেশের থেকেও বেশি সংখ্যক মুসলমান ভারত, কানাডা এবং যুক্তরাজ্যে বসবাস করছে। তিনি আরও বলেন, ওআইসি মানে , অর্গাইনাজেশন অব ইসলামিক কোঅপারেশন, নট কান্ট্রিস। শনিবার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ওআইসির পররাষ্ট্র মন্ত্রীদের ৪৫তম সম্মেলন শুরু হয়। দুই দিনব্যাপী আয়োজিত এই সম্মেলনের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এবারের সম্মেলনের প্রতিপাদ্য ছিল ‘টেকসই শান্তি, সংহতি ও উন্নয়নে ইসলামিক মূল্যবোধ’। রবিবার এই সম্মেলন শেষ হয়। আগামী বছর ওআইসির পররাষ্ট্র মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলন সংযুক্ত আরব আমিরাতে অনুষ্ঠিত হবে। ওআইসির সংস্কার ॥ এবারের ওআইসি পররাষ্ট্র মন্ত্রীদের সম্মেলনে ওআইসির সংস্কারের বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। বাংলাদেশের প্রস্তাবেও সংস্কার প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। কেননা অনেক মুসলিম সংখ্যা গরিষ্ঠ দেশের চেয়ে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ নয়, এমন অনেক দেশে মুসলমানের জনসংখ্যা বেশি। বিশেষ করে ভারত, যুক্তরাজ্য ইত্যাদি দেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ না হলেও এসব দেশে মুসলিম জনসংখ্যা কম নয়। বিশেষ করে ভারতে প্রায় ১৮ কোটি মুসলিম জনসংখ্যা রয়েছে। সে কারণে এসব দেশকেও পর্যবেক্ষক দেশ হিসেবে রাখা যেতে পারে। বাংলাদেশের এই প্রস্তাবে বেশির ভাগ দেশই একমত হয়েছে। সে কারণে তুরস্ক-বাংলাদেশ একযোগে এই সংস্কার প্রক্রিয়া নিয়ে কাজ করবে। রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে গাম্বিয়ার প্রস্তাব ॥ রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের ঘটনায় মিয়ানমারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে ওআইসি পররাষ্ট্র মন্ত্রীদের সম্মেলনের শেষ দিনে রোহিঙ্গা বিষয়ক সেশনে প্রস্তাব দেয় গাম্বিয়া। গাম্বিয়ার দেয়া প্রস্তাব অনুসারে ওআইসির মন্ত্রী পর্যায়ে এ্যাডহক কমিটি গঠনের প্রস্তাবে সম্মত হয় সদস্য দেশগুলো। মুক্ত আলোচনায় অংশ নিয়ে বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা বলেন, মিয়ানমারকে রোহিঙ্গা নির্যাতন ও বিতাড়নের জন্য অবশ্যই জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। এরজন্য ওআইসির সদস্য দেশগুলোকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। তারা বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যা শুধু বাংলাদেশ-মিয়ানমার সমস্যা নয়, এটি আন্তর্জাতিক সমস্যা। সব জাতিকেই এই সমস্যার দায় নিতে হবে বলে তাদের বক্তব্যে উল্লেখ করেন। বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নিয়ে তারপর প্রতি মানবিক আচরণ করতে মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানান বক্তারা। রোহিঙ্গা ইস্যুতে ওআইসির চুপ করে বসে থাকার সুযোগ নেই বলেও মন্তব্য করেন তারা। বাংলাদেশের পাশে থাকার প্রত্যয় ব্যাক্ত করেন তারা। সেশনে পররাষ্ট্র মন্ত্রী মাহমুদ আলী অভিযোগ করেন রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে বাংলাদেশ তালিকা দিলেও মিয়ানমার খুব স্বল্পসংখ্যককে নিতে সম্মত হয়েছে। তালিকার ব্যাপারে দেশটি সমস্যা তৈরি করছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি। শীঘ্রই নতুন তালিকা দেয়ার কথা জানান পররাষ্ট্র মন্ত্রী। রোহিঙ্গা বিষয়ক এই সেশনে কানাডার প্রধানমন্ত্রীর রোহিঙ্গা বিষয়ক বিশেষ দূত বব রে বক্তব্য রাখেন। তিনি বলেন, রোহিঙ্গা সংকট মিয়ানমারের কোন অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়। এটা একটি আন্তর্জাতিক বিষয়। এটা মানবাধিকারের বিষয়। তাই এই সংকট সমাধানে বিশ্বের সকলকেই এগিয়ে আসতে হবে। ৩৯ দফা যৌথ ঘোষণা ॥ ঢাকায় ওআইসির পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের ৪৫তম সম্মেলন শেষে ৩৯ দফা যৌথ ঘোষণা দেয়া হয়। এই ঘোষণায় মিয়ানমারের রাখাইন জনগোষ্ঠীর ওপর জাতিগত নিধনের জন্য গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের দাবি জানানো হয়। ঘোষণায় ফিলিস্তিনের জনগণের ওপর ইসরায়েলের আগ্রাসন নীতির নিন্দা জানানো হয়। ওআইসি দেশগুলো একযোগে সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ প্রতিরোধে কাজ করার ঘোষণা দেয়া হয়। ওআইসি দেশগুলোর দীর্ঘমেয়াদে টেকসই উন্নয়ন, আর্থসামাজিক উন্নয়ন, পর্যটন বৃদ্ধিতে একে অপরের মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধির ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়।
×