ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

শাহরিয়ার কবির

‘মিথাতের স্বপ্ন’ নির্মাণের ইতিবৃত্ত

প্রকাশিত: ০৪:৫০, ৭ মে ২০১৮

‘মিথাতের স্বপ্ন’ নির্মাণের ইতিবৃত্ত

॥ পর্ব-২ ॥ বেচারা মুরাত! নাশতা মাত্র শুরু করতে যাচ্ছিল, আমার কথায় ছুটে গেল ক্যামেরা আনার জন্য। ‘দারভিশ লজে’র খাবার ঘরে ফরিদার সঙ্গে কথা বলে চমৎকৃত হয়েছিলাম। বললেন, তার বয়স এখন আশির কাছে। প্যারিসের বিখ্যাত সর্বোন ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপনা করতেন। সুফীবাদ নিয়ে গবেষণার সুবাদে বহু দেশ ঘুরেছেন। পাকিস্তানে সুফীবাদের ওপর বইও লিখেছেন। অনেক ঘুরে পছন্দ হয়েছে তুরস্ক। বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে গত তিরিশ বছর ধরে তুরস্কের প্রাচীন পাহাড়ী শহর কাপাদোকিয়ায় আছেন। প্রতি বছর রুমির জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকীতে কোনিয়া আসেন। রুমির মৃত্যুবার্ষিকীকে তাঁর ভক্ত ও অনুসারীরা বলেন বিবাহবার্ষিকী। যে প্রিয়তমকে পাওয়ার জন্য সুফীরা সারাজীবন সাধনা করেন, অপেক্ষা করেন, মৃত্যু সেই দীর্ঘ বিরহের অবসান ঘটায়। সুফীদের কাছে মৃত্যু বেদনার নয়, আনন্দের। সবচেয়ে আপনজনের সঙ্গে মিলিত হওয়ার আনন্দ। রুমির অনুসারীদের সেমা নৃত্য এক অর্থে স্রষ্টার সঙ্গে মিলিত হওয়ার আনন্দযাত্রা। মিথাত বলেছে, সেমা হচ্ছে অন্ধকার থেকে আলোর পথে যাত্রা। ডিসেম্বরে মিথাতের সদ্য বিবাহিত স্ত্রীর সঙ্গেও পরিচয় হয়েছে। ইস্তান্বুলের শিল্পী আসলাকে ভালবেসে বিয়ে করেছে মিথাত। পরিচয় ও প্রেম দেড় বছরের। মিথাত অত্যন্ত সুদর্শন মিতভাষী যুবক, যে কোন মেয়েই ওর প্রেমে পড়তে পারে। তারপরও আসলাকে প্রশ্ন করেছিলাম একজন দরবেশকে কেন বিয়ে করতে আগ্রহী হলো। মিথাতের সঙ্গে আসলার পরিচয় হয়েছে ফেসবুকে। অত্যন্ত সৎ ও ভাল মানুষ মনে হয়েছে মিথাতকে। আসলা শিল্পকর্ম পছন্দ করে। বলল, অনেক দরবেশ ছবি আঁকেন। ছবি মানে নকশা, ফুল, ক্যালিগ্রাফী। আরবি ক্যালিগ্রাফী আসলার পছন্দ। মিথাত নিজেও ছবি আঁকা পছন্দ করে। তিন বছর ধরে ও বাঁশি বাজানো শিখছে। ওদের একটা যন্ত্রসঙ্গীতের শৌখিন ব্যান্ড দলও আছে। সুফীদের শিল্প ও সৌন্দর্যবোধ আসলাকে আকৃষ্ট করেছে মিথাতের প্রতি। ধর্মের নামে বর্তমান বিশ্বে ওহাবি-সালাফি-মওদুদিবাদীরা যে সন্ত্রাস ও হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে এটাকে মিথাত জেহাদ মনে করে না। মিথাত বলেছে, ইসলাম কখনও নরহত্যা ও সন্ত্রাস সমর্থন করে না। প্রকৃত জেহাদ হচ্ছে নিজের ‘নফস’কে (অহংবোধ) হত্যা করা; ঘৃণা, বিদ্বেষ আর ক্রোধের মতো কুপ্রবৃত্তিগুলো নির্মূল করা। মিথাতের সাহিত্য ও শিল্পবোধ আমাকে মুগ্ধ করেছে। বিদেশী সাহিত্যে ওর প্রিয় লেখক শেকভ ও শেক্সপীয়ার। মিথাত চলচ্চিত্র দেখা পছন্দ করে। তুর্কী পরিচালকদের ভেতর ওর প্রিয় সেমি কাপলানল্, যার একটি মাত্র ছবি আমি দেখেছি। মিথাত ওর সদ্যনির্মিত ছবি ‘গ্রেইন’-এর কথা বলেছে। টার্কিশ এয়ারলাইন্সে লন্ডন যাওয়ার পথে দেখেছি, অসাধারণ ছবি। বিদেশী চিত্রনির্মাতাদের ভেতর মিথাতের প্রিয় হচ্ছে তারকোভস্কি। কোনিয়ার এক তরুণ, যে দরবেশ হওয়ার সাধনার পাশাপাশি সুফীদের দর্শন চর্চা করে, সেমা সাধনা করে, শেক্সপীয়ারের কবিতা আর শেকভের গল্প পড়ে, তারকোভস্কি ও সেমি কাপলানলর ছবি দেখে, বাঁশি বাজায়- এই মিথাতই আমার নতুন ছবি বিষয়। যে স্বপ্ন দেখে একদিন পৃথিবী যুদ্ধ, হানাহানি, ঘৃণা ও অসহিষ্ণুতার অভিশাপ থেকে মুক্তি পাবে। মিথাতের বক্তব্য ছাড়াও ৩৫ মিনিটের এ ছবিতে তুরস্কের সুফীতত্ত্ব গবেষক, লেখক ও দরবেশদের বক্তব্য রয়েছে রুমি ও তাঁর সমসাময়িক অন্যান্য সুফীদের সম্পর্কে। যাদের সঙ্গে কথা বলেছি তাদের ভেতর উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন, রুমির ২২তম বংশধর ‘ইন্টারন্যাশনাল মেভলানা ফাউন্ডেশন’-এর প্রধান মাদাম এসিন চেলেবি বায়রু। রুমির মাজারের পাশেই তার সংগঠনের দফতর প্রচুর ভক্ত ও দর্শনার্থী। চমৎকার ইংরেজী বলতে পারেন, রুমি ও সুফীবাদ সম্পর্কে জানাবার জন্য বহু দেশে গেছেন। কথা প্রসঙ্গে জানালেন দুই মাস পরেই পাকিস্তান যাচ্ছেন সেমা নৃত্য প্রদর্শনের জন্য। ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তায় দেশে ফিরে মিসর থেকে আমন্ত্রণ পেলাম এপ্রিলে কায়রো যাওয়ার জন্য। জঙ্গী মৌলবাদী সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আমার বি-মৌলবাদীকরণ ব্যবস্থাপত্রের জন্য লন্ডনের ‘ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অব প্রেস, মিডিয়া ক্রিয়েটিভিটি এ্যান্ড কমিউনিকেশন টেকনলজি’র কায়রো শাখা মার্চের যে কোন সময়ে আমাকে সংবর্ধনা প্রদান করতে আগ্রহী। সংগঠনের সভাপতি ড. গেমাল বাদরাওয়েকে জানালাম মার্চে আমি সুফীবাদের ওপর প্রামাণ্যচিত্রের সম্পাদনা এবং নির্মূল কমিটির অন্যান্য কাজে ব্যস্ত থাকব; এপ্রিলে যেতে পারি। তবে সংবর্ধনার বিষয়ে আমার আপত্তির কথা জানিয়ে বললাম, আপনারা মৌলবাদের বিরুদ্ধে একটি আঞ্চলিক সম্মেলন বা সেমিনার আয়োজন করুন। মৌলবাদের বিরুদ্ধে লড়বার জন্য সংগঠনও প্রয়োজন। মিসরে আমাদের নির্মূল কমিটির সহযোগী সংগঠন হিসেবে ‘ফোরাম ফর সেকুলার ইজিপ্ট’ গঠনের উদ্যোগ নিন। ইংরেজীতে আমাদের ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’কে সংক্ষেপে ‘ফোরাম ফর সেকুলার বাংলাদেশ’ বলি। ড. বাদরাওয়ে আগ্রহের সঙ্গে আমার প্রস্তাবে সম্মত হলেন। সেই সঙ্গে তাদের সেমিনারে নির্মিয়মান ‘মিথাতের স্বপ্ন’ প্রদর্শনে আগ্রহ প্রকাশ করলেন। এপ্রিলে কায়রো যাওয়া ঠিক হওয়ার পর মিথাতকে জানালাম, তোমাকে নিয়ে যে ছবিটা বানাচ্ছি ওটা ১৮ এপ্রিল কায়রো দেখানো হবে। এত তাড়াতাড়ি ছবির কাজ শেষ করব মিথাত ভাবতে পারেনি। ও বলল, কায়রোয় প্রদর্শনের আগে এ ছবি কোনিয়ায় দেখানো উচিৎ। কোনিয়ার সাংবাদিক বন্ধু ইব্রাহিমেরও একই অভিমত। গত ডিসেম্বরে এ ছবির প্রস্তুতি সম্পর্কে ইব্রাহিম ওর পত্রিকা ‘মেরহাবা’য় দীর্ঘ সচিত্র প্রতিবেদন ছেপেছিল। ইস্তাম্বুল থেকে লেখক বন্ধু তারিক গুনেরসেল লিখলেন, কায়রোর সেমিনারে তাকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। আমি যেন ইস্তাম্বুল হয়ে কায়রো যাই। আমার তুরস্ক যাওয়ার কথা শুনে বন্ধু মুনতাসীর মামুন বললেন, তিনিও আমার সঙ্গে যাবেন। মামুন শুধু আমার সঙ্গী হয়ে তুরস্ক যাবেন এটা ঠিক মনঃপূত হচ্ছিল না। যত ঘনিষ্ঠ বন্ধু হই না কেন, মুনতাসীর মামুন এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু অধ্যাপক। ইস্তাম্বুলে আমাদের সদাব্যস্ত কনসাল জেনারেল মনিরুল ইসলামকে লিখলাম আমাদের তুরস্ক যাওয়া সম্পর্কে। তিন দিন পর তিনি জানালেন, শুধু কোনিয়া নয়, ইস্তাম্বুলেও তারা আমার ছবির প্রদর্শনী করতে আগ্রহী। ইস্তাম্বুল বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যৌথভাবে তারা একটি সেমিনারও করবেন। বিষয় হচ্ছে ‘বাংলাদেশ-তুরস্ক মৈত্রী : ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট।’ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন হবেন সেমিনারের প্রধান বক্তা। ইস্তাম্বুল বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য অধ্যাপকরাও আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন। মামুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তুরস্কের ইতিহাসও পড়িয়েছেন। সেমিনারের বিষয়ে তার আপত্তি থাকার কথা নয়। ঢাকায় নির্মূল কমিটির অনুষ্ঠান ছিল ১০ এপ্রিল, যেখানে মামুন আর আমার উপস্থিত থাকার কথা। এর পরদিন টিকেট কাটলাম ইস্তাম্বুল যাওয়ার। কায়রোর টিকেট আগেই পাঠিয়েছিল আয়োজক সংগঠন। ‘মিথাতের স্বপ্ন’ প্রথম প্রদর্শিত হয়েছে তুরস্কের কোনিয়ায় এপ্রিলের ১৪ তারিখ। ১৬ তারিখে ইস্তাম্বুলে এবং ১৮ এপ্রিল কায়রোয়। উদ্বোধনী প্রদর্শনীতে তুরস্কে নিযুক্ত আমাদের রাষ্ট্রদূত আল্লামা সিদ্দিকী, কোনিয়ার গবর্নর মেহমেত কামিল সাগলাম, মাদাম এসিন চেলেবি ও আয়োজক প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার ফাহরি ওযচাকলসহ কোনিয়ার সরকারী কর্মকর্তা এবং গণ্যমান্য ব্যক্তিরা ছিলেন। মিথাতের স্ত্রী, মা এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্য ও বন্ধুরাও এসেছিলেন। গায়ক আশিকের সঙ্গীত এ ছবিতে ব্যবহার করেছি, তিনি এসেছিলেন। আরও ছিলেন কোনিয়ার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত বাংলাদেশী ছাত্ররা। এদের ভেতর পিএইচডি করছেন রহমতউল্লাহ, যিনি ঢাকার একটি পত্রিকা ও টেলিভিশনের স্থানীয় প্রতিনিধি। ছবি দেখে মিথাত অভিভূত। বলল, রুমিকে নিয়ে তুরস্কে এবং পশ্চিমে অনেক ছবি হয়েছে। ওর দেখা সব ছবির সেরা হচ্ছে এটি। জানতে চাইলাম, ওর মার কেমন লেগেছে। মিথাত বলল, মা আনন্দে কেঁদেছেন। কোনিয়ার গবর্নর বললেন, এ ছবির তুর্কী ভাষ্য তারা দেখতে চান। ইব্রাহিম আগেই জানিয়েছিল- ওদের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা হয়েছে। আগামী বছর কোনিয়ায় প্রথম আন্তর্জাতিক সুফী চলচ্চিত্র উৎসব হবে। উৎসবের উদ্বোধনী অধিবেশনে ‘মিথাতের স্বপ্ন’ প্রদর্শনে তারা আগ্রহী। সবার এক কথা- এ ছবির তুর্কী ভাষ্য নির্মাণ করতে হবে। লেখক বন্ধু তারিক গুনেরসেল বর্তমান ইংরেজী ভাষ্যে রুমির কবিতা ও গান অনুবাদে সাহায্য করেছেন। তুর্কি ভাষা সম্পর্কে আমার অসহায়ত্বের কথা শুনে তারিক বললেন, ধারাভাষ্যসহ যা যা দরকার সব তিনি অনুবাদ করে দেবেন। রাতে কোনিয়ার টেলিভিশনে আমাকে নিয়ে প্রায় এক ঘণ্টার অনুষ্ঠান হলো। পরদিন কোনিয়ার বিভিন্ন দৈনিকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে ‘মিথাতের স্বপ্ন’ প্রদর্শনের খবর ছাপা হয়েছে। ফেরার পথে ইস্তাম্বুলে বিখ্যাত সুফী সঙ্গীতশিল্পী হাকান মেনজুসের ‘সুফী একাডেমি’ অনুরোধ জানিয়েছে এ ছবির দ্বিতীয় ভাগ নির্মাণের জন্য। তুরস্কের সকল ব্যয় তারা বহন করবে। আমি ভাবছি হাকানকে বাংলাদেশে আনব। রুমি থেকে লালন পর্যন্ত মানবিকতার দর্শন কিভাবে দুই দেশের মানুষের চেতনাকে প্রভাবিত করেছে সেটা তুলে ধরব। মৌলবাদীরা কখনও সরকারে থাকতে পারে, সন্ত্রাস ও হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করার সক্ষমতাও তারা রাখে। তবে সাধারণ মানুষ- তুরস্ক, মিসর, বাংলাদেশে সবাই শান্তি ও মানবতার পক্ষে। বিশ্বের সর্বত্র শান্তিকামী এই মানুষই সভ্যতার চালিকাশক্তি। (সমাপ্ত)
×