ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

যৌন নিগ্রহ কি বন্ধ হবে না!

প্রকাশিত: ০৪:৪৭, ৭ মে ২০১৮

যৌন নিগ্রহ কি বন্ধ হবে না!

দেশে যত ধর্ষণ মামলা দৃশ্যমান, ঘটনা তার চেয়েও তুলনামূলক বেশি। স্কুল, কলেজ, যানবাহন, কর্মক্ষেত্র, বাজার, এমনকি বইয়ের লাইব্রেরিতেও চলছে সীমাহীন উৎপীড়ন। অপহরণের পর নারী ও শিশু ধর্ষণের মতো ঘৃণ্য ঘটনা থামেনি। উপরন্তু এ ধরনের ঘটনা ঘটানোর পর ভিকটিমদের হত্যাও করা হচ্ছে। অনেক সময় নানা কারণে থানায় মামলা হচ্ছে না। অনেক ঘটনা টাকার বিনিময়ে সমঝোতা হয়ে যায়। তারপরও যেসব পরিবারের কোনটির মধ্যেই থাকে না, সেসব পরিবারের একমাত্র আশার আলো জ্বালাচ্ছে ‘ট্রাইব্যুনালে আবেদন।’ ঢাকার পাঁচটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে গত পনেরো বছরে ঢাকা মহানগর ও উপজেলা মিলিয়ে ৫৭টি থানা থেকে সাড়ে ৫ হাজার ৫০২টি মামলা এসেছে। যার মধ্যে ২ হাজার ৮৯৮টি নিষ্পত্তি হয়েছে। ধর্ষণ কি? তা বোঝাতে ২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনটি ১৮৬০ সালের ফৌজদারি দ-বিধির ৩৭৫ ধারাকে ভিত্তি করেছে। আইনে ১৮০ দিনের মধ্যে মামলার সব প্রক্রিয়া শেষ হওয়া অত্যাবশ্যক। তবুও এমন নজির দৃশ্যমান যে বছরের পর বছর ধরে মামলা চলছে। আর আদালতে বিচারের জন্য কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে ধর্ষিত নারী বা শিশুকে ধর্ষণের অভিজ্ঞতার মধ্যদিয়ে ধর্ষিত হতে হচ্ছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে, ধর্ষণ পরবর্তী সময়ে একজন ধর্ষিতা যে ধরনের মানসিক ও শারীরিক পীড়ায় ভোগেন, তাকে বলে পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার (পিটিএসডি)। যা সাধারণত যুদ্ধে অবতীর্ণ মানুষের যুদ্ধ জীবনের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার দ্বারা সৃষ্টি হয়ে থাকে। তাছাড়া ধর্ষণের প্রমাণ অনেকাংশে ডাক্তারি পরীক্ষার ওপর নির্ভরশীল। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার (দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া) সাবেক উপদেষ্টা ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মোজাহেরুল হকের অভিমত, ধর্ষণে আমাদের প্রচলিত পরীক্ষা পদ্ধতিটি বিজ্ঞানসম্মত নয় যা পাশ্চাত্য দেশগুলোতে নিষিদ্ধ। কারণ, এতে ভুক্তভোগীর মানসিক ও শারীরিক আঘাত আরও বেড়ে যায়। এমতাবস্থায় বিচার প্রক্রিয়া দ্রুত শেষ করার প্রয়োজনীয়তায় নারী ও শিশু অধিকার কর্মীরা উদগ্রীব হয়ে উঠলে অনেক সময় আইনজীবীদের কারণে বিচার ঝুলে থাকে। অনেক সময় প্রয়োজনীয় প্রমাণাদির ঘাটতি থাকায় প্রতীয়মান হয় যে, ধর্ষকের অপরাধ ততটা গুরুতর নয়, যতটা ধর্ষিতা বলেছে। সেক্ষেত্রে হয় অপরাধীর লঘু শাস্তি হয়, নতুবা মামলাটি মিথ্যা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সাব্যস্ত হয়ে আসামি খালাস পায়। ফলে মামলা করা বিরাট কর্মযজ্ঞ জেনেও এগিয়ে আসা সেই নির্যাতিত পরিবারটির উপর নেমে আসে আতঙ্ক আর ভয়। কেননা, সমাজ মেয়েটিকে দোষী বলে মনে করে। ধর্ষিতা ওই কুমারী বা বিবাহিতা মহিলার ত্রুটিপূর্ণ কোন আচার-আচরণ বা পোশাকাদির কারণেই তিনি ধর্ষণের শিকার হয়েছেন বলে মানুষ স্বাভাবিকভাবেই মনে করেন। অনেক সময় সামাজিক গ্লানি এতটাই পাশবিক হয়ে উঠে যে, সপরিবারে আত্মাহুতি দিতে হয়। যা পূর্বে বহুবার সংঘটিত হলেও দৃশ্যপটে যেন আমাদের বোবা অনুভূতিগুলো দিন দিন ভোতা হয়েই চলেছে। এভাবে আইনের প্রতি সম্মান প্রদর্শন যেমন ব্যাহত হচ্ছে- ঠিক তেমনি সামাজিকভাবে ধর্ষকদের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক প্রতিরোধ গড়ে উঠছে না। তাই তো ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) ধর্ষিতার সঠিক হিসেব এখনও অনির্দিষ্ট, যেখানে বাস্তবিক প্রেক্ষাপটে গড়ে প্রতিদিনই সারাদেশ থেকে আসা ধর্ষিতার সংখ্যা আনুপাতিক হারে ক্রমশ বাড়ছে। বিশ শতকের গোড়া থেকে বিভিন্ন সমাজবিদ তাদের গবেষণার তত্ত্বে নানাভাবে নারী নির্যাতনের তথা নারীর সার্বিক বৈষম্য পীড়িত, শোষিত ও বঞ্চিত অবস্থার নিখুঁত চিত্র তুলে ধরেছেন। এভাবে একদিকে যখন চলছে নারী স্বাধীনতা, নারী আন্দোলন, নারী অধিকার নিয়ে সর্বত্র আলোচনা, সমালোচনা ও বক্তৃতা অন্যদিকে প্রতিনিয়ত স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা এবং পুলিশি তথ্যে ধষর্ণের বহু লোমহর্ষক ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বিকৃত মানসিকতায় মেয়েদের কেবল শ্লীলতাহানিই ঘটছে না, তাদের এরূপ নিরাপত্তাহীনতা দেশের ভাবমূর্তিকেও করে তুলছে প্রশ্নবিদ্ধ। মূলত, শক্তিশালী আইনের যেমন কোন বিকল্প নেই তেমনি বিকল্প নেই সমাজ পরিবর্তনের। অন্যথায় বাংলাদেশ-ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার নারীরা যৌন নিগ্রহের শিকার হতেই থাকবে আর অপরাধীরা বিচরণ করবে মুক্ত বিহঙ্গের মতো। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট মোতাবেক, বিশে^র এক তৃতীয়াংশ নারী যৌন নির্যাতনের শিকার এবং ৭ শতাংশেরও বেশি নারী তাদের বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতায় মুখবন্ধ রাখেন। অথচ জীবনের কোন না কোন সময় তারা নির্যাতিত বা ধর্ষিত হয়েছেন। আমরা মানুষ, ধর্ষিতাও মানুষ! তাদের ক্ষেত্রে কেন হবে দুষ্প্রাপ্য ‘মানবিক মূল্যবোধ’! সামাজিক অবক্ষয় রোধে আমাদের অত্যন্ত সচেতনভাবে পরিবর্তন আনয়ন করতে হবে তবেই আইনের সঠিক প্রয়োগ সম্ভব। পাশাপাশি পরিবারের প্রতিটি নারীর উচিত হবে নিজেকে ছোটবেলা থেকে আত্মনির্ভর করে গড়ে তোলা, কোন পুরুষের বাজে স্পর্শে সংকুচিত না হয়ে প্রতিবাদ করা। এমনকি পরিবারের প্রতিটি ছেলে বা পুরুষকে নারীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। বাবা-মায়ের উচিত হবে তাদের সন্তানকে এমনভাবে গড়ে তোলা, যাতে একজন নারীকে অসম্মান করার পূর্বে তার বিবেক জাগ্রত হয়। সর্বোপরি, ‘সমাজের পরিবর্তন তখনই আসবে যখন পরিবারের পরিবর্তন সাধিত হবে।’ লেখক : গবেষক
×