ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

পাতালে হাসপাতালে

প্রকাশিত: ০৪:৪৫, ৭ মে ২০১৮

পাতালে হাসপাতালে

ঐতিহ্যবাহী ও সুখ্যাত ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে বর্তমানে আদৌ কোন ব্যবস্থাপনা আছে বলে মনে হয় না। তা না হলে একের পর এক তথাকথিত ভুল ও অমানবিক কাজকর্ম ঘটছে কিভাবে? গরম ডালে পুড়ে যাওয়া দেড় বছরের একটি শিশুকে মর্গের হিমঘরে রাখার মাত্র তিন ঘণ্টার মধ্যেই ইঁদুর কিংবা বেজিতে খেয়ে ফেলে তার মুখমন্ডল- এটা কিভাবে সম্ভব? অন্যদিকে মে দিবসের ভোর বেলা এক প্রসূতির ঘোষিত নবজাতক ছেলে অপরাহ্ণে মেয়ে বলে চালিয়ে দেয়ার ঘটনার ব্যাখ্যাই বা কী হতে পারে? সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক, নার্স, আয়া, ওয়ার্ডবয় অথবা হাসপাতালের পরিচালক এসব ঘটনাকে নিছক ভুল বলেই খালাস পেতে চান! কতটা দায়িত্বহীন, কর্তব্যবিমুখ ও অমানবিক হলে ঢামেক কর্তৃপক্ষ এহেন অপকর্মের সাফাই গাইতে পারেন? ইতোপূর্বে ঢামেকের বিরুদ্ধে এ্যাম্বুলেন্স চাপা দিয়ে মানুষ হত্যার অভিযোগও উঠেছে, যার মালিক উক্ত হাসপাতালেরই ওয়ার্ডবয়। প্রশ্ন হলো এ রকম অব্যবস্থাপনা ও দায়িত্বহীনতা আর কত দিন? তবু স্বীকার করতে হবে যে, দেশের সরকারী হাসপাতালগুলোতে অল্পবিস্তর চিকিৎসাসুবিধা মেলে। বর্তমান সরকারের আন্তরিক উদ্যোগে বিভিন্ন সরকারী হাসপাতালে জনবল পর্যাপ্ত না হোক, কমবেশি বাড়ানো হয়েছে। ওষুধপত্রসহ চিকিৎসা উপকরণের সরবরাহও আশানুরূপ। এক্স-রেসহ রোগীদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ-সুবিধাও আছে। আছে ডাক্তার, নার্স, আয়া, ওয়ার্ডবয় এমনকি নিরাপত্তা ব্যবস্থা। তাদের বেতন-ভাতাও বেড়েছে অনেক। অপ্রিয় হলেও সত্য যে, এতকিছুর পরও সরকারী হাসপাতালের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ তথা রোগীদের অভিযোগের অন্ত নেই। এসব হাসপাতালে প্রায় বিনামূল্যে অথবা স্বল্পমূল্যে চিকিৎসাসুবিধা পাওয়া যায় বিধায় অপেক্ষাকৃত মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত, ও গরিব মানুষ স্বভাবতই ভিড় জমিয়ে থাকেন। সারাদেশের গ্রামগঞ্জ থেকেও রোগীরা এসে ভিড় জমান রাজধানীতে, যারা একটু জটিল রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হন। এ কারণেই রাজধানীর হাসপাতালসহ বিশেষায়িত হাসপাতালগুলোতে রোগীদের প্রচ- ভিড় পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। সেই অনুপাতে থাকে না রোগীর শয্যা, ওষুধপত্র, রোগ নির্ণয়সহ আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা, সর্বোপরি পর্যাপ্ত ডাক্তার-নার্স ইত্যাদি। অতঃপর রোগীরা প্রায় জিম্মি হয়ে পড়েন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে। অনেক সরকারী হাসপাতালেই শয্যার অভাবে রোগীদের দেখা যায় মেঝে ও বারান্দায় গাদাগাদি করে শুয়ে থাকতে। সিন্ডিকেট বাণিজ্য শুরু হয় এখান থেকেই। জরুরী বিভাগে একজন রোগীকে নামানোর পর থেকেই শুরু হয়ে যায় ওয়ার্ডবয় ও দালালদের দৌরাত্ম্য। সেখানে রোগীদের বহনের জন্য ট্রলি কিংবা হুইলচেয়ার পেতেও অর্থ খরচ করতে হয়। অনুরূপ অভিজ্ঞতার প্রমাণ মেলে মিটফোর্ড, পঙ্গু, হৃদরোগ, সংক্রামকব্যাধি, ক্যান্সার, চক্ষু হাসপাতালসহ প্রায় সর্বত্র। দুঃখজনক হলো, একটি আদর্শ তথা মডেল হাসপাতাল তো দূরের কথা, মোটামুটি মানসম্মত চিকিৎসা মেলে এবং অনিয়ম-দুর্নীতিও অপেক্ষাকৃত কম, এমন একটি হাসপাতালও নেই বললেই চলে। সরকারী হাসপাতালের সব চিকিৎসক-নার্স-আয়া-ওয়ার্ডবয় খারাপ ও দুর্নীতিগ্রস্ত এমন কথা বলা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। তবে অধিকাংশ খারাপ এবং অনিয়ম দুর্নীতির ভিড়ে ভালটুকু প্রায়ই হারিয়ে যায়। দীর্ঘদিন থেকে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেটের খপ্পরে পড়ে রোগীরা হয়ে পড়েন জিম্মি। মুষ্টিমেয় ভালরা হয়ে পড়েন কোণঠাসা। আধিপত্য বিস্তার করে অসৎরা। হাসপাতালের ওষুধপত্র পাচার হয়ে যায় বাইরে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার নামে রোগীর কাছ থেকে হাতিয়ে নেয়া হয় গুচ্ছের টাকা। রাজনৈতিক দলবাজির কারণে আরও শক্তিশালী ও অপ্রতিহত হয়ে উঠেছে সিন্ডিকেট। প্রধানত অর্থ আত্মসাতসহ আন্তরিকতার অভাবেই ভাঙ্গা যাচ্ছে না সিন্ডিকেটের অনৈতিক প্রভাব ও আধিপত্য। রোগী ও স্বজনরা মিলে যদি একযোগে এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন এবং কঠোর হয় সরকার তথা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, তাহলে এর দৌরাত্ম্য কমলেও কমতে পারে।
×