ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

শাহাব উদ্দিন মাহমুদ

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও বাংলাদেশের প্রস্তুতি

প্রকাশিত: ০৬:৩৯, ৬ মে ২০১৮

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও বাংলাদেশের প্রস্তুতি

(গতকালের পর) বনভূমি উজাড় একটি পূর্ণবয়স্ক মাঝারি গাছ প্রস্বেদনের মাধ্যমে দিনে ১০০ গ্যালন পানি বায়ুম-লে ছড়ায়। শিল্পায়ন ও ঘর-বাড়ি তৈরির জন্য কিছু গাছপালা কাটা পড়ে। আমরা হর হামেশাই দেখতে পাই বিভিন্ন সংস্থার আবাসিক প্রকল্পের দোহাই দিয়ে বড় বড় জলাশয় ভরাট করা হয়, নির্বিচারে গাছ কেটে বালি ফেলে সবুজ শ্যামল প্রকৃতিকে সাহারা মরুভূমিতে পরিণত করা হয়, তখন ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে হৃদয়। যে কোন মূল্যে প্রয়োজন জীবনের স্পন্দন পানি ও অক্সিজেনের উৎসসমূহকে সুরক্ষিত রাখা, প্রকৃতিকে তার স্বাভাবিক গতিতে চলতে দেওয়া। বৃক্ষ রোপণ কার্যক্রমকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে সবুজ বন সৃজন করা সময়ের দাবি। প্রকৃতিকে পরিমিত শাসন সভ্যতার ক্রমবিকাশের জন্য অপরিহার্য। কিন্তু তা অতি শাসনে রূপ নিলেই ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্ব অনুযায়ী প্রকৃতি মানুষের ওপর প্রতিশোধ নেবেই-নেবে। প্রকৃতিকে ক্ষতবিক্ষত ও রিক্ত না করে সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে উন্নয়ন ঘটালে, আমাদের মাতৃভূমি হবে বাসযোগ্য এবং আমরা থাকব নিরাপদ ও সুরক্ষিত। বাংলাদেশের প্রস্তুতি অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, বন্যা, খরা, সামুদ্রিক ঝড়, জলোচ্ছ্বাস ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাংলাদেশের ইতিহাসে নতুন কোন ঘটনা নয়। কিন্তু বিশ্বজুড়ে নগরায়ণ, শিল্প বিপ্লব, নির্বিচারে বন নিধন ইত্যাদি অনিয়ন্ত্রিত কর্মকা-ে পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ব্যপ্তি, প্রকোপ ও আবর্তকাল এ জনপদকে আরও ঝুঁকিপূর্ণ করেছে। সে সঙ্গে যোগ হয়েছে প্রাকৃতিক দুর্যোগের নতুন মাত্রা যেমন- জলাবদ্ধতা, মরুময়তা, উপকূলীয় অঞ্চলের খানিকটা (২০ শতাংশ) সমুদ্রগর্ভে তলিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা, উপকূলীয় কৃষি জমির লবণাক্ততা বৃদ্ধি এবং সর্বোপরি খাদ্য নিরাপত্তার হুমকি। বাংলাদেশ আজ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগের চরম ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর অন্যতম। বাংলাদেশকে এ জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য কোনভাবেই দায়ী করা না গেলেও এ দেশ জলবায়ু পরিবর্তনে সৃষ্ট বিরূপ প্রভাবের নির্মম শিকার। সরকার এ সমস্যা মোকাবেলায় ইতোমধ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে যেমন- প্রাকৃতিক দুর্যোগের পূর্বাভাস সম্প্রচার, ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র স্থাপন, উপকূলীয় এলাকায় বসবাসকারী মানুষকে যথাসময়ে নিরাপদ স্থানে স্থানান্তর, দ্রুত ত্রাণ সামগ্রী সরবরাহ, উপকূলীয় বাঁধ তৈরি, লবণাক্ত ও খরা সহিষ্ণু ফসলের জাত উদ্ভাবন, বাঁধ ও বাঁধ সংলগ্ন চর এলাকায় বনায়নের মাধ্যমে সবুজ বেষ্টনী সৃষ্টি। কিন্তু নতুন নতুন মাত্রার প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব নিরসনে আরও প্রয়োজন আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও সমন্বিত প্রয়াস। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জলবায়ু পরিবর্তন গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে রাখতে ও এর বিরূপ প্রভাব ঠেকাতে ১৯৯২ সনে স্বাক্ষরিত জাতিসংঘের কাঠামোগত কনভেনশন (টঘঋঈঈঈ) এবং এর আওতায় প্রণীত কিয়োটো প্রটোকল অনুযায়ী জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী উন্নত দেশসমূহ উন্নয়নশীল ও পরিবর্তিত অর্থনীতির দেশসমূহকে আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা প্রদানের আশ্বাস দিলেও তা খুব একটা আশানুরূপ ভাবে বাস্তবায়ন হয়নি। তাই উন্নয়নশীল দেশ ও পরিবর্তিত অর্থনীতির দেশসমূহ উন্নত দেশসমূহকে তাদের সহায়তার আশ্বাসকে আইনী কাঠামোতে অন্তর্ভুক্তির জন্য জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। ২০২০ সনের মধ্যেই এ ধরনের আইনী কাঠামো গঠন করা সম্ভব হবে বলে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞগণ আশা প্রকাশ করেছেন। বৈশ্বিক স্বীকৃতি জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলায় বাংলাদেশ সরকারের গৃহীত পদক্ষেপের ফলশ্রুতিতে জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘চ্যাম্পিয়ন অব দ্য আর্থ’ লাভ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০১৫ সালে জাতিসংঘের ৭০তম অধিবেশনে তার হাতে এই পুরস্কার তুলে দেয়া হয়েছে। এ ছাড়াও অতি সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাময়িকী ‘ফরেন পলিসি’তে প্রকাশিত জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব নিয়ে সচেতনতা তালিকায় ‘ডিসিশন মেকার্স’ ক্যাটাগরিতে বিশ্বের শীর্ষ ১৩ বুদ্ধিজীবীর তালিকায় স্থান পেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলা এবং মানুষের স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবন নিশ্চিত করার মধ্যে একটা ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। বৈশ্বিক আবহাওয়ায় বাংলাদেশের দূষণ নগণ্য (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বছরে মাথাপিছু ১৬ দশমিক ২ টন কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের বিপরীতে বাংলাদেশে বছরে নিঃসরণ দশমিক ৪৩ টন)। কিন্তু দূষণের তীব্রতা ও ক্ষতি সবচেয়ে বেশি আঘাত হানছে বাংলাদেশে। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন যে, বৈরী আবহাওয়ার ফলে আমাদের বার্ষিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ১ দশমিক ১৫ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে। মানুষের জীবনের প্রতিটি স্তরে অস্তিত্ব রক্ষা, নিরাপত্তা বিধান এবং উন্নত জীবনের আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নে নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টার পশ্চাতে কাজ করে উদ্ভাবনী শক্তি। তীব্র শীত কিংবা গরম থেকে রক্ষা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা, চাহিদা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় খাদ্য সরবরাহ এবং রোগবালাই থেকে মুক্তির প্রেরণা পাওয়া যায় আবিষ্কারের মাধ্যমে। একসময় মানুষ প্রাকৃতিক দুর্যোগে অসহায় ছিল। মানুষের উপলব্ধির বাইরে যা কিছু ঘটত, তাকে দৈব-দুর্বিপাক ভেবে তার কাছে আত্মসমর্পণ ছাড়া কিছু ভাবতে পারত না। তবু এ দেশের পরিশ্রমী মানুষ পিছিয়ে যায়নি, বরং উদ্ভাবনী শক্তি কাজে লাগিয়ে বৈরি পরিবেশে লড়াই করে দুর্যোগ মোকাবেলায় নিরন্তর লড়াই করে টিকে থাকার পাশাপাশি অনেক ক্ষেত্রেই ক্ষয়ক্ষতি শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। (সমাপ্ত) লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×