ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

দুই মেয়েসহ নৃংশস মৃত্যু

বেঁচে থাকার রাস্তা খুঁজে পাচ্ছি না- মায়ের লেখা চিরকুট উদ্ধার

প্রকাশিত: ০৮:১৬, ৫ মে ২০১৮

বেঁচে থাকার রাস্তা খুঁজে পাচ্ছি না- মায়ের লেখা চিরকুট উদ্ধার

গাফফার খান চৌধুরী ॥ রাজধানীর মিরপুরের পাইকপাড়া সরকারী কলোনিতে দুই মেয়েসহ মায়ের নৃশংস মৃত্যুর ঘটনার বিষয়ে মায়ের লেখা একটি চিরকুট উদ্ধার করা হয়েছে। সেই চিরকুটের সূত্র ধরে হত্যার সঙ্গে তৃতীয় কোন পক্ষ জড়িত কিনা তদন্তে তা গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। বিশেষ করে নিহত জেসমিনের খালাত বোন যুঁথী ও হাসিবুলের ভাগ্নের স্ত্রীর কোন যোগসূত্র আছে কি না তা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে পুলিশ। মৃত্যুর দিন জেসমিন তার অফিসের টেবিলের ড্রয়ারে একটি চিরকুট লিখে যান। চিরকুটটি পুলিশ তার অফিসের টেবিলের ড্রয়ার ভেঙ্গে উদ্ধার করেছে। চিরকুটে লেখা রয়েছে, ‘আমি বেঁচে থাকার রাস্তা খুঁজে পাচ্ছি না। আমার সব দিক থেকে অনেক অন্ধকার নেমে এসেছে। তাই এ সিদ্ধান্ত নিতে হলো। আমার মৃত্যুর জন্য আমার নির্মম দুর্ভাগ্য দায়ী। পুলিশ বলছে, কি এমন দুর্ভাগ্য ছিল যে, মেয়েসহ মাকে মরতে হলো। তা জানার চেষ্টা চলছে। সেই চিরকুট সত্যিকার অর্থে জেসমিনের হাতে লেখা নাকি অন্য কেউ লিখে কৌশলে জেসমিনের ড্রয়ারে রেখে দিয়েছিল তাও জানার চেষ্টা করা হচ্ছে। চিরকুটের হাতের লেখা কার তা জানতে সেটি সিআইডিতে পাঠানো হচ্ছে। গত ৩০ এপ্রিল সন্ধ্যায় পাইকপাড়ায় সরকারী কোয়ার্টার থেকে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের কর্মকর্তা জেসমিন আক্তার (৩৫) এবং তার দুই মেয়ে হাসিবা তাহসিন হিমি (৯) ও আদিবা তাহসিন হানির (৪) কুপিয়ে হত্যা করা লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। নিহত জেসমিন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সহকারী হিসাবরক্ষক ছিলেন। পুলিশের দারুসসালাম জোনের সহকারী কমিশনার জানান, উদ্ধার করা চিরকুটে লেখাগুলোর অর্থ খোঁজার চেষ্টা করা হচ্ছে। কেন এমন কথা তিনি লিখেছেন এবং এর পেছনে কোন পারিবারিক কারণ জড়িত আছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। চিরকুট উদ্ধারের পর দুই শিশুসন্তানসহ মায়ের লাশ উদ্ধার নিয়ে রহস্য বাড়ছে। পরিবার ও পুলিশ বলছে, ঘটনার সময় ওই কক্ষের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল। পাশের কক্ষে জেসমিনের ভাই শাহীনুর ও স্বামী হাসিবুলের ভাগ্নে ও ভাগ্নে বউ থাকেন। আরেক কক্ষে জেসমিনের খালাত বোন যুঁথী থাকেন। তারাও বিষয়টি টের পাননি বলে দাবি করেছেন। পরে হাসিবুল ও জেসমিনের ভাই শাহীনুর দরজা ভেঙ্গে ভেতরে ঢুকে মা ও দুই মেয়ের রক্তাক্ত লাশ দেখতে পান। ডিবির অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার জানান, মা-মেয়ের মৃত্যুর ঘটনায় কোন হত্যা মামলা না হওয়াতে সরাসরি এ বিষয়ে তারা কাউকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারছেন না। সবচেয়ে রহস্যজনক আচরণ করছেন জেসমিনের ভাই শাহিনুর। জেসমিনের ভাই কিংবা তার পরিবারের পক্ষ থেকে জেসমিনের মৃত্যুর বিষয়ে অন্য কারও হাত থাকতে পারে এমন কোন অভিযোগ করা হয়নি। কিন্তু জেসমিন ও তার দুই মেয়ের মর্মান্তিক মৃত্যুর ধরন দেখে মনে হয়েছে এমন কোন ঘটনা আছে যার জন্য এভাবে মা ও দুই মেয়েকে প্রাণ দিতে হয়েছে। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট হাতে পেলেই বোঝা যাবে মূল কারণ। তিনজনের লাশের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরির সঙ্গে যুক্ত পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, জেসমিনের গলার পাশাপাশি দুই হাতে কব্জির কাছে কাটা ছিল। বুকে ছিল অন্তত ৯টি আঘাতের চিহ্ন। বড় মেয়ে হিমির পেটে তিনটি আঘাতের চিহ্ন এবং বাঁ হাতের কব্জির কাছে কাটা ছিল। ছোট মেয়ে হানির পেটে এবং ডান হাতের কব্জির কাছে কাটা ছিল। দুজনেরই গলা কাটা ছিল। গত মঙ্গলবার দুপুরে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ময়নাতদন্ত শেষে ফরেনসিক বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডাঃ সেলিম রেজা সাংবাদিকদের জানান, নিহত মা ও দুই মেয়ের মরদেহের ময়নাতদন্তে ধারালো অস্ত্রের গুরুতর জখম পাওয়া গেছে। উপর্যুপরী ছুরিকাঘাতে তাদের মৃত্যু হয়েছে। নিহতদের ভিসেরার নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে। পরীক্ষায় মৃত্যুর আগে তাদের কিছু খাওয়ানো হয়েছিল কিনা বা খেয়েছিল কিনা তা জানা যাবে। নিহতদের শরীরে উপর্যুপরী ছুরিকাঘাতের চিহ্ন থাকলেও মা দুই মেয়েকে ছুরিকাঘাতে হত্যার পর নিজের শরীরে নিজেই ছুরি মেরে আত্মহত্যা করেছেন কিনা তা স্পষ্ট নয়। দারুসসালাম থানার ওসি জানান, উদ্ধারকালে জেসমিনের ডান হাতের দিকে একটি রক্ত মাখা ছুরি পড়ে ছিল। হলুদ রঙের কাঠের বাঁটযুক্ত ছুরিটি বাসায় ব্যবহৃত হয়েছে কিনা এ বিষয়ে জেসমিনের স্বামী হাসিবুল কোন সদুত্তর দিতে পারেননি। তবে ঘটনার সময় বাসায় অনেকেই ছিলেন। ঘটনাটি তাদের টের না পাওয়ার বিষয়টি রীতিমত রহস্যের জন্ম দিয়েছে। বাড়ির লোকজনের ওপর নজরদারি অব্যাহত আছে। হাসিবুল রহমান ঢাকায় ফিরলে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। তিনি আরও জানান, দুই মেয়েকে হত্যার পর নিজে পেটে ও গলায় ছুরিকাঘাত করে আত্মহত্যা করার ঘটনাটি রহস্যজনক। একজন মানুষের পক্ষে আগে পেটে ছুরিকাঘাত করার পর স্বাভাবিক কারণেই তার পক্ষে গলায় ছুরিকাঘাত করা সম্ভব নাও হতে পারে। আবার একইভাবে আগে গলায় ছুরিকাঘাত করার পর পেটে ছুরিকাঘাত করা সম্ভব কিনা তাও এক জটিল রহস্য। সত্যিকার অর্থেই মা দুই সন্তানকে ছুরিকাঘাতে হত্যার পর নিজে আত্মহত্যা করেছেন নাকি অন্য কেউ হত্যাকা- ঘটিয়ে পালিয়ে গেছে তাও স্পষ্ট নয়।
×