ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মৃত্যুর ৪ বছর পর স্বামীর কবরের পাশে দাফন করা হলো ধর্মান্তরিত হোসনে আরাকে

প্রকাশিত: ০৫:০৪, ৫ মে ২০১৮

মৃত্যুর ৪ বছর পর স্বামীর কবরের পাশে দাফন করা  হলো ধর্মান্তরিত  হোসনে আরাকে

স্টাফ রিপোর্টার, নীলফামারী ও নিজস্ব সংবাদদাতা, রংপুর ॥ আইনী জটিলতা শেষে চার বছর এক মাস ২৪ দিন হিমঘরে থাকার পর নীলফামারীর ডোমার উপজেলার খামার বামুনিয়া গ্রামের কলেজছাত্রী ধর্মান্তরিত হোসনে আরা ইসলামের (নিপা রানী রায়) (২০) মরদেহ মুসলিম রীতি অনুযায়ী দাফন করা হয়েছে। এ ঘটনাকে এলাকাবাসী প্রেমের জয় হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। উচ্চ আদালতের আদেশ অনুযায়ী শুক্রবার বেলা তিনটায় নীলফামারী জেলা প্রশাসকের নিয়োগকৃত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ডোমার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা উম্মে ফাতেমা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতিতে মেয়েটির লাশ শ্বশুরবাড়ি পূর্ব বোড়াগাড়ী কাজীপাড়া জামে মসজিদ চত্বরে দুই দফা জানাজা শেষে দাফন করা হয়। জানাজায় ১০ হাজারের বেশি মানুষ অংশ নিতে আসেন। স্থান সঙ্কুলান না হওয়ায় দুই দফায় জানাজা করা হয়। প্রথম জানাজার ইমামতি করেন মেয়েটির দাদাশ্বশুর ওই জামে মসজিদের সাবেক ইমাম মওলানা কাজী আব্দুল জলিল এবং দ্বিতীয় জানাজার ইমামতি করেন বর্তমান ইমাম মওলানা রবিউল ইসলাম। জানাজা শেষে শ্বশুরবাড়ির পক্ষে ধর্মান্তরিত হোসনে আরা ইসলামকে তার স্বামী হুমায়ুন ফরিদ ওরফে লাইজু ইসলামের (২৩) কবরের পাশেই দাফন করেন তারা। বিচারপতি মিফতাহ উদ্দিন চৌধুরীর একক হাইকোর্ট বেঞ্চের ১২ এপ্রিল দেয়া এক আদেশে ধর্মান্তরিত হোসনে আরা ইসলামকে মুসলিম রীতি অনুযায়ী এই দাফন করা হয় বলে জানান নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট উম্মে ফাতেমা। তিনি আরও জানান, ‘উচ্চ আদালতের নির্দেশে জেলা প্রশাসকের প্রতিনিধি হিসেবে শুক্রবার সকালে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের হিমঘরে আমার উপস্থিতে জহুরুল ইসলাম লাশ গ্রহণ করেন। এরপর আমার উপস্থিতে দাফন সম্পন্ন হয়। এক প্রশ্নের জবাবে, তিনি সাংবাদিকদের জানান, উচ্চ আদালতের আদেশ অনুযায়ী আমরা মেয়ের পরিবারের অভিভাবকদের মরদেহ দেখার আহ্বান জানাই। কিন্তু তারা মরদেহ দেখতে অপরাগতা প্রকাশ করেন। এর আগে গত বৃহস্পতিবার (৩ মে) হাইকোর্টের ওই আদেশের কপি জেলা প্রশাসকের হাতে পৌঁছে। আদালতের আদেশ মোতাবেক জেলা প্রশাসকের পক্ষে সকল প্রকার প্রস্তুতি গ্রহণ করে শুক্রবার সকাল সোয়া ১১টায় রংপুর মেডিক্যাল কলেজের হিমঘরে সংরক্ষণে থাকা হোসনে আরার মরদেহ নিয়ে আসা হয় দুপুর সোয়া ১টায় বোড়াগাড়ী ইউনিয়নের পূর্ব বোড়াগাড়ী গ্রামের মেয়েটির শ্বশুর সাবেক ইউপি সদস্য জহুরুল ইসলামের বাড়িতে। সেখানে দাফনের সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়। দাফন শেষে অনেককে এ নিয়ে মন্তব্য করতে শোনা যায়। মন্তব্যের মধ্যে একটি কথাই বার বার উঠে আসে। তা হলো ধর্ম নিয়ে নয়, এটি লাইলী মজনু, শিরি ফরহাদ, শাহজাহান ও নুরজাহানের ন্যায় প্রেমের জয় হয়েছে। তাইতো স্বামীর পাশেই স্থান হলো হোসনে আরা ইসলামের। মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরণী থেকে জানা যায়, ডোমার উপজেলার খামার বমুনিয়া গ্রামের অক্ষয় কুমার রায়ের মেয়ে কলেজছাত্রী নিপা রানী রায়ের সঙ্গে পূর্ব বোড়াগাড়ী গ্রামের সাবেক ইউপি সদস্য জহুরুল ইসলামের ছেলে হুমায়ুন ফরিদ ওরফে লাইজু ইসলামের প্রেমের স¤পর্ক ছিল। প্রেমের টানে ২০১৩ সালের ২৫ অক্টোবর ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে মোছা. হোসনে আরা ইসলাম নাম ধারণ এবং দুই লাখ এক হাজার ৫০১ টাকা দেনমোহরে হুমায়ুন ফরিদ লাইজু ইসলামকে বিয়ে করে মেয়েটি। এ অবস্থায় ২০১৩ সালের ২৮ অক্টোবর নীলফামারী নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালতে মামলা দায়ের করা হয়। আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে শারীরিক পরীক্ষার জন্য মেয়েটিকে রাজশাহী সেফহোমে পাঠিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন। এ অবস্থায় ২০১৪ সালের ১৫ জানুয়ারি মেয়েটির স্বামী হুমায়ুন ফরিদ লাইজু ইসলাম বিষপান করে আত্মহত্যা করে। এরপর মেয়েটির বাবা অক্ষয় কুমার তার মেয়েকে নিজ জিম্মায় নিতে আদালতে আবেদন করেন। আদালত তা মঞ্জুর করলে ২০১৪ সালের ১৬ জানুয়ারি তিনি মেয়েকে বাড়িতে নিয়ে রাখেন। তবে মামলা চলমান থাকা অবস্থায় ২০১৪ সালের ১০ মার্চ দুপুরে বাবার বাড়িতে কীটনাশক পান করে মেয়েটি। তাকে ডোমার উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ভর্তি করা হলে সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাত ৮টার দিকে মারা যায়। পুলিশ হাসপাতাল হতে মেয়েটির লাশ রাতেই উদ্ধার করে পরের দিন জেলার মর্গে ময়নাতদন্ত করে। কিন্তু সমস্যা সৃষ্টি হয় দাফন নিয়ে। মেয়েটির শ্বশুর জহুরুল ইসলাম, মুসলিম রীতি মোতাবেক দাফনে ও মেয়েটির বাবা অক্ষয় কুমার রায় হিন্দু শাস্ত্রে সৎকারের জন্য তাৎক্ষণিকভাব জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আবেদন করেন। সেখানে কোন সমাধান না হওয়ায় আদালত মেয়েটির মরদেহ রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের হিমঘরে সংরক্ষণের আদেশ দেন। সেই থেকে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের হিমঘরে সংরক্ষণ ছিল মেয়েটির লাশ। এরপর এই মামলাটি নীলফামারী জেলা ও দায়রা জজ আদালতে দীর্ঘদিন চলার পর মেয়েটির শ্বশুর মামলটি হাইকোর্টে নিয়ে যান। এ নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ পেলে মামলাটি দ্রুত নিষ্পক্তি করার জন্য হাইকোর্টে আবেদন করেছিল মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র। এরপর হাইকোর্টের এক আদেশে দীর্ঘ চার বছর এক মাস ২৪ দিন পর মেয়েটির দাফন সম্পন্ন হলো।
×