ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

প্রতিবন্ধিতা জয়ের যুদ্ধে অদম্য মেধাবী মরিয়ম

প্রকাশিত: ০৪:৫১, ৫ মে ২০১৮

প্রতিবন্ধিতা জয়ের  যুদ্ধে অদম্য মেধাবী  মরিয়ম

সুবল বিশ্বাস, মাদারীপুর থেকে ॥ মা-বাবার আদরের মেয়ে মরিয়ম জন্ম থেকেই প্রতিবন্ধী। প্রতিবন্ধী হলেও তার প্রতি মা-বাবার স্নেহ-মমতার কোন কমতি নেই। এ বছর সে একটি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণীর মেধাবী ছাত্রী। যে বয়সে লেখাপড়ার পাশাপাশি খেলাধুলা, দৌড়ঝাঁপ আনন্দ-উল্লাস করে কাটানোর কথা। সে বয়সে মরিয়ম তার সেই শখ ভুলে গেছে জন্ম থেকেই। কিন্তু হার মানতে সে নারাজ। অদম্য মেধাবী মরিয়ম প্রতিবন্ধিতাকে জয় করে একজন প্রকৌশলী হওয়ার স্বপ্ন দেখে। মরিয়ম দুই পা ও ডান হাত অসাড় অবস্থায় জন্ম গ্রহণ করে। জন্ম থেকে শরীরের গুরুত্বপূর্ণ এ অঙ্গ দুটি কোন কাজে আসেনি। বাঁ হাতই তার লেখা ও খাওয়া-দাওয়ার একমাত্র ভরসা। রাজৈর উপজেলা ইশিবপুর ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডে শাখারপাড় গ্রামে পরিবার নিয়ে বসবাস করেন সেলিম শরীফ। এক ছেলে দুই মেয়ে, স্ত্রী ও বৃদ্ধ বাবা-মাকে নিয়ে ৭ সদস্যের সংসার তার। এই সন্তানদের মধ্যে মরিয়ম আক্তার বড়। ছোটবেলা থেকেই পড়ালেখায় ভালো। মেয়েকে অনেক দূর পড়ালেখা শিখাতে চায় বাবা-মা। মরিয়ম শারীরিক প্রতিবন্ধী হলেও তাকে নিয়ে স্বপ্নের শেষ নেই বাবা সেলিমের। বাবা-মা চায় মরিয়ম শিক্ষার আলো জ্বালিয়ে প্রতিবন্ধিতা জয় করুক। কিন্তু অভাব অনটন ও সংসারে টানাপোড়েনের কারণে তাদের সে স্বপ্ন যেন ফিকে হয়ে আসছে। জন্মের পর থেকে মরিয়মের তেমন কোন উন্নত চিকিৎসা করাতে পারেনি এই দরিদ্র বাবা। এমন কি মরিয়মের চলাফেরার জন্য একটি হুইল চেয়ারও কিনে দিতে পারেনি। মা-বাবার কোলে চড়েই তাকে চলাফেরা ও স্কুলে যাতায়াত করতে হচ্ছে। তাই মা-বাবা যেখানেই যাক মেয়েকে কোলে করে নিয়ে যেতে হয়। মরিয়ম দিন দিন বড় হচ্ছে আর সেই সঙ্গে মা-বাবার দুঃশ্চিন্তা বেড়ে যাচ্ছে। সেলিম শরীফের বাড়ি গিয়ে দেখা যায়, ছোট্ট একটি কোয়েল পাখির খামারে কাজ করছেন সেলিম শরীফ ও তার স্ত্রী আকলিমা। খামারের পাশেই ছোট্ট একটি কুটিরে সেলিম তার পরিবার নিয়ে থাকেন। মরিয়মের স্কুল ছুটি শেষ হলে তার মা আকলিমা বেগম চলে যান স্কুল থেকে মেয়েকে বাড়ি আনতে। প্রায় আধা কিলোমিটার হেঁটে মেয়েকে কোলে নিয়ে বাড়িতে ফিরে আসেন তিনি। অনুভূতি জানতে প্রশ্ন করা হলে মরিয়ম হাসি মুখে বললো, ‘আমার বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে ইচ্ছে করে। আমি খেলাধুলা করতে চাই। সবার মতো চলতে চাই। পড়ালেখা করে ইঞ্জিনিয়ার হতে চাই। আমাকে নিয়ে বাবা-মায়ের অনেক কষ্ট হয়। আমাকে কোলে নিয়ে সব কাজ তারাই করে দেয়। আমি বড় হয়ে পড়ালেখা শেষ করে তাদের পাশে দাঁড়াতে চাই।’ মরিয়মের বাবা সেলিম শরীফ বলেন, ‘আমি আগে ঢাকায় কাজ করতাম। ঢাকাতেই মরিয়মের জন্ম হয়। জন্মের সময় মাথায় আঘাত পায়, সে থেকেই মরিয়ম শারীরিক প্রতিবন্ধী। তার এক হাত ও দুই পায়ে কোন বোধশক্তি নেই। ওকে ঢাকার সাভারে অবস্থিত পক্ষাঘাতগ্রস্তদের পুনর্বাসন কেন্দ্রে কয়েকবার চিকিৎসা করিয়েছি। কিন্তু অর্থের অভাবে মেয়েকে সম্পূর্ণ সুস্থ করে তুলতে পারিনি। ডাক্তাররা বলেছিলেন দীর্ঘস্থায়ী চিকিৎসা দেয়া হলে মরিয়ম স্বাভাবিক জীবন ফিরে আসতে পারে। কিন্তু আমি এখনও মরিয়মকে তেমন কোন চিকিৎসা করাতে পারিনি।’ মা আকলিমা বেগম বলেন, ‘দুই বছর আগে মরিয়মের স্কুল থেকে একটি হুইল চেয়ার দিয়েছিল। এখন সেটা ভেঙ্গে গেছে। এক বছর ধরে মেয়েকে বসিয়ে রাখার মতো কোন হুইল চেয়ার নেই। মেয়ের সব কাজ আমার করে দিতে হয়। স্কুলে আনা-নেয়া, গোসল করিয়ে দেয়া, খাবার খাইয়ে দেয়সহ সব কাজ আমার করিয়ে দিতে হয়। আমারই তো মেয়ে এগুলোকে কষ্ট মনে করি না। কিন্তু আমি না থাকলে তখন মরিয়মকে কে দেখবে? ওর বাবার তেমন আয় নেই। মেয়ের বড় হওয়া ও তার ভবিষ্যৎ নিয়ে এখন আমাদের খুব দুঃশ্চিন্তায় আছি।’ শাখারপাড় সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোঃ শামিনূর ইসলাম বলেন, ‘মরিয়ম আগে থেকেই মেধাবী। মেয়েটির স্মরণ শক্তি খুব ভালো। স্কুলের স্যারদের বলা হয়েছে মেয়েটির পড়ালেখায় বিশেষ যতœ নিতে। আশা করছি এবারের সমাপনী পরীক্ষায় মরিয়ম জিপিএ-৫ পাবে। আমরা স্কুল থেকে তাকে প্রতি মাসে এক শ’ টাকা হারে উপবৃত্তি দিচ্ছি। পাশাপাশি মরিয়মকে স্কুল থেকে অন্যান্য সুবিধা দেয়ার চেষ্টা করছি।’ ইশিবপুর ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ড সদস্য ইউনুস মোল্লা বলেন, ‘সেলিম শরীফের প্রতিবন্ধী মেয়ে ও তার আর্থিক দিক বিবেচনা করে আমরা তাদের কিছু সহযোগিতা করি। এতে তাদের হয় না। আমি তাদের বিষয়টি উপজেলা চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন চেয়ারম্যানের সঙ্গে আলোচনা করে প্রতিবন্ধী মেয়েটির জন্য কিছু একটা করার চেষ্টা করব।’
×