ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

পথশিশুদের আলোর পাঠশালা

প্রকাশিত: ০৪:১২, ৫ মে ২০১৮

পথশিশুদের আলোর পাঠশালা

রাজশাহী নগরীর ভদ্রা এলাকায় গড়ে ওঠা ছিন্নমূল মানুষদের বসবাস। এখানে গড়ে ওঠা বিশাল বস্তির সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা স্কুলে যেতে পারে না। প্রাথমিক শিক্ষার নেই কোন পরিবেশ। স্কুল, সে তো স্বপ্ন। পারিবারের সদস্যদের অক্ষরজ্ঞানহীনতার কারণে স্কুলে ভর্তি হয়েও শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হতে হয় তাদের। কোন রকমে স্কুলে গেলেও তা বেশিদিন স্থায়ী হয় না। কাজে যোগ দিতে হয় পরিবারের সঙ্গে। কন্যা শিশুদের ছুটতে হয় বাসাবাড়ির কাজে আর ছেলেরা বিভিন্ন ওয়ার্কশপ কিংবা লেদে। এ অবস্থায় পড়াশোনা আর হয়ে উঠে না তাদের। অনেকেই ঝরে যায় প্রথম শ্রেণীর গ-ি পার না হতেই। তবে এইসব ঝরে পড়া শিশুদের জ্ঞানের আলো ছড়াতে কাজ করছে একদল তরুণ-তরুণী। এরা বিশ^বিদ্যালয় ও কলেজের একদল শিক্ষার্থী। রাজশাহীতে সামাজিক স্কুলের ব্যানারে এই শিক্ষার্থীরা স্বেচ্ছায় শিক্ষার আলো বিলিয়ে দিতে পাশে দাঁড়িয়েছে বস্তির শিশুদের। তাদের গড়ে তোলা ‘আলোর পাঠশালা’য় এখন শিক্ষা গ্রহণ করছে বস্তি এলাকার সুবিধাবঞ্চিত ও স্কুল ঝরে পড়া শিশুরা। পাঠশালা কিংবা স্কুল বলতে এদের ফাঁকা মাঠ। সেখানেই মাদুর পেতে চলে পড়াশোনা। ৫ থেকে ১০ বছর বয়সী শিশুরা এ স্কুলের শিক্ষার্থী। প্রতিদিন বিকেল হলেই শুরু হয় এ স্কুলের পড়াশোনা। সুবিধা বঞ্চিত এসব বস্তির শিশুদের মৗলিক অধিকার শিক্ষার সুফল ছড়িয়ে দিতে এগিয়ে এসেছেন একদল তরুণ শিক্ষার্থী। নিজেদের নেয়া এই উদ্যোগের নাম দিয়েছেন তারা ‘সামাজিক স্কুল’। রাজশাহী নগরীর শিরোইল কলোনী সংলগ্ন রেলওয়ে মাঠে প্রতিদিন বিকেলে খোলা আকাশের নিচেই বসে এই স্কুল। শাপলা নামের সাত বছর বয়সী শিশু এখন এই স্কুলের একজন নিয়মিত শিক্ষার্থী। শাপলার মতো ফরিদা, আফরোজা বেলাল, রেশমা, জরিনাসহ প্রায় ৫০ জন সুবিধাবঞ্চিত পথশিশুও এই স্কুলে শিক্ষা গ্রহণ করছে। এদের মধ্যে কথা হয় শাপলার সঙ্গে। সমাজের অন্যসব সুবিধাবঞ্চিত পথশিশুদের মধ্যে সেও একজন। তার বাড়ি নগরীর পদ্মা আবাসিক এলাকার লেকের ধারের বস্তিতে। শাপলার ভাষায়, এখন তারা পড়াশোনা করতে পারছে। বাড়ির কাজ সের রোজ এখানে আসতে হয়। এখানে মন দিয়ে তাদের পড়ানো হয়। সরকার সকলের জন্য বিনামূল্যে শিক্ষা গ্রহণের অধিকার নিশ্চিত করলেও, পারিবারের সদস্যরা বস্তিবাসী হওয়ায় স্কুলে ভর্তি তো দূরের কথা ন্যূনতম শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হতে চলেছে শাপলার মতো অনেক শিশু। শাপলা জানায়, এখন সে পড়ালেখা করছে সামাজিক স্কুলে। এতে প্রাথমিক শিক্ষা মিলছে। তার সহপাঠী এখন ৫০ জনের বেশি। সম্প্রতি বিকেলে রাজশাহীর ভদ্রাস্থ রেলওয়ে মাঠে গিয়ে দেখা যায়, কয়েকটি মাদুর বিছিয়ে প্রায় ৩০ জন শিশু বসে রয়েছে। তাদের কেউ খাতায় লিখছে, তো কেউ উচ্চৈঃস্বরে বই দেখে দেখে পড়ছে। এদের মাঝে কয়েকজন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীও রয়েছে। এরা শিশুদেরকে পড়াতে সহায্য করছে। শাপলা বলে, প্রথমে আমাকে এই স্কুলে আপারাই (বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী) ধরে নিয়ে আসে। প্রথমে বুঝতাম না। পড়তে ইচ্ছা করতো না। এখন এখানে আপা-ভাইয়ারা আমাদের বন্ধু হয়ে গেছে। তারায় আমাদের পড়ায়। এখন একদিন না আসলে ভাল লাগে না। বাসাবাড়ির কাজ সেরে স্কুলে এসে পড়াশোনা করি। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, খোলা মাঠে সামাজিক স্কুলের উদ্যোগী তরুণদের একজন সবনম মুস্তারী। তিনি নিজেও শিক্ষার্থী। সবনম জানান, সমাজের সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের মাঝে, শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতেই তাদের এই উদ্যোগ। ২০১৬ সালে তারা এই স্কুলটির কর্যক্রম শুরু করেন। সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের মধ্যে যারা পড়তে পারে না তাদের বস্তির ঘরে ঘরে গিয়ে সংগ্রহ করে নিয়ে এসে পাঠদান করেন। পাশাপাশি যারা স্কুলে পড়ে তারাও এখন এখানে এসে পড়াশোনা করে। শবনম মুস্তারি জানান, রাজশাহী সরকারী কলেজে অধ্যয়নরত সামাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের কয়েকজন মিলে এই সামাজিক স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন। প্রথমে তারা এই উদ্যোগের কথা তাদের বিভাগের প্রধানকে বলেন। সামাজবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান তখন কলেজটির অধ্যক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তার সম্মতিতে শিক্ষার্থীরা এই উদ্যোগ শুরু করেন ২০১৬ সালে। প্রাথমিক অবস্থায় কলেজটির অধ্যক্ষ ও বিভাগীয় প্রধান তাদেরকে কিছু টাকাও সহযোগিতা করেন। এরসঙ্গে নিজেরা ২০ টাকা করে চাঁদা দিয়ে এ শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে আসছেন। এখনও এ শিক্ষা কার্যক্রম চলছে শিক্ষার্থীদের চাঁদার টাকায়।এ স্কুলের সুবিধাভোগী শিক্ষার্থী রেশমা। সেও বস্তিতে থাকে। রেশমা জানায়, আপা-ভাইয়ারা এখানে আমাদের পড়ানোর সঙ্গে খাবারও দেয়। ঈদের দিন কিংবা বিশেষ কোনদিন বেড়াতে নিয়ে যায়। কারও জন্মদিন থাকলে সবাইকে নিয়ে জন্মদিন পালন করা হয়। বিস্কুট, চকলেট দেয়। আমাদের পাড়াশোনার প্রতি মনোযোগী করে তুলেন। -মামুন-অর-রশিদ রাজশাহী থেকে
×