ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সবুজ মাঠ যেন শিল্পীর হাতে সুনিপুণ পোর্ট্রটে

প্রকাশিত: ০৪:১০, ৫ মে ২০১৮

সবুজ মাঠ যেন শিল্পীর হাতে সুনিপুণ পোর্ট্রটে

যে দিকে দু’চোখ যায়, শুধু সবুজ আর সোনালি রঙের সমারোহ। বিস্তীর্ণ মাঠ জুড়ে শুধু ধান আর ধান। গত দু’সপ্তাহ আগে বের হওয়া ধানের শীষগুলো হেলে পড়েছে জমিনের দিকে। কলা পাকা ধানের শীষগুলো সামান্য বাতাসে শুধুই দুলছে। ধান ক্ষেত থেকে ম ম গন্ধ নাকে এসে লাগছে। চার দিকে সমান দৃষ্টি ফেলে মনে হচ্ছে, কোন এক শিল্পীর হাতে সুনিপুণ পোট্রেট যেন এ সবুজ মাঠ। গত ৩ বছর আগেও মাঠের এমন চিত্র কৃষক আশা করতে পারছিল না। আগে বৈশাখের শুরুতে সামান্য বৃষ্টি সবুজ এ মাঠটিকে তলিয়ে দিত। অকাল বন্যায় সোনালি সে ধান তলিয়ে যাওয়ায় কৃষকের বুক ভাঙ্গা আর্তনাদ করা ছাড়া আর কিছু ছিল না। কিন্তু আজকের চিত্র সম্পূর্ণ বিপরীত। সবুজ ধানের মাঠে তপ্ত রোদ উপেক্ষা করে কাজ করছে কৃষক। টানা প্রায় আড়াই কিলোমিটার হেঁটে মাঠের মাঝ খানে গিয়ে চোখে পড়ল এই বৈপ্লবিক পরিবর্তনের কর্মযজ্ঞ। বর্ণিত বিষয় নওগাঁর বিল মুনছুর, নলীর বিল, চক পাকুরিয়া, হামড়ার বিল, চোয়ারপাড়া বিলের কথা। তিন উপজেলা মহাদেবপুর, মান্দা, ও নওগাঁ সদর জুড়ে ৩৭ কিলোমিটার বিলের তলা ভরাট হয়ে আছে স্বাধীনতার পর থেকে। এ কারণে গত ১০ বছর থেকে এ বিলের মাঠ থেকে কৃষক তার কষ্টার্জিত ধান ঘরে তুলতে পারত না। লাগানো বোরো ধান আদৌ তোলা সম্ভব কিনা তা কৃষক নিজেও জানে না। কারণ ছিল একটাই, অধিক বৃষ্টি হলে পানি বের হতে না পারায় ধান তলিয়ে যায়। প্রায় অভুক্ত থাকতে হতো সারা বছর। এ অবস্থায় বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বিলের এসব ভরাট তলদেশ খননের জন্য প্রকল্প হাতে নেয়। ২০১৬ সালে প্রস্তাবিত প্রকল্পটি নওগাঁ সদরের মোঃ আবদুল মালেক এমপির সুপারিশ ও নির্দেশনায় ভু-উপরিস্থ পানির মাধ্যমে সেচ সম্প্রসারণ ও জলাবদ্ধ দূরীকরণ নামে একটি প্রকল্প তৈরি করে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। এ প্রকল্প টি সে বছর একনেকে অনুমোদন পায় । প্রায় সাড়ে ৬ হাজার একর জমি দু’ফসলি করে তুলতে এ প্রকল্পের কাজ শুরু করে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। ২০১৬ সালে শুরু হওয়া বিলের তলদেশ খনন কাজ ইতোমধ্যে ২৩ কিলোমিটার সম্পন্ন হয়েছে, যা আগামী জুন নাগাদ আরও ৯ কিলোমিটার শেষ হবে। বিলের তলদেশ খনন শেষ হওয়া এসব বিলে এখন বিপুল পরিমাণ পানি রয়েছে। সে পানি দিয়ে কৃষক এবার বোরো চাষ করেছে। সরজমিনে দেখা যায়, বিলের তলদেশ থেকে শ্যালো মেশিন দিয়ে সেচ নিয়ে বোরো ধানে ফেলছে কৃষক। অন্যদিকে আশপাশের একাধিক জেলে সে পানিতে জাল ফেলে মাছ ধরছে। স্থানীয় গয়ের পাড়া গ্রামের বাসিন্দা জাহিদুল ইসলাম, ভীমপুরের আবুল হোসেন এবং আবদুল জলিল জানান, খাল কাটার আগে এখানে বোরো ফসল ঘরে তোলা যেতো না। গত বছর থেকে অভিশপ্ত এ মাঠ আশীর্বাদ হয়ে দেখা দিচ্ছে। এখন ধান কেটে ঘরে তোলা সম্ভব হচ্ছে। অকাল বন্যায় আর আমাদের ধান নষ্ট হচ্ছে না। শুধু ধানের সুফল নয় আরও যে কাজ টি বড় ভূমিকা রাখছে তা হলো এখানে বিলের পানিতে এখন নিয়মিত মাছ থাকছে। সারা বছর এ পানি ও মাছ স্থানীয় গ্রামবাসীর কাছে মৎস্য ভা-ার হিসেবে দেখা দিবে এমন কথা বলছে অনেকেই। তথ্য মতে প্রায় দেড় লাখ মানুষ সরাসরি খাল কাটা বিলের সুফল পাবে । বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আশা করছে আগামী ২০১৯ সালে এ প্রকল্প কাজ শেষ হলে অকাল বন্যার যে আতঙ্ক তা আর থাকবে না। তা ছাড়া এ খাল থেকে পানি সেচ নিয়ে সারা বছর কৃষক রবি ফসল ও মৌসুমী চাষাবাদ করার সুফল পাবে। ভু-উপরিস্থ পানির মাধ্যমে সেচ সম্প্রসারণ ও জলাবদ্ধ দূরীকরণ প্রকল্পের পরিচালক এটিএম মাহফুজুর রহমান বলেন, বিলের তলদেশ ভরাট হওয়ার কারণে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা ভেঙে পরেছিল এসব এলাকায়। ফলে সামান্য বৃষ্টি এখানকার কৃষকের জন্য দুঃখ ডেকে আনত। এখন খনন করার পর সম্পূর্ণ চিত্র পাল্টে গেছে। কৃষক বিল থেকে পানি নিয়ে সেচ দিয়ে বিনা পয়সায় ফসল ফলাচ্ছে। চলতি বোরো মৌসুমে এসব বিল এলাকায় বোরো ধানের বাম্পার ফলন আশা করছে কৃষকরা। বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ নওগাঁ সদর জোনের সহকারী প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, যে উদ্দেশ্যে বিলের তলদেশ খনন করা হচ্ছে, তা ইতোমধ্যে কৃষক সুফল পেতে শুরু করেছে। ২৫ কোটি টাকা ব্যয়ের এ প্রকল্পে মেয়াদ ২০১৯ সালের জুন নাগাদ খনন শেষ হবে। কাজ শেষ হলে বিল সংলগ্ন প্রায় ১শ’ গ্রামের কয়েক লাখ মানুষের আর্থ-সামাজিক পরিবর্তন আশা করা হচ্ছে। চলতি বোরো মৌসুমে যে পরিমাণ ধান কৃষকের ঘরে উঠবে, তা প্রকল্পের আর্থিকভাবে ধরা ব্যয়ে লক্ষ্যমাত্রা অনেকটাই সাধিত হবে বলে মনে করছে উপকারভোগীরা। -বিশ্বজিৎ মনি, নওগাঁ থেকে
×