ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

গ্রামীণ ঐতিহ্যের মিঠাই

প্রকাশিত: ০৪:১০, ৫ মে ২০১৮

গ্রামীণ  ঐতিহ্যের  মিঠাই

বাতাসা, লই, কদমা...। এই নামগুলোর সঙ্গে প্রজন্মের তেমন পরিচয় নেই। বেশি পরিচয় হট পেটিস, বার্গার, স্যান্ডউইচ, সর্মা, সবজি রোল, চিকেন গ্রিল ইত্যাদির সঙ্গে। এগুলো ফার্স ফুড। মিষ্টির মধ্যে খুব বেশি হলে রসগোল্লা, জিলাপি, সন্দেশ চমচম লাড্ডু। এর বাইরে বাঙালীর গ্রামীণ জীবনের মিঠাইয়ের সঙ্গে পরিচিতি ঘটে বছরের কোন না কোন মেলায়। বিশেষ করে বৈশাখ মাসের মেলায়। যেখানে মেলে বাঙালীর ঐতিহ্যের মিঠাই। আজও গরিবি হালে টিকে আছে কদমা, বাতাসা, মুরলি, তিলা, নকুলদানা, ছাঁচে তৈরি মিঠাই (হাতি ঘোড়া মাছ পাখি) চিড়া মুড়ির মোয়া, লই ইত্যাদি। একটা সময় গ্রামীণ জীবনে ওইসব মিঠাইয়ের কারিগররা ভাড়ে করে মিঠাই নিয়ে গৃহস্থ ও কৃষকের বাড়ির উঠানে গিয়ে হাঁক দিত ‘আছে...লই, মিঠাই বা...তা...সা...। হাঁক শুনেই ছেলে বুড়ো সকলেই ছুটে যেত দোকানির কাছে। চারধারে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে বসে দড়দাম করত। হলদে রঙের লই মিঠাই হলো শক্ত। বাটখাড়া দিয়ে ভেঙ্গে ওজন করা হতো। এই লই খেয়ে শিশু কিশোরদের মুখের যে কি অবস্থা। দেখেই বোঝা যেত লই খেয়ে এসেছে। এর চেয়ে একটু কম শক্তের মিঠাই বাতাসা। দেখতে অনেকটা সন্দেশের মতো। চিনির সিরা ঘন করে সন্দেশের মতো ছোট করে বানানো হতো বাতাসা। নরম মিঠাই কদমা। নাম কদমা হলেও তা কদম ফুলেল মতো দেখতে নয়। চ্যাপটা গোলাকৃতির এই মিঠাইয়ের চার ধারে নক্সা করা। কদমা মুখে দিলেই গলে যায়। চিনি গলিয়ে ঘন করে হাতি ঘোড়া মাছ পাখি ফুলের নক্সার ছাঁচে ফেলে বের করে শুকানোর পর শিশুদের প্রিয় নক্সা মিঠাই হয়ে যেত। এভাবে কত ধরনের যে বাঙালীর মিঠাই তৈরি করতো কারিগররা। বাঙালীর গ্রামীণ ঐতিহ্যের এই চিরায়ত মিঠাই কোন শহর নগরীর মিষ্টির দোকানে তো পাওয়া যায়ই না। উপজেলাগুলোতেও মেলে না। দেশের বিভিন্ন মেলায় কেবল মেলে এইসব মিঠাই। মেলার কথা শুনলেই বাড়ির কর্তা কর্ত্রী চায় সন্তানদের কাছে এইসব মিঠাইয়ের পরিচয় করিয়ে দেন। বাংলা সাহিত্যে এই ধরনের মিঠাইয়ের কথা বলা আছে। যেমন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার শুভ দৃষ্টি গল্পে পিতলের বাসনে করে বাতাসা নিয়ে বিয়ের সম্মন্ধের কথার উল্লেখ আছে। দূর অতীতে বৈশাখের হালখাতায় কদমা বাতাসা নিমকি লুচি রসগোল্লা খেতে দেয়া হতো। গ্রামীণ ঐতিহ্যের এই মিঠাইগুলো দিনে দিনে লুপ্ত হওয়ার পথে। এমনই এক মিঠাই পল্লী আছে বগুড়ার চাঁদমুহা গ্রামে। নগরী থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে চাঁদমুহার হরিপুর কারিগরপাড়ায় কয়েকজন কারিগর যৌথভাবে এইসব মিঠাইয়ের কারখানা গড়ে তুলেছে। কারিগর রনজিৎ চন্দ্র বললেন, মেলার সময় প্রতিদিন প্রতিটি মিঠাই ৫০০ কেজি করে তৈরি করা হয়। বাঁশের ঝুরিতে করে এই মিঠাই পৌঁছে দেয়া হয় পাইকারি বিক্রেতাদের। কখনও ক্রেতারা এসে নিয়ে যায়। বর্ষাকাল ও অন্য সময় বিক্রি তেমন হয় না। বগুড়ার রাজাবাজারের পাইকারি ক্রেতার কিছু মিঠাই নিয়ে যায়। প্রতি কেজি বাতাসা কদমা বিক্রি হয় ৮০ টাকা কেজি দরে। নকুলদানা, মুরলি লই ইত্যাদি বিক্রি হয় ৭০ থেকে ১০০ টাকা কেজি দরে। বাঙালীর ঐতিহ্যের এই মিঠাই বেশি তৈরি হয় মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া, ঢাকার ধামরাই, সাভার, বগুড়ার চাঁদমুহা গ্রামে। -সমুদ্র হক, বগুড়া অফিস
×