ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ফয়সাল শাহরিয়ার

বেলাল চৌধুরী ॥ ভালবাসা, বেদনায়

প্রকাশিত: ০৪:০৫, ৫ মে ২০১৮

বেলাল চৌধুরী ॥ ভালবাসা, বেদনায়

In my beginning is my end- TS Eliot অদ্ভুত বই পাগল মানুষ ছিলেন তিনি। বিগত শতাব্দীর আশির দশকের প্রথমার্ধে (সম্ভবত সচিত্র সন্ধানীর অফিসে) প্রথম দেখা কবি বেলাল চৌধুরীর সঙ্গে। পোশাকে কিঞ্চিত অগোছালো, হাতে দু-তিনটি বই। তার মধ্যে একটি আমার প্রিয় লেখক গ্রাহাম গ্রীনের সদ্য প্রকাশিত গড়হংরমহড়ৎ ছঁরীড়ঃব-এর হার্ড কাভার সংস্করণ। তরুণ সুলভ ঔদ্ধত্যে প্রথম পরিচয়েই বইটি ধার চেয়েছিলাম। বেলাল চৌধুরী নির্দ্বিধায় বইটি আমাকে দিয়েছিলেন, কবে ফেরত দেব জিজ্ঞেস না করেই। পরে জেনেছিলাম বেলাল চৌধুরী ঐ ধরনেরই মানুষ। নিঃশঙ্কচিত্তভাবে উদার, হয়তো কিছুটা বেহিসাবী। বস্তুত গত শতকের নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত তিনি তার এলোমেলো জীবন যাপনের জন্য বিখ্যাত ছিলেন। প্রয়াত কবি ত্রিদিব দস্তিদারের কাছে শুনেছি, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কিংবদন্তি প্রতিম ‘অবনী বাড়ি আছো?’ কবিতাটি ষাটের দশকের বেলাল চৌধুরীকে নিয়েই লেখা। প্রকৃতপক্ষে মধ্য-শেষ ষাটের কলকাতায় ‘কৃত্তিবাস’ গোষ্ঠীর কবিদের সাহচর্যেই বেলাল চৌধুরী তাঁর নিজস্ব জীবনযাপনের পদ্ধতি অর্জন করেছিলেন। শক্তি-সুনীল-তারাপদ-শরতের কাছেই তিনি শিখেছিলেন কিভাবে নিজের জীবনকে ঘষে আগুন জ্বালাতে হয়। ‘চার জোড়া পায়ের ঘায়ে রবীন্দ্র রচনাবলী লুটোয় পাপোসে।’ বেলাল ভাইয়ের কাছে শুনেছি ১৯৬৫-এর পাক-ভারত যুদ্ধের নি®প্রদীপ মহড়াও তাকে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের উদ্যাম সাহচর্য উপভোগ থেকে বিরত রাখতে পারেনি। উত্তরবঙ্গের অরণ্যভূমি ছিল দু’জনেরই অসম্ভব প্রিয় (সুনীলেরও)। সময় পেলেই দু’জন মধ্য-শেষ ষাটের কলকাতার জন-অরণ্য পিছনে ফেলে চলে যেতেন উত্তরবঙ্গের কোন ডাকবাংলোয় অনির্দিষ্টকালের জন্য। সত্তরের দশকের প্রথমার্ধে রচিত সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘সংসারে এক সন্ন্যাসীতে’ তাদের ঐ সময়ের বিচিত্র জীবন যাপনের কিছু চিহ্ন রয়েছে। অন্তত : নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত কবি বেলাল চৌধুরীর ঐ বর্ণাঢ্য জীবনযাত্রা প্রায়-অব্যাহত ছিল। কিন্তু ওই সবই আজ অতীত। কবি বেলাল চৌধুরীর সদ্য সমাপ্ত বহুমাত্রিক জীবনের দিকে যদি আজকে পেছন ফিরে তাকাই, তা হলে প্রথমেই দৃষ্টিগোচর হয় তার কবি পরিচয় ও সম্পাদক পরিচয়ের মধ্যে এক দুর্ভাগ্যজনক, অনিবার্য দ্বন্দ্ব। তাঁর কাব্যচর্চার শুরু, সম্ভবত:, পঞ্চাশের দশকে ঢাকায়। তিনি ছিলেন বিউটি বোর্ডিং গোষ্ঠীর এক স্মৃতি ভারাতুর সদস্য। সেখানেই তিনি অগ্রজ প্রতিম সৈয়দ শামসুল হক, শামসুর রাহমানের কাছে কবিতার প্রথম পাঠ গ্রহণ করেন। ‘অগত্যা’ পত্রিকার সম্পাদক ফজলে লোহানী ছিলেন তার আরেক প্রিয় ব্যক্তিত্ব। কিন্তু বেলাল চৌধুরীর জীবনের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় শুরু হয় ১৯৬৩ সালে তার কলকাতার খিদিরপুর ডকে অবতরণের মাধ্যমে। প্রথম ষাটের নিস্তরঙ্গ, প্রায় নিদ্রামগ্ন ঢাকা থেকে আসা এক তরুণ উৎসুক দৃষ্টি নিয়ে ব্যস্ত কলকাতার রাজপথে বিচরণ শুরু করেন। কাকতালীয়ভাবে পথিমধ্যে দেখা হয় লেখক কমলকুমার মজুমদারের অগ্রজ ‘সুবর্ণ রেখা’ প্রকাশনীর প্রতিষ্ঠাতা-স্বত্বাধিকারী ইন্দ্রনাথ মজুমদারের সঙ্গে। ইন্দ্রনাথ মজুমদার অনেকাংশে স্নেহবশতই, তাকে স্বগৃহে নিয়ে আসেন। সেই তার এক যুগব্যাপী কলকাতা প্রবাস জীবনের শুরু। কমলকুমার-ইন্দ্রনাথ মজুমদার ভ্রাতৃদ্বয়ের মাধ্যমেই বেলাল চৌধুরীর পরিচয় ঘটে ‘কৃত্তিবাস’ গোষ্ঠীর কিংবদন্তি খ্যাত কবিদের সঙ্গে; তাদের সাহচর্যেই বেলাল চৌধুরী অর্জন করেন কবিতার প্রতি তার আমৃত্যু প্রশ্নাতীত আনুগত্য। পরবর্তীতে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় স্বয়ং মধ্য-ষাটের দশকে কলকাতায় ‘দৈনিক কবিতা’ পত্রিকা প্রকাশের সময় অমূল্য ভূমিকার কথা উল্লেখ করেছেন। ‘কৃত্তিবাস’ সম্পাদনার সঙ্গেও বেলাল চৌধুরী জড়িত ছিলেন। বেলাল চৌধুরীর কবিতা তার অনেক সমসাময়িকের মতো, কোনক্রমেই চিৎকার প্রধান নয়। কল্পনার বিস্তার তার কবিতার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। নিচু গলার উচ্চারণে তিনি পাঠককে জানিয়ে দেন তার আজন্ম বিস্ময় বোধের কথা। তবে, তার আজন্ম সঙ্গী পঞ্চাশের কবিদের মতই, তাঁর কবিতা প্রধানত ব্যক্তিগত উচ্চারণ দ্বারা চিহ্নিত। বেলাল চৌধুরীর রাজনৈতিক বিশ্বাস ছিল সর্বজনবিদিত, কিন্তু তা কখনোই তার কবিতার জন্য অনাবশ্যক ভারে পরিণত হয়নি। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে অনেক ক্ষেত্রে হয়ত তার কবি পরিচয়কে ছাপিয়ে উঠেছে তার সম্পাদক পরিচয়। কলকাতার কিংবদন্তি প্রতিম ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকার সম্পাদনার সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন বিগত শতাব্দীর মধ্য-ষাটের দশক থেকেই। পরবর্তীতে মধ্য-সত্তরের দশকে ঢাকা আগমনের পরে তার সম্পাদকখ্যাতি বাংলাদেশেও বিস্তৃতি লাভ করে। বিগত শতাব্দীর শেষ-সত্তর থেকে নয়াপল্টনের গাজী ভবন থেকে প্রকাশিত এবং বেলাল চৌধুরী সম্পাদিত নব পর্যায়ের সাপ্তাহিক ‘সন্ধানী’ হয়ে ওঠে তৎকালীন বাংলাদেশের নবীন-প্রবীণ সব লেখকের প্রাণকেন্দ্র। কে আসতেন না সেখানে? সৈয়দ শামসুল হক-কাইয়ুম চৌধুরী-কালাম মাহমুদ থেকে তরুণতম লেখক পর্যন্ত সবাই। তবে আড্ডার প্রাণকেন্দ্র সর্বদাই থাকতেন কবি বেলাল চৌধুরী। সে সময় প্রতিকূল পরিস্থিতিতে নয়া পল্টনে সাপ্তাহিক ‘সন্ধানীর’ কার্যালয় হয়ে উঠেছিল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লেখক-শিল্পীদের প্রাণকেন্দ্র। তার সমান্তরালে ক্রমশ বৃদ্ধি পায় সন্ধানী প্রকাশনীর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের সংখ্যা। বেলাল চৌধুরীর তত্ত্বাবধানে প্রকাশিত তৎকালীন সাপ্তাহিক ‘সন্ধানীর’ কিছু সংখ্যার প্রচ্ছদ আজও স্মরণযোগ্য হয়ে আছে। পরবর্তীকালে ‘তারকালোক’ এবং ‘সাপ্তাহিক সন্দ্বীপ’ ‘Bangladesh Today’ পত্রিকায় স্বল্পকালীন অবস্থান সত্ত্বেও বেলাল চৌধুরী আশির দশকের শেষার্ধে স্থিতি লাভ করেন তৎকালে ধানমন্ডি থেকে প্রকাশিত ‘ভারত বিচিত্রা’ পত্রিকায়। স্বাভাবিকভাবেই ‘ভারত বিচিত্রার’ ধানমন্ডি অফিস পরিণত হয় পক্ষ-বিপক্ষের প্রায় সব কবি-লেখকের প্রাণকেন্দ্রে। নিয়মিতভাবে উপস্থিত থাকতেন কবি রফিক আজাদ-রবিউল হুসাইন-হাবিবুল্লাহ সিরাজী প্রমুখ। তরুণতর সাহিত্যিকরা তো ছিলেনই। দশকাধিক কালব্যাপী ‘ভারত বিচিত্রা’ কার্যালয় হয়ে ওঠে বাংলাদেশের সাহিত্যিক আড্ডার প্রাণকেন্দ্র। কিন্তু দিন শেষে বেলাল চৌধুরী ছিলেন এক কবি, কাব্যসেবক। তার সর্বশ্রেষ্ঠ প্রমাণ পাই ১৯৯৯ সালে কবি জীবনানন্দ দাশের জন্ম শতবার্ষিকী উদযাপনের সময়। জন্ম শতবার্ষিকী উপলক্ষে পশ্চিমবঙ্গে শত আড়ম্বরপূর্ণ আয়োজন সত্ত্বেও মধ্যবছর পর্যন্ত যখন জন্ম শতবার্ষিকী উদযাপনে বাংলাদেশে কেউই এগিয়ে আসলেন না, তখন বেলাল চৌধুরীর নেতৃত্বে আমরা কয়েকজন মিলে ‘জীবনানন্দ জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন পরিষদ’ গঠন করা হয়। ওই পরিষদের উদ্যোগেই ১৯৯৯ সালের জুলাই মাসে জাতীয় জাদুঘরের তৎকালীন মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খানের সক্রিয় সহযোগিতায় জাতীয় যাদুঘর মিলনায়তনে জীবনানন্দ জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে এক স্মরণযোগ্য সভা অনুষ্ঠিত হয়, যাতে আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ থেকে আবদুল মান্নান সৈয়দসহ সকল উল্লেখযোগ্য জীবনানন্দপ্রেমী উপস্থিত ছিলেন। পরবর্তীকালে প্রধানত কবি বেলাল চৌধুরীর সচেষ্ট উদ্যোগেই কবি জীবনানন্দ দাশের জন্য একটি স্মারক ডাকটিকেট প্রকাশিত হয়। একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে নিয়মিতভাবেই প্রায় প্রতি বছর জীবনানন্দ দাশের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে চ্যানেল আইতে আমাদের উদ্যোগে বেলাল ভাই এবং কবি আবদুল মান্নান সৈয়দের উপস্থিতিতে প্রাণবন্ত আলোচনা অনুষ্ঠান প্রচারিত হতো। মনে আছে, ২০০৫ সালের অনুষ্ঠানে প্রধানত বেলাল চৌধুরীর উদ্যোগেই উপস্থিত ছিলেন জীবনানন্দ দাশের জীবনী রচয়িতা প্রখ্যাত মার্কিন অধ্যাপক ক্লিনটন সিলী। তাতে ঐ বছরের জীবনানন্দ আলোচনায় ভিন্ন এক মাত্রা যুক্ত হয়। উল্লেখ্য, বেলাল চৌধুরীর সঙ্গে অধ্যাপক ক্লিনটন সিলীর বন্ধুত্ব ছিল ষাটের দশকের কলকাতা থেকে অদ্যাবধি বিস্তৃত। বেলাল চৌধুরীর শুরু কবিতায়, শেষও সেখানেই। শেষ কয়েক বছরের অসুস্থতা ছিল পরিব্রাজক স্বভাবের বেলাল চৌধুরীর জন্য অসহনীয়। কুশল জিজ্ঞেস করলে বলতেন, ‘এসব কেন জিজ্ঞেস করছো? আমি তো শেষ।’ তিনি জানতেন না যে, তিনি তার সমবয়সী-অসমবয়সী বন্ধুদের মনে চিরদিন প্রচ- উজ্জ্বলতায় জীবিত থাকবেন। বেলাল চৌধুরীর প্রস্থান অগ্রজ হারানোর বেদনার সমতুল্য। বেলাল ভাই, আমরাও আসছি। লেখক : জীবনানন্দ দাশ গবেষক ও প্রাবন্ধিক
×