ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

নৌকাডুবির কমলা ও হেমনলিনী

প্রকাশিত: ০৭:২৬, ৪ মে ২০১৮

নৌকাডুবির কমলা  ও হেমনলিনী

চোখের বালির পরে রবীন্দ্রনাথের আর এক উল্লেখযোগ্য উপন্যাস ‘নৌকাডুবি’ ১৯০৩ সালে বঙ্গদর্শনে নিয়মিত প্রকাশ পেতে থাকে। চোখের বালির বিষয়, আঙ্গিক, ঘটনা, চরিত্র গঠন সমাজ বাস্তবতা সর্বোপরি শৈল্পিক অনুভব থেকে ভিন্ন মাত্রার আর এক আয়োজন এই নৌকাডুবি। চরিত্রগুলোর মনোজাগতিক দ্বন্দ্বই শুধু নয় বিনোদিনীর চারিত্রিক দম্ভ আর দৃঢ়তা তার সঙ্গে অবিচ্ছিন্ন হয়ে আছে নতুন ধারার শুভসূচনা করে ঐতিহ্যিক সংস্কারে ফিরে যাওয়া। এসব মিলিয়ে চোখের বালির যে অন্য মাত্রার আবহ নৌকাডুবিতে তা প্রায়ই অনুপস্থিত। কারণ এই গ্রন্থের চরিত্র নিরুপণে লেখক অনেক বেশি সতর্ক ছিলেন। এখানে শুরু থেকেই তিনি সমাজ-লালিত বিধি সংস্কারের চিরায়ত ধারাকে কোনভাবেই ঘটনা বিন্যাস কিংবা চরিত্রের গঠনশৈলী থেকে বিচ্ছিন্ন করেননি। নবজাগরণের স্রোতে উপন্যাসের আঙ্গিক সিক্ত হয়নি বরং সমকালীন সমাজ আর মূল্যবোধ থেকে শুরু করে পারিবারিক বন্ধন, শুচিতা, পবিত্রতাকে ধীরস্থিরভাবে মূল বিষয়ের অনুষঙ্গ করে তোলেন। আর নারী চরিত্র রূপায়ণে তাকে আরও সংহত আর অপ্রতিরোধ্য করে তোলেন। ১৯০৩ সালে লেখা উপন্যাসটি ভূমিকা নতুন করে সংযোজন করেন ১৯৪০ খ্রিঃ। যেখানে উপন্যাসের মূল চেতনাগত বিন্যাস কবির বর্ণনায় হয়ে ওঠে চিরায়ত সমাজ সংস্কারের এক অনির্বাণ দীপ্তি। বিশেষ করে সতী-সাধবী স্ত্রীর মনোজগতে স্বামীর চিরস্থায়ী আসন কেবলমাত্র ক্ষণিকের আবেগমাত্র নয় শুদ্ধ সংস্কারের এক মঙ্গল দ্বীপও বটে। আর যে কোন নারী হৃদয়ে তা নিঃসংশয়ে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে থাকে। কবির উক্তিই সরাসরি উল্লেখ করা যাকÑ ‘স্বামীর সম্বন্ধের নিত্যতা নিয়ে যে সংস্কার আমাদের দেশের সাধারণ মেয়েদের মনে আছে তার মূল এত গভীর কিনা যাতে অজ্ঞাতজনিত প্রথম ভালবাসার জালকে ধিক্কারের সঙ্গে সে ছিন্ন করতে পারে। কিন্তু এসব প্রশ্নের সার্বজনীন উত্তর সম্ভব নয় যাতে অপরিচিত স্বামীর সংবাদমাত্রেই সব বন্ধন ছিঁড়ে তার দিকে ছুটে যেতে পারে। বন্ধনটা এবং সংস্কারটা দুই সমান দৃঢ় হয়ে যদি নারীর মনে শেষ পর্যন্ত দুই পক্ষের অস্ত্র চালাচালি চলত তা হলে গল্পের নাটকীয়তা হতে পারত সুতীব্র, মনে চিরকালের মতো দেখা দিত তার ট্রাজিক, শোচনীয়তার ক্ষতচিহ্ন। ৪২ বছর বয়সে লেখা এই উপন্যাসটির এই ভূমিকা লেখেন প্রায়ই ৩৭ বছর পর। যখন তাঁর বয়স ৭৯। সমাজ-সংস্কারের সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষক রবীন্দ্রনাথ নারী চরিত্র চিত্রায়নেও অনেকটা সাবেকী আমলকে পেছনে ফেলতে পারেননি। কিছুটা অবশ্যই সমকালীন সমাজের দায়বদ্ধতা বাকিটা ভেতরের অকৃত্রিম বোধ থেকেই। চোখের বালির বিনোদিনী কবির অন্যরকম সৃষ্টি। কিন্তু লক্ষ্মী প্রতিমা আমার আদলে গড়া কমলার স্নিগ্ধ, শুদ্ধরূপ বিধিবদ্ধ সমাজেরই নিরন্তর শিখা। বিশ শতকের গ্রাম আর কলকাতার নগর পরিবেশ কোনভাবেই মেলানো যাবে না। শহরকেন্দ্রিক আধুনিকতা এবং পল্লী বাংলার মনোরম নৈসর্গিক রূপের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়ানো ধর্মীয় আবেগ, চিরায়ত সংস্কার এবং যুগ যুগ ধরে গেঁথে থাকা প্রাচীন মূল্যবোধ। আধুনিক ব্রাহ্মধর্মের সামান্য প্রভাবও গ্রামে-গঞ্জে, প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছায়নি। তাই কমলা গোঁড়া হিন্দু সমাজের প্রতিনিধি আর শহুরে হেমনলিনী ব্রাহ্মধর্মের অনুসারী। ব্রাহ্মধর্মের সক্রিয় উপস্থিতি এই নৌকাডুবিতেই প্রথম বলে মনে করেন বিশিষ্ট রবীন্দ্র গবেষক সৈয়দ আকরাম হোসেন। সনাতনী হিন্দুত্ববাদ এবং নিরাকার ব্রহ্মের অনুভব সমাজে দ্বৈত অবস্থার বিচিত্র আবহ। পল্লী জননীর কোলে লালিত কমলার একটু বেশি বয়সে (১৫) বিয়ে হলেও তার লেখাপড়া তেমন ছিল না। গ্রাম বাংলার বিধবা মায়ের কন্যাসন্তান সামাজিক নিয়ম মাফিক স্বামীগৃহে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয় শৈশব-কৈশোর থেকেই। সেখানে শিক্ষা বা নতুন কোন বিশ্বাস নারী জাতির সামনে আলোর দিশারী হয়ে আসে না। কমলা তারই সত্যিকারের অনুগামী। আর হেমনলিনী ব্রাহ্ম বাবার সন্তানই শুধু নয়, আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েও প্রথাসিদ্ধ সমাজকে নিয়ে বিন্দুমাত্র কটাক্ষ করে না। একদিকে নবজাগৃতির ভাব সম্পদ অন্যদিকে প্রচলিত সামাজিক শৃঙ্খল। সব মিলিয়ে রবীন্দ্রনাথ নিজেই দ্বিধান্বিত, নতুন-পুরাতনের মিশ্র অভিযোজনে খানিকটা দিশেহারাও বটে। যার সুস্পষ্ট ছাপ পড়ে রমেশের ওপর আরও তীব্রভাবে কমলা এবং হেমনলিনী বিপরীত বিশ্বাসের দুই রমণীর চরিত্র বিন্যাসে। উল্লেখ্য, ব্রাহ্মধর্মের একনিষ্ঠ সাধক মহর্ষির কনিষ্ঠতম সন্তান রবীন্দ্রনাথ পারিবারিকভাবে এই ধর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত। কিন্তু উপন্যাসটির লেখার সময় কবি বঙ্কিমচন্দ্রের কঙ্গদর্শনেরও সম্পাদক। ফলে চিরায়ত হিন্দু সংস্কারের অনেক গোঁড়ামি কবির পারিবারিক বিশ্বাস বোধে নাড়া দেয়া বিচিত্র কিন্তু নয়। তাই শুধু রমেশ, কমলা কিংবা হেমনলিনীর চরিত্রের নির্মাণ শৈলীতেই শুধু নয় পুরো গ্রন্থটির বিষয় আর বৈশিষ্ট্যের মূল সারবত্তায়ও যুগান্তকারী ভূমিকা রাখে। নারীর কমনীয় রূপের শুদ্ধতা আঁকতে গিয়ে তাঁকে অনেক সময় কঠিন বাস্তবকেও উপেক্ষা করতে হয়। আবহমান বাংলার শক্ত প্রাচীরকে তিনি নারী চরিত্রের গতি-প্রকৃতি এবং পরিণতিতেও কঠিনভাবে আঁকড়ে ধরেন। যেখানে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলায় দোদুল্যমান হয়েও তাঁর সযতেœ গড়া নায়িকাদের সামাজিক নীতিনিষ্ঠতায় আবদ্ধ করে রাখেন। কমলা রমেশ সম্পর্কের টানাপোড়নে রবীন্দ্রনাথ বিব্রত হলেও অবশেষে সতী-সাধবী স্ত্রীই তাঁর সৃষ্টিতে উজ্জ্বল হয় বিবাহিত স্বামী-স্ত্রী না হয়েও রমেশ কমলা তিন মাস দাম্পত্য সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। এক সময় রমেশের কাছে তা স্পষ্ট হলেও কমলা কিছুই জানতে পারে না। রক্ষণশীল হিন্দু পরিবারের সন্তান রমেশ ছলে, বলে, কৌশলে কখনও কমলাকে বৈবাহিক নিগূঢ় বন্ধনে জড়ায়নি। নীতিবোধ থেকে এটা অনেকটা স্বাভাবিক হলেও প্রায়ই অস্বাভাবিক রমেশকে স্বামী জেনেও কমলা নিজেকে সমর্পণ না করা। এর যথার্থ জবাব লেখক বইটির ভূমিকাতে দেন। সনাতন ধর্মের চিরায়ত সংস্কার নারীকে স্বভাবগতভাবে সংযত, সংহত, সম্বরণ করতে শেখায়। ফলে রমেশ কমলার জীবনে অধর্মের, সংস্কার বিরোধী কোন চিহ্ন পড়তে দেয়া হয়নি। এটা শুদ্ধতা, শুচিতার দিক থেকে ন্যায়সঙ্গত হলেও নারী-পুরুষের স্বাভাবিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সত্যিই কঠিন। স্বামী জেনেও রমেশের একান্ত সান্নিধ্যে কমলা দৃঢ় সংযমের পরিচয় দেয়। কেবলমাত্র সাবেকী আমলের নারীর কল্যাণময়ী রূপের পবিত্রতা রক্ষা করতেই লেখক নারী- পুরুষের প্রবৃত্তিবহির্ভূত সম্পর্কের অবতারণা করলেন প্রায় ৩ মাস। অনেকটা ব্যক্তিক অনুভূতি আর অম্লান আর অক্ষুণœ রাখলেন। শেষ অবধি তিনি জিতলেনও। কিন্তু অন্য ভাবেও কমলার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নির্মিত হলো ভিন্ন ধারায়। যেদিন প্রথম কমলা জানতে পারে রমেশ তার স্বামী নয় তার মধ্যে সেদিন যে অনমনীয় লেখক কর্তৃক চিত্রিত হয় তাও অস্বাভাবিক। সত্য জানার পর মুহূর্তে তিন মাসের সমস্ত স্মৃতি অপসৃত হয়। দুঃখে, অপমানে, লজ্জায় বিড়ম্বিত কমলা গৃহত্যাগী হয়। কিন্তু আত্মঘাতী হয় না। পরম নিষ্ঠার সঙ্গে অচ্ছেদ্য বন্ধনে বাধা স্বামীর সন্ধানে ঘুরে বেড়ায়। কারণ কবি এই উপন্যাসের একেবারে প্রথম থেকেই কমলাকে দেশকালের অপ্রতিরোধ্য সংস্কারের প্রতিনিধি হিসেবে তাঁর সমস্ত মনের মাধুরী দিয়ে তৈরি করেন যা বিনোদিনীর ক্ষেত্রে পারেননি। অন্তত কমলার চরিত্রে তিনি আধুনিক ও সনাতন ধারার মিশ্রণ ঘটাতে মোটেও চাননি। নারীত্বের ঐতিহ্যিক শক্তিই কবির কাছে সমাজ সভ্যতার স্থায়ী সৌন্দর্য, দৃঢ় বন্ধন। দেশজ সংস্কৃতি নির্ভর প্রথাসিদ্ধ পন্থায় নারী শক্তির সৌন্দর্য নির্ধারণ করেন। এমনকি আধুনিক হেমনলিনীর ক্ষেত্রেও এ ধারার ব্যত্যয় করেননি। কারণ হেম কখনও দেশ, কাল ও সমাজকে অতিক্রম করেনি। জীবন ও মনে ঝড় তোলা হরেক রকম ঘটনা-দুর্ঘটনা হেম সুস্থ, স্বাভাবিক এবং সাবলীলভাবে মেনে নেয়। কোথাও কোন তিক্ততা, বিষণœতা কিংবা প্রলয়ের পূর্বাভাস প্রতিভাত হয়নি। এমন কি রমেশকে গ্রহণ-বর্জনের যে শক্ত অভিব্যক্তি তাও হেমের দৃঢ় সত্তার এক অবিমিশ্র নান্দনিক সৌধ। অপরাজিতা প্রতিবেদক
×