ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

সমস্ত কুসংস্কারের, শৃঙ্খলের শিকল ভাঙ্গার এক ধারালো হাতিয়ার। নিয়মের উর্ধে জীবনকে তার নিজ গতিতে বেড়ে ওঠার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। যা দর্শায় নারী নয়, এক জীবনের রূপ। যার প্রকাশে প্রকৃতি হাসে। না অলঙ্কার না প্রসাধনী, যার রূপের সজ্জায় স্বয়ং চাঁদের কিরণের লেপন। ধ

প্রকৃতির ছায়ায় সমাপ্তির মৃন্ময়ী

প্রকাশিত: ০৭:২৬, ৪ মে ২০১৮

 প্রকৃতির ছায়ায় সমাপ্তির মৃন্ময়ী

পপি দেবী থাপা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোট গল্প ‘সমাপ্তি’র মৃন্ময়ী চরিত্রটি বাংলা সাহিত্যে নারী মুক্তি, নারী জাগরণ এমনকি এক উৎফুল্ল নারী হৃদয়ের ব্যাপ্তি প্রকাশের এক অনবদ্য উদাহরণ। মৃন্ময়ীর বেড়ে ওঠার প্রতিটি ধাপে নারীর মনোভাব, তার ইচ্ছা প্রকাশ পেয়েছে। উঠে এসেছে নারীর বন্দীদশা এবং প্রতি পদক্ষেপে জড়ানো অদৃশ্য শিকলের করুণ ঝনঝনানি। মৃন্ময়ী সমাজের প্রচলিত প্রথার বাইরে বেড়ে ওঠা এক দুর্বার, সরল, নির্ভীক, মুক্তমনা নারী চরিত্র। সমস্ত কুসংস্কারের, শৃঙ্খলের শিকল ভাঙ্গার এক ধারালো হাতিয়ার। নিয়মের উর্ধে জীবনকে তার নিজ গতিতে বেড়ে উঠতে দেয়ার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। যা দর্শায় নারী নয়, এক জীবনের রূপ। যার প্রকাশে প্রকৃতি হাসে। হাসির ছন্দে দোলে ভুবন। না অলঙ্কার না প্রসাধনী, যার রূপের সজ্জায় স্বয়ং চাঁদের কিরণের লেপন। ধরনী লুটায় সুধা তারই চরণ তলে। যেন তারই মাঝে প্রাণ প্রকৃতি মিশে একাকার। যে জীবন মানে না নারী-পুরুষের ভেদ। সে জানে না সংসারের মেকি ঢং। যে প্রাণ সত্যকে, আনন্দকে বরণ করতে সদা উদগ্রীব। যাকে আবদ্ধ রাখতে পারে না সমাজের কোন নিয়ম। যা গতিময়। যেন জীবন্ত আলোকছটায় দীপ্যমান এক প্রাণ। যার মাঝে নেই নারী চরিত্রের নির্দিষ্ট ছাঁচে বেড়ে ওঠা কোন বৈশিষ্ট্য। সাজসজ্জায় নিজেকে কৃত্রিমতায় প্রকাশের নেই কোন বালাই। সদা হাস্যোজ্জ্বল মেয়েটির চোখে না আছে লজ্জা, না আছে ভয়, না আছে হাবভাবলীলার লেশমাত্র। তার উন্মুক্ত হাসির উচ্ছলতায় কোন কিছুই বাঁধা সৃষ্টি করতে পারে না। তার কৌতূহলী মন অবুঝ শিশুর মতন জগতকে জানার চেষ্টায় সদা উদগ্রীব। যে চরিত্রকে তুলে ধরার মধ্য দিয়ে কবিগুরু দেখিয়েছেন তৎকালীন সমাজ ভাবনা। আর সে ভাবনায়, নারীর অবস্থান। যেখানে ফুটে উঠেছে বাল্য বিবাহ, নারীর গ-িবদ্ধ পৃথিবী। যেখানে নারী সংস্কারের জালে আবদ্ধ নরম মাটির দলা হিসেবে বিবেচিত। যা অপরের ইচ্ছায় তার নিজের রূপ ধারণ করে অবিরত। এক কথায় না বোঝার মধ্য দিয়ে জীবনের শুরু আর না বোঝার মধ্য দিয়েই শেষ। এ ছাড়াও গল্পটিতে সমাজে বিবাহের পূর্বে মেয়ে দেখানোর আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানের মধ্যে লুকিয়ে থাকা নারীর অসহায়ত্বতা, পরনির্ভরতা সুস্পষ্ট প্রতীয়মান। আর এ অসহায় নারী জাগরণের মিছিলের অগ্রপথিক হচ্ছে মৃন্ময়ী। যে বাঁচতে চায় বস্তু নয়, মানুষ হিসেবে। এ গল্পে মৃন্ময়ী চরিত্রটি থেকে এ সমাজের দেখানো আবেগ প্রকাশ পেয়েছে। এখানে পরিষ্কারভাবে বোঝা যায় সমাজে এ জাতীয় ভাবনায় বেড়ে ওঠা মেয়েদের, অনেকে পছন্দ করলেও বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে তাদের জীবনসঙ্গিনী হিসেবে গ্রহণ করাটাকে এই তারাই ঝামেলা বা বিপদ মনে করেন। তারা মনে করেন এ ধরেনের সঙ্গিনীকে নিজেদের ইচ্ছায় চালনা করা হবে কষ্টকর। এ পাখি বশ মানতে চাইবে না সহসায়। আর বিবাহিত জীবন! সে যেন পুরোপুরিই বর্ণহীন। খেলার বয়সেই কারাবাস ॥ বড় আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে এ বিষয়গুলো নারীদের মধ্যে এমনভাবে গেঁথে গেছে যেন, এটাই জীবন। আর তা না মানাটাই বুঝি ঘোর পাপ। যুগ যুগ ধরে এ প্রথায় নিঃশেষ হয়ে যাওয়া নারীরাও তার পরবর্তী বংশধরদের মধ্যে অনায়াসে বিস্তার ঘটিয়ে যাচ্ছে বহন করে আসা নিয়মের ধারা। তার ভাবনার জগতটি যেন পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। রুদ্ধ হয়ে গেছে তার বাক্। এ সবের মধ্য দিয়েই বেরিয়ে আসা মৃন্ময়ী সমাজের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখানো এক প্রতিবাদী প্রতীক। যার মনে হয়েছিল বিবাহিত জীবন যেন যাবজ্জীবন কারাদ- বা ফাঁসির আদেশ। যেখানে বিয়েতে মত-অমত, পচ্ছন্দ-অপচ্ছন্দের কোন সুযোগই ছিল না সেখানে মৃন্ময়ী ‘দুষ্টু পোনি ঘোড়ার মতো ঘাড় বাঁকাইয়া পিছু হটিয়া বলিয়া বসিল ‘আমি বিবাহ করিব না।’ একটি নারীর জীবনে বিবাহ পরবর্তী সময় তার চলমান গতিকে মুহূর্তের মধ্যে পরিবর্তন করে তোলে। কোন রকম পূর্বাভাস বা পূর্ব অভ্যস্ততা ছাড়াই, সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি পরিবেশে, সমস্ত কিছু সহ্য করে, সবাইকে আপন করে, অন্যের ইচ্ছায় টিকে থাকার এক অপার চেষ্টা। কিন্তু সেখানে এ বিষয়গুলো মৃন্ময়ীর অবুঝ সরল হৃদয় মেনে নিতে পারছিল না। তার বিদ্রোহ যেন ঝঙ্কৃত হচ্ছিল সমস্ত প্রকৃতিতে। সে প্রতিবাদের ভাষা কখনও সরব আবার কখনওবা নীরব। যা এ সমাজের নারী জাতির মনে মানুষ হিসেবে টিকে থাকার ইচ্ছাটাকে সদা জাগ্রত রাখার আহ্বান জানায়। এ চরিত্রের মধ্য দিয়েই প্রকাশ পেয়েছে, পিঞ্জিরার পাখিকে আটকে রাখলে এক সময় সে যেমন ছটফট করে নীরব হয়ে যায়। তেমনি নারীর জীবন। আর এ খাঁচার শিকল ভাঙ্গার চেষ্টায় এক অবিস্মরণীয় দৃষ্টান্ত হচ্ছে মৃন্ময়ী। বিবাহিত জীবনে নারী হৃদয়ে আপনা থেকে যে প্রেমের সৃষ্টি হতে পারে তা ছিল তখনকার সময়ে ভাবনার অনেক উর্ধে, যা বিশ্বকবি মৃন্ময়ীকে তুলে ধরার মধ্য দিয়ে বুঝিয়েছেন। জোর নয়, তাকে তার অনুুভূতির জায়গাগুলো খোঁজার, বোঝার এবং অনুভবের জন্য সময় দেয়া। প্রেমে প্রাপ্তির ব্যাকুলতাকে অনুভব করতে দেয়া। এসব কিছুই প্রকৃতির নিয়মে নির্দিষ্ট সময়ের ছন্দে বাঁধা তা মৃন্ময়ী চরিত্রটিতে খুবই স্বচ্ছ। মৃন্ময়ী দেখিয়েছে, সমাজে দম বন্ধ করা নারী মনকে দাবিয়ে রাখার নিয়ম কানুনের ধূ¤্র জালের বাইরে, জগতের সকলকে আপন করে ভালবাসার মধ্যে বেড়ে ওঠা এক সরল জীবনধারী মেয়েও এক সময় তার নিজের সংসার গুছিয়ে নিতে পারে তার আপন আঙ্গিকে। এখানে দেখানো হয়েছে প্রকৃত অর্থে জীবনের পূর্ণাঙ্গ বহমান অবস্থা। একের পর এক বাঁধা যেমন গতিময়তাকে তিলে তিলে ক্ষীণ করে তোলে, তেমনি প্রতি পদে আষ্টেপৃষ্ঠে আঁকড়ে ধরা বাঁধাগুলো জীবনের গতিকে থেঁতো করে দেয়। ধীরে ধীরে শুকিয়ে যায় তার প্রাণ। সে ধাবিত হয় কৃত্রিমতার ছাঁচে গড়া নিয়মের ভেতর দিয়ে। এক সময় নারী ভুলে যায় সে নিজে এক স্বকীয় সত্তা। এক মানুষ। ভুলে যায় তার নিজেরও কোন ইচ্ছা থাকতে পারে। সেও সৃষ্টি করতে পারে তার পছন্দ অনুযায়ী কোন নিয়ম। অন্তরের গভীর বোধ, ভালবাসার মহিমা সর্বোপরি চিরায়ত বাঙালি বধূর অম্লান দ্যুতিতে মৃন্ময়ীর যে গতি নির্ণয় তা লেখকের নিজস্ব চেতনার এক চমৎকার অভিযোজন।
×