ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বোহেমিয়ান বেলাল ভাই -আনিসুর রহমান

প্রকাশিত: ০৭:১৪, ৪ মে ২০১৮

বোহেমিয়ান বেলাল ভাই -আনিসুর রহমান

কবি বেলাল চৌধুরী নামটির সঙ্গে পরিচয় ১৯৮০ দশকেই স্কুলের ছাত্র থাকা অবস্থায়। অই সময়ে দৈনিকের সাহিত্য পাতাগুলোতে কবি সুফিয়া কামাল, কবি শামসুর রাহমানের পরে পর্যায়ক্রমে যাদের কবিতা ছাপা হতো তাদের মধ্যে বেলাল চৌধুরী অন্যতম। নামগুলো এখনো চোখে ভাসে : সৈয়দ শামসুল হক, রফিক আজাদ, আল মাহমুদ, সিকদার আমিনুল হক, মহাদেব সাহা, নির্মলেন্দু গুণ, মুহাম্মদ নুরুল হুদা, আসাদ চৌধুরী এরকম। তখন কবিতা বুঝি আর না বুঝি সাহিত্য পাতা ঘেটে ঘেটে সব পড়ে ফেলি। শৈশবের অই সময়ে কল্পনায়ও আসেনি একদিন শহরের নির্মম বাস্তবতায় কবি বেলাল চৌধুরীর স্নেহের ছায়া পাব। বেলাল চৌধুরী মানে আমাদের ছোট বড় সকলের বেলাল ভাই। ঢাকা শহরটা বেলাল ভাইর মোহনীয় ব্যক্তিত্বের কাছে যেন একটা মহল্লা। পত্রিকা পাড়া থেকে সচিবালয়, সচিবালয় থেকে দূর্তাবাস পাড়া। ধনী লোকদের ধানমন্ডি, পল্টন, পুরান ঢাকা সদরঘাট, বাংলা বাজার বিউটি বোডিং সব যেন বোহেমিয়ান বেলাল ভাইর কব্জায়। ভোর থেকে শুরু করে মধ্য রাত পর্যন্ত এর কাজ ওর কাজ নিয়ে ব্যস্ত। যাচ্ছেন এখান থেকে সেখানে পায়ে হেঁটে নয় তো রিক্সায়। কেমনে কেমনে যেন ঢাকাইয়া মধ্যবিত্তের প্রায় সকলের হাঁড়ির খবর বেলাল ভাইর কাছে চলে আসত। বেলাল ভাইর লেখালেখির চেয়ে বড় কাজ হলো নিজের খেয়ে বনের মহিষ তাড়ানো। দিনরাত মানুষের উপকার করে বেড়ানো; বিশেষ করে লেখকদের। এরকম আরেকজন ছিলেন আমাদের শামসুর রাহমান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং কবি মুহাম্মদ সামাদ, আমাদের সামাদ স্যার বেলাল ভাইর সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। এরপর নানা কারণে অকারণে বেলাল ভাইর সঙ্গে দেখা, আলাপচারিতা কিছুটা আড্ডা; আড্ডা আর কি বেলাল ভাই বলেন, তার সামনে বসে কম বয়সী আমরা দুই একজন শুনি আর ফাঁক পেলে দুই একটা প্রশ্ন করি। বেলাল ভাইর ড্রইং রুম ছিল আমার জন্যে এক বিস্ময়। পুরো বাসায় বই আর বই। দেশী বিদেশী নানা বিষয়ের পত্রপত্রিকা, বই পুস্তক। গ্রাম থেকে আসা কম বয়সী আমার মতো একজনের জন্যে ছিল চরম বিস্ময়। বেলাল ভাইর লেখার টেবিল এবং কাঠের গোল চেয়ার ছিল আমার জন্যে আকর্ষণীয়। সেই ড্রাইং রুম, সেই চেয়ার আজও আমার চোখে উজ্জ্বল। এরপর দুনিয়ার নানা দেশে-বিশেষ করে টমাস ট্রান্সট্রয়মার, শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক থেকে শুরু করে অনেক খ্যাত অখ্যাত মানুষের ড্রইংরুম দেখেছি। কিন্তু বেলাল ভাইর বাসার বইঘেরা সেই মোহনীয পরিবেশই আমার চোখে রাজ্যের এক বিস্ময়। বেলাল ভাইর কলকাতার বোহেমিয়ান জীবনের গল্প কমবেশি আমাদের ঢাকা শহরের লেখালেখি জগতের সকলের আলাপে প্রাসঙ্গিক বিষয়। তিনি কিন্তু ঢাকার জীবনেও কম বোহেমিয়ান ছিলেন না। ঢাকার মধ্যবিত্ত আর উচ্চবিত্ত মানুষগুলো বেলাল ভাইয়ের এই সরল বোহেমিয়ানের সুযোগ নিয়ে তাদের ব্যবসায়িক এবং পারিবারিক স্বার্থ হাসিল করতে চাইত। প্রায়ই রাত বিরেতে পানাহারের মজমা বসিয়ে বেলাল ভাইর যোগাযোগ কাজে লাগাত। বেলাল ভাইর সহধর্মিণী, আমাদের ভাবী পরলোকে চলে যাবার পর, সংসারের ধকলটা এসে পরে বেলাল ভাইর অল্প সয়সী মেয়ে মৌরীর ওপর। বেলাল ভাইয়ের উদ্বেগ ছিল মৌরীকে নিয়ে, বাবা হিসেবে। অন্যদিকে মৌরীর উদ্বেগ দেখে মনে হতো যেন বোহেমিয়ান ছেলের প্রতি মায়ের উদ্বেগ। মৌরী বেলাল ভাইর ভাল মন্দের প্রতি যথেষ্ট খেয়ালী ছিল। রাতবিরেতে বের হতে নিরুৎসাহিত করত। একপর্যায়ে এমন হলো সামাদ স্যার বেলাল ভাইর সঙ্গে থাকলে মৌরী দুঃশ্চিন্তা মুক্ত থাকত। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ১৯৯০ এর শেষের দিকে। কবি রবিউল হুসাইনের সহধর্মিণী ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে দীর্ঘদিন যাবত ভর্তি। রবিউল ভাই কেবিনের বাইরে অপেক্ষা করতেন। আমি আর সামাদ স্যার রাতে গিয়েছি কয়েকবার। বেলাল ভাইও আসতেন। রবিউল ভাইকে বেলাল ভাই রবিদা বলে সম্বোধন করতেন। আমার কানে বাজত সম্বোধনটা বুঝি খোদ রবীন্দ্রনাথকে। দৈনিক জনকণ্ঠে বল্লাব সেন নামে একটা কলাম লিখতেন। একবার বাংলা একাডেমির অনুষ্ঠান আর কবিতা উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান একই দিনে একই সময়ে পড়ে গেল। বাংলা একাডেমীর অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রধান অতিথি। বেলাল ভাই বল্লাল সেনের কলামে এই বিষয়ে লিখলেন। বিষয়টা প্রধানমন্ত্রীর নজরে এলো। প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে বাংলা একাডেমির অনুষ্ঠান পিছিয়ে বিকেলের দিকে নেয়া হলো। একবার কবি ত্রিদিব দস্তিদার অসুস্থ হয়ে পড়লেন। আত্মীয় পরিজনহীন ত্রিদিবদার আর কে আছে এই শহরে। অই বেলাল ভাইর শেষে ত্রিদিব দা মারা গেলেন। বেলাল ভাই সকলকে ফোন করে জড়ো করে বড় ভাইর দায়িত্ব পালন করলেন। উনি কতভাবে যে কত বিষয় তুলে ধরতেন আর মানুষের উপকার করতেন। আমি বেলাল ভাইর কাছে নানাভাবে ঋণী। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। এদিক সেদিক লেখালেখি করি একটু আধটু। প্রাইভেট টিউশনি করে ঢাকা শহরে পেট চালানোর কথা ভাবছি। দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় প্রুফ রিডার নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেখে আবেদন করি। যথারীতি এক শুক্রবারে সাক্ষাতকার বোর্ডে উপস্থিত হই। সাক্ষাতকার বোর্ডে অন্যদের মাঝে সাংবাদিক মনজুরুল আহসান বুলবুল এবং সম্ভবত কবি সোহরাব হাসান। ওনাদের কারও সঙ্গেই ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল না। তবে বুলবুল ভাইর নামের সঙ্গে এবং সোহরাব ভাইর লেখার সঙ্গে পরিচিত ছিলাম। আমার জীবন বৃত্তান্ত দেখে ওনারা বললেন আপনার যে ফলাফল, আপনি প্রুফ রিডারের কাজ কেন করতে চান? আমি বললাম- আমি সংবাদপত্রের কাজটা শিখতে চাই, আর টিউশনির বিকল্প হিসেবে নিতে চাই। তখন ওনারা বললেন- আপনাকে যদি অন্য কাজ দেওয়া হয়, ডেস্কে সহসম্পাদকের কাজ, আপনি কি করবেন? আমি বললাম অবশ্যই করব। আমি ফুর্তিতে অনেকটা লাফাতে লাফাতে চলে এলাম। তারপর বুলবুল ভাই সংবাদের সহসম্পাদক শাহ মুহাম্মদ মুতাসিম বিল্লাহ ভাইয়ের মাধ্যমে জানালেন আমাকে সহসম্পাদক কাজের জন্যে একটু পরীক্ষা নিতে চান। আমি সংবাদ অফিসে গেলাম। তিনি বিদেশী সংবাদের ইংরেজী ভাষ্য রেখে গেছেন ডেস্কে আমার জন্যে। আমি বাংলায় অনুবাদ করে দিয়ে আসলাম। এর মধ্যে সংবাদের মূল ডেস্কে শামু ভাই ছাড়া অন্য যারা ছিলেন তারা ভেতরে ভেতরে দল পাকালেন, বিরোধিতা করলেন- এত অল্প বয়সী একটা ছেলে উচ্চ মাধ্যমিক পাস। বেকল সম্মান শ্রেণীর ছাত্রকে তাদের সমকক্ষ হিসেবে মেনে নিতে তাদের আপত্তি। আমার চাকরি আর হয় না। কি করি? সামাদ স্যারকে গিয়ে বললাম। উনি সঙ্গে সঙ্গে বেলাল ভাইকে ফোন করলেন। বেলাল ভাই অই সপ্তাহের শুক্রবার সকালে ওনার বাসায় যেতে বললেন। বেলাল ভাই আর আমি বেইলি রোডে মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর সরকারী বাসায় গেলাম। এখানে উল্লেখ্য, সংবাদের তৎকালীন সম্পাদক বজলুর রহমান যিনি মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর স্বামী। দোতলার বারান্দায় বসে বজলু ভাইর সঙ্গে কথা হলো। বেলাল ভাই বললেন সংবাদে আনিসের চাকরিটা আকে আছে। বজলু ভাই বললেন আমি জানি। ‘ও’ আপাতত প্রুফে কাজ শুরু করুক। ডেস্কে একটু সমস্যা আছে। আমরা চলে এলাম। সংবাদে কাজে যোগ দিতে আমি আগ্রহ হারিয়ে ফেললাম। এর পরে একদিন সামাদ স্যার আমাকে জানালেন বেলাল ভাই তোমাকে খুঁজতেছেন। বেলাল ভাইকে যথারীতি ফোন করলাম। উনি জানালেন ভারতীয় দূতাবাসে তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগে বাংলা ও ইংরেজী জানা একজনকে নিয়োগ দেবে। আমি তোমার কথা ভেবে রেখেছি। তুমি আমার কথা বলে প্রথম কাউন্সিলর নীতা ভূষণের সঙ্গে দেখা করবে। নীতা ভূষণের সঙ্গে আমি দেখা করলাম। চাকরি হয়ে গেল। পরের দিন কাজেও যোগ দিলাম। কাজের পরিবেশ আমার পছন্দ হল না। সন্ধ্যায় সামাদ স্যারকে গিয়ে বললাম আমার মন টানছে না এই কাজে। স্যার বললেন তাহলে যেও না, ফোন করে না করে দাও। পড়ালেখায় মন দাও। এরপর আমি আর বেলাল ভাইর সামনে পড়ি না। স্যার জানালেন বেলাল ভাই মন খারাপ করেছেন, তোমার ওপর রেগে আছেন। আমি তো সংকোচে বেলাল ভাইকে এড়িয়ে চলি, বেশ কিছুদিন পরে সামাদ স্যারই জানালেন, বেলাল ভাই তোমার কথা জিজ্ঞেস করলেন, তুমি বেলাল ভাইর সঙ্গে যোগাযোগ কর। এরকম ছিলেন বেলাল ভাই। ওনার বাসায় চায়ের চুলাটা আমার ধারণা চব্বিশ ঘণ্টাই চালু থাকত। সেই সঙ্গে বেলাল ভাইর রাজকীয় টেলিফোন। এত মানুষের কাজে উনি এসেছেন, এত মানুষের উপকার যে করেছেন আজকের কর্পোরেট বাস্তবতায় বড়ই অবিশ্বাস্য। সে এক প্রজন্ম বটে। একবার কথা প্রসঙ্গে বেলাল ভাইকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, মৃত্যু নিয়ে ওনার কি ভাবনা? উনি বলেছিলেন, তেড়াবেকা হয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে, মরে যাওয়াই ভাল। বলার মধ্যে একটা প্রতীকী প্রকাশ ছিল। যদি বেঁচেই থাক মাথা উঁচু করে বাঁচ। বেলাল ভাইর বিদায় মানে এরকম মাথা উঁচু করা এক অধ্যায়ের বিদায়। ঢাকার লেখালেখি জগতের বোহেমিয়ান এক রাজার বিদায়।
×