ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সরকার মাসুদ

ধ্বনি আর ধ্যানী

প্রকাশিত: ০৭:০৭, ৪ মে ২০১৮

ধ্বনি আর ধ্যানী

বাংলাদেশের আশির প্রজন্মের সুপরিচিত কবি মারুফ রায়হান। কাব্যচর্চার পাশাপাশি তিনি প্রবন্ধও লিখে আসছেন অনেক বছর ধরে। কিন্তু পাঠক মহলে তার প্রাবন্ধিক-পরিচিতি তেমন স্পষ্ট নয়। কেননা এ দেশে অল্প কিছু পাঠকই কেবল একজন লেখকের সার্বিক লেখালেখি সম্বন্ধে পরিষ্কার ধারণা রাখেন। গত প্রায় এক দশকে তার মোট চারটি প্রবন্ধের বই প্রকাশিত হয়েছে। আগের তিনটি গ্রন্থ হচ্ছে ১. প্রেম, প্রার্থনা ও বিবিধ গদ্য (২০০৯), ২. সমকালীন সাহিত্য: উত্তাপ ও আলাপ (২০১২), ৩. শিল্প সমাজ সংস্কৃতি (২০১২)। ‘ধ্বনি আর ধ্যানী’ মারুফের সর্বশেষ প্রবন্ধের বই। প্রকাশকাল ফেব্রুয়ারি-২০১৭। এতে যেমন আছে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল জীবনানন্দ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সমর সেন, মহাশ্বেতা দেবী, আবুল হোসেন প্রমুখের ওপর লেখা; তেমনি আছে শহীদ কাদরী, সৈয়দ শামসুল হক, শামসুর রাহমান প্রমুখকে নিয়েও প্রবন্ধ। আছে ‘ছন্দে বর্ণে উচ্চারণে : ইতিহাসের মহানায়ক’ শিরোনামে একটি রচনা যেখানে লেখক বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রচিত বেশ কিছু কবিতার ভাল-মন্দ বিষয়ে বলেছেন। গ্রন্থের দুটি ব্যতিক্রমী প্রবন্ধ- ক. ‘শহীদ লেখকদের রচনা অপঠিত কেন? খ. ‘নভেরার জন্য ভালোবাসা।’ এ ছাড়া স্মৃতিচারণমূলক এবং ফিচারধর্মী কয়েকটি লেখাও গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। প্রথমে ‘জগৎ ও জীবনানন্দ’ শিরোনামের লেখাটির কথা বলব। কবি জীবনানন্দের মানস-ভূগোল বিষয়ে সঠিক আলোকপাতের সমান্তরালে লেখক এখানে পরোক্ষভাবে একটি প্রশ্ন করেছেন। তা হচ্ছে, ‘নির্জনতার কবি’ বললে জীবনানন্দের প্রজ্ঞা-প্রতিভাকে খাটো করে দেখা হয় না- কি? যেভাবে ‘পল্লীকবি’ আখ্যা দিয়ে জসীম উদ্দীনকে আমরা অতি সীমাবদ্ধ করে ফেলেছি; তেমনি ‘নির্জনতার কবি’ বললে জীবনানন্দকেও একটা ছোট গ-ির ভেতর আটকে ফেলা হয় যা অত্যন্ত অসমীচীন। এত বড় একজন কবির জন্মদিন মৃত্যুদিন চলে যায়; তাকে তেমনভাবে স্মরণ করা হয় না। বড়জোর দু’-একটি কাগজে একটি/দুটি গদ্য লেখা হয় তাকে নিয়ে। বিষয়টি লেখকের কলমে উঠে এসেছে এভাবেÑ ...‘স্মরণের উপলক্ষস্বরূপ উভয়ের (রবীন্দ্র-নজরুল) জন্ম-প্রয়াণ বার্ষিকী তো রয়েছেই। তা ছাড়াও বছরভরই এই দুই কবি নানাভাবে শব্দসাম্রাজ্যে বিচিত্র রচনায়, মঞ্চমুখরতায় বিবিধ উপস্থাপনায় এবং ইলেকট্রনিক ধ্বনিচিত্র মাধ্যমে বিশদ নির্মাণ শিল্পে বহুমুখিতায় সংবর্ধিত হন। সে বিচারে জীবনানন্দ এখনও অনেকটা উপেক্ষিত।’ ‘নজরুল : প্রেমিক ও বিদ্রোহী’ গ্রন্থের আরেকটি উল্লেখযোগ্য রচনা। কিভাবে একজন সমাজচেতন সাম্যবাদী কবির মধ্যে প্রেমিক ও বিদ্রোহী সত্তা এক বিন্দুতে এসে মিলেছে, তা এখানে দেখিয়েছেন লেখক। জাতি হিসেবে আমরা এখনও নানা রকম তুচ্ছতায় আবিষ্ট। আমরা বড় কিছু নিয়ে খুব একটা ভাবতে পারি না। কেউ কেউ ভাবলেও সেটাকে স্বার্থহানির ভয়ে কাজে পরিণত করতে দেয়া হয় না। বিস্মৃতিপ্রবণ, ঈর্ষাপরায়ণ, দায়সারা-কাজে অভ্যস্ত এই আত্মঘাতী জাতি। শুধু ব্যতিক্রমী কবি হিসেবে নয় সমন্বয়বাদী কল্যাণী ভাবুক হিসেবেও যে নজরুল অনেক বড় একথা ভুলে যাওয়া এবং তাকে খ-িতভাবে বিচার করার পেছনেও সক্রিয় ওই সব প্রবণতা। আলোচক এসব নিয়ে সোচ্চার হয়েছেন। ‘কবি শহীদ কাদরী : অমরত্বের দিকে যাত্রা’য় পাওয়া যাচ্ছে অভিমানী এই কবি সম্বন্ধে হৃদয় নিংড়ানো উচ্চারণ। মারুফ নিজে কবি বলেই আরেকজন সৎ কবির মনোজগতটি সঠিকভাবেই ধরতে পেরেছেন। কাদরীর কবিতার ওপর বেশি কথাবার্তা নেই এখানে। তবু যতটুকু আছে যথার্থই আছেÑ ‘শহীদ কাদরীর প্রথম কাব্যের প্রথম কবিতা ‘বৃষ্টি বৃষ্টি’। কোন কবির আত্মপ্রকাশ এবং আত্মস্বর প্রচার-প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে প্রথম কবিতাটি সব সময় বিশেষ বিবেচনার দাবি রাখে। এই কবিতায় পাই সম্পূর্ণত নগরের বৃষ্টি; এবং বৃষ্টি নিয়ে বাঙালীর কবিতাপনার সম্পূর্ণ বিপরীত ছবি ...‘সহসা সন্ত্রাস ছুঁলো।’ বর্ষার এসে পড়া প্রকাশ করতে গিয়ে ‘সন্ত্রাস’ শব্দের প্রয়োগ। একেবারে অভাবিত।’ শামসুর রাহমান এবং শহীদ কাদরী- দু’জনের কবিতাতেই নগর বিরাট জায়গা জুড়ে আছে। কাদরীকে নিয়ে লিখতে লিখতে প্রবন্ধকার একটা জায়গায় এই দুই প্রধান কবির সাযুজ্য ও বৈপরীত্য নিয়েও বলেছেন। এই বক্তব্যে কবিজনোচিত উপলব্ধি এবং নগরবাসের অভিজ্ঞতার সারাৎসার লক্ষণীয়Ñ ... ‘এই দুই শক্তিমান নাগরিক এবং আধুনিক কবিই নিজ অস্তিত্ব ও পারিপার্শ¦ সম্পর্কে অসন্তুষ্ট এবং কিছুটা বিপন্ন ও বিব্রত। তবে উভয় কবির প্রাথমিক কবিত্বশক্তির তুলনা করলে দেখব একজনের ভেতর রয়েছে মিহিভাবালুতা, অতিকথন এবং বাংলা কবিতা- ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা; অন্যজন ঋজু, একচুল পরিমাণও বাড়তি শব্দ ব্যবহারে অসম্মত এবং পরিপূর্ণভাবে ভাবাবেগবর্জিত ও মননময়।’ সৈয়দ শামসুল হকের আশিতম জন্মদিন ও তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘ভালোবাসার দিনে’ উপজীব্য হয়েছে ‘কবির জন্মদিনে : ‘ভালোবাসার দিনে’ শিরোনামের লেখাটির। কাব্যগ্রন্থটির কবিতা নিয়ে মন্তব্য করার আগে লেখক প্রেম সম্বন্ধে কবি-শোভন চমৎকার উক্তি করেছেনÑ ‘প্রেম-নিজেই সে গরিব গ্রহের এক আশ্চর্য সুন্দর ধ্বনিময় কবিতা। দুটি টলটলে থরথর উত্থালপাথাল হৃদয়ের নৈঃশব্দে নিহিত এক পরম প্রাণভোমরা।’ প্রাবন্ধিক বলছেন, ‘পরিণত কবির প্রেমপঙ্ক্তি চিত্রপটে ধরে রাখে প্রেমের দর্শন, সূক্ষ্ম সঞ্জিবনী। সেখানে প্রাজ্ঞের অভিজ্ঞতার শাস আর প্রতারিতের পতনের ফাঁস মিলেমিশে থাকতে পারে। এখন আমি সৈয়দ শামসুল হকের ‘ভালোবাসার দিনে’ পর্যটন করতে গিয়ে ছুঁয়ে যেতে পারছি ভালবাসার ভুলগুলোকে, ফুলগুলোকে। কবি নির্দিষ্টভাবে নিজের কথা বলেন প্রেমের কবিতায়, আবার পৃথিবীর বহু প্রেমিকের বহুল স্বরও বেজে উঠতে পারে তার শব্দে।’ একই প্রবন্ধে লেখক প্রেমের কাব্যে অন্ত্যমিল জরুরী কিনা এই প্রয়োজনীয় প্রশ্নটি তুলেছেন। অতঃপর নিজেই উত্তর দিয়েছেন ‘না জরুরী নয়।’ তারপর বলেছেন ‘স্মরণীয় প্রেমের কবিতাসমূহের বেশিরভাগের মধ্যেই আমরা চরণান্তিক মিল লক্ষ্য করি।’ লেখকের যুক্তি হচ্ছে, এই ধরনের মিল ‘ওষ্ঠের উচ্চারণ ও শ্রুতির সংবেদনের জন্য আরামপ্রদ।’ যুক্তিটা মননগ্রাহী বলেই মনে হয়েছে আমার। এ গ্রন্থের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রচনা ‘জন্মশতবর্ষে সমর সেন’। গদ্যচর্চায় তীব্রভাবে নিয়োজিত থাকতে পারলে মারুফ প্রাবন্ধিক হিসেবে উজ্জ্বল হয়ে উঠতে পারবেন, এই লেখাটি সেই প্রতিশ্রুতিই দিচ্ছে। গ্রন্থভুক্ত অন্যান্য প্রবন্ধের তুলনায় এই রচনাটিতে ভাবনার শৃঙ্খলা ও যুক্তির উপস্থিতি সংহততর। কবি হিসেবে সমর সেনের অবস্থান এবং তার বিশিষ্টতার ক্ষেত্রগুলোও চমৎকারভাবে প্রতিভাত হয়েছে এখানে। প্রবন্ধে ব্যবহৃত গদ্যও যথেষ্ট ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন। একই সঙ্গে তা মননসম্মতও বটে। দুটি উদাহরণ- ১. তিরিশের প্রবল পরাক্রমশালী পাঁচ মহৎ কবির পর বাংলা কবিতার যে বাঁক দল এবং আবহমানতা- দুটোর মাঝখানে নিঃসঙ্গ দ্বীপের মতো সমর সেনের অবস্থান। তার অনুসারী তেমন পাননি, ঘরানাও গড়ে ওঠেনি। ২. সমর সেনের প্রথম দিকের কবিতায় বিষণœতার সৌন্দর্য আবিষ্কার করা যায়, তাতে সত্যের সৌন্দর্যও অপ্রকাশিত থাকে না। ওই হাহাকারময় বিভিন্ন সত্য প্রকাশের জন্য যে শব্দ সম্ভার কবি নির্বাচন করেন তাতে কবিতাদেবীর রহস্যমদিরতা ছাপিয়ে রাজত্ব করতে থাকে শিক্ষিত নাগরিক আধুনিক মানুষের প্রতিদিনের জীবনে ব্যবহৃত শব্দ ও প্রকাশভঙ্গি। গ্রন্থের শেষ রচনা ‘নভেরার জন্য ভালোবাসা।’ ঈর্ষাতপ্ত, চক্রান্তদীর্ণ এই গরিব দেশে অসামান্য প্রতিভা নিয়ে জন্মেছিলেন শিল্পী নভেরা। অভিমান করে শহীদ কাদরীর মতোই দেশ ছেড়েছিলেন চিরতরে। তাকে নিয়ে উপন্যাস রচিত হয়েছে। তাকে নিয়ে গাল-গল্পের শেষ নেই আজ! অথচ জীবদ্দশায় তার শিল্পকর্মের যথার্থ মূল্যায়ন হয়নি। নিবন্ধকার গভীর মমতার সঙ্গে, সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করেছেন তার কথা-...‘বড় অভিমানিনী ওই শিল্পীসত্তা বার বার আহত হয়েছে। ছেনি-বাটালি-হাতুড়ি দিয়ে যে ভাস্কর প্রেমে-শ্রমে সৃষ্টি করে চলেছিলেন একের পর এক আধুনিক শিল্পকর্ম, তার নিজের অবয়বের ওপরই চলছিল অদৃশ্য বাটালি-হাতুড়ির অশিল্প অপঘাত। কী নিদারুণ ট্র্যাজেডি।’ প্রবন্ধচর্চা কঠিন এক সাধনার নাম। কাব্যে আলো-আঁধারের আশ্রয় নেয়া চলে। অস্পষ্টতা কবিতার জন্য ক্ষতিকর নয়। কিন্তু অস্বচ্ছতা গদ্যের জন্য বিপজ্জনক। সাহিত্য বিষয়ক অজ গ্রন্থ স্পষ্টতাদোষে দুষ্ট। এগুলোর মধ্যে যুক্তিশৃঙ্খলা ও ভাসাপ্রসাদের অভাব বড় হতাশাব্যঞ্জক। ধ্বনি আর ধ্যানী সেক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। বইটির প্রকাশক চিত্রা, প্রচ্ছদশিল্পী রাকীব হাসান।
×