ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বই

পারস্যে রবীন্দ্রনাথ -দীপংকর চক্রবর্তী

প্রকাশিত: ০৬:৫৮, ৪ মে ২০১৮

পারস্যে রবীন্দ্রনাথ -দীপংকর চক্রবর্তী

শরীর ক্লান্ত। তবু পারস্যরাজের নিমন্ত্রণকে অস্বীকার করতে পারেননি রবীন্দ্রনাথ। বয়সও সত্তর অতিক্রম করেছে। নানা দ্বিধাকে অতিক্রম করে সিদ্ধান্ত নিলেন পারস্য যাত্রার। সময়টা গ্রীষ্মকাল। নানা চিন্তা-ভাবনার পর সিদ্ধান্ত হয়েছে বিমানে করে যাবেন কবি। সঙ্গে যাবেন পুত্রবধূ প্রতিমা দেবী আর কর্মসহায়করূপে অমিয় চক্রবর্তী ও কেদারনাথ চট্টোপাধ্যায়। এক সপ্তাহ আগেই রওনা হয়ে গেলেন কেদারনাথ। ১১ এপ্রিল ১৯৩২-এ যাত্রা শুরু। এলাহাবাদ, যোধপুর আর করাচীতে যাত্রা বিরতি করে ১২ এপ্রিল সমুদ্র তীরবর্তী ছোট গ্রাম জাস্ক-এ আবার যাত্রাবিরতি। রাতযাপন। ১৩ এপ্রিল ভোর চারটায় যাত্রা শুরু করে সকাল সাড়ে আটটায় পৌঁছে গেলেন বুশোয়ারে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা ভাল এটি রবীন্দ্রনাথের জীবনে দ্বিতীয় বিমানযাত্রা। স্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করেই রেল আর জাহাজ পথকে এড়িয়ে যাওয়ার কথা ভেবেছিলেন কবি। আগের যাত্রাগুলোতে কিন্তু এ রকম ভাবেননি তিনি। একবার মাত্র লন্ডন থেকে প্যারিসে উড়ে গিয়েছিলেন। বাকি সব যাত্রা স্থলপথে কিংবা জাহাজযোগে। ১৩৩৯ এর ২৫ বৈশাখ এখানেই পালিত হয় তার জন্মদিন। পারস্যে এই জন্মদিনের স্মৃতি রবীন্দ্রনাথের জীবনে এক নতুন করে পাওয়ার ইতিহাস। এর আগে এর জন্মদিন পালিত হয়েছে নিজ দেশে। এবারই প্রথম জন্মদিন পালিত হলো দেশের বাইরে। নানা বর্ণের ফুলে ফুলে ভরে গেছে কবির চারদিক। ফুলের মধ্যে আবার গোলাপের প্রাধান্য। আসছে নানা রকম উপহার। সরকারের কাছ থেকে এসেছে পদক ও ফরমান। বিকেলে নিমন্ত্রণ ছিল শিক্ষা বিভাগের মন্ত্রীর বাসভবনে। সেখানে দেশের প্রধানরা উপস্থিত ছিলেন। ছিলেন বিদেশের রাষ্ট্র প্রতিনিধিরা। আবেগতাড়িত রবীন্দ্রনাথ একে মনে করছেন নিজের দ্বিতীয় জন্ম হিসেবে। ২৫ বৈশাখ ১৩৩৯-এ লেখা একটি কবিতায় তিনি এই দিনটির আবেগকে রেখেছেন। ‘পারস্যে জন্মদিন’ শীর্ষক কবিতায় তিনি লিখলেন- ইরান, তোমার যত বুলবুল তোমার কাননে যত আছে ফুল বিদেশী কবির জন্মদিনেরে মানি শুনলো তাহারে অভিনন্দন বাণী। ইরান, তোমার বীর সন্তান, প্রণয়-অর্ঘ্য করিয়াছে দান আজি এ বিদেশী কবির জন্মদিনে, আপনার বলি নিয়েছে তাহারে চিনে। ইরান, তোমার সম্মানমালে নব গৌরব বহি নিজ ভালে সার্থক হলো কবির জন্মদিন। চিরকাল তারি স্বীকার করিব ঋণ তোমার ললাটে পরানু এ মোর শ্লোক ইরানের জয় হোক। রবীন্দ্রনাথ তার ‘জাপানে-পারস্যে’ গ্রন্থের ‘পারস্যে’ অংশে (যা পরে আলাদাভাবে মুদ্রিত) তার পারস্য যাত্রা ও সেখানে অবস্থানের বিস্তারিত লিখেছেন। কিন্তু পারস্যে রবীন্দ্রচর্চা বিষয়ে তেমন কিছু তার গ্রন্থে নেই। আনিছুর রহমান স্বপন দীর্ঘদিনের ইরান বাসকালে সেখানকার মহাফেজখানার ধুলো ঘেঁটে সেইসব বিষয় তুলে এনেছেন ‘পারস্যে রবীন্দ্রচর্চা’ নামের বইয়ে। মূল বইটিকে তিনি তিন ভাগে ভাগ করেছেন। প্রথম ভাগে আছে পারস্যে রবীন্দ্রচর্চা, দ্বিতীয় ভাগে পারস্যের পত্রিকায় রবির সফর এবং তৃতীয় ভাগে আছে পারস্যে রবীন্দ্রনাথের দেয়া সাক্ষাতকার। প্রথম ও দ্বিতীয় অংশের শেষে যুক্ত টিকা-টিপ্পনি অংশ লেখকের বক্তব্যকে অনেক সহজবোধ্য করে তোলার পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে অনেক অজানা তথ্যের বাতায়ন খুলে দিয়েছে সাধারণ পাঠকের সামনে। বহু চিত্র শোভিত এ বইটি পারস্যে রবীন্দ্রচর্চার একটি চমৎকার দলিল। রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পরের বছর (১৯১৪) রবীন্দ্রনাথের একটি নির্বাচিত কাব্য সঙ্কলন ‘বাগবান’ (মালিনী) নামে ফার্সিতে অনূদিত ও প্রকাশিত হয়। এই তথ্য দিয়ে অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের প্রথম পারস্য বিজয়ের সংবাদ দিয়ে শুরু হয়েছে বইটি। এভাবে ধারাবাহিকভাবে কোন সময়ে রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে কোন বই বেরিয়েছে। তার বিবরণ রয়েছে এ বইয়ের প্রথম অংশে। লেখক যথাসম্ভব সমস্ত খুঁটিনাটি তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন এ পর্বে। দ্বিতীয় অংশে আছে রবীন্দ্রনাথের পারস্য ভ্রমণকালে যে সব খবর প্রতিদিন ইরানের পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে তার একটি অনুপুঙ্খ বিবরণ। শেষ অংশে আছে ইরানের পত্রিকায় দেয়া রবীন্দ্রনাথের দুটি সাক্ষাতকারের বঙ্গানুবাদ। সব মিলিয়ে কবিগুরুর মাসাধিককালের পারস্য অবস্থানকালে যা যা ঘটেছে এবং আগে পরে যা যা হয়েছে তাকে নিয়ে তার একটি প্রায় পূর্ণ বিবরণ রয়েছে এই বইটিতে। প্রায় পূর্ণ বলা হচ্ছে এ কারণে যে ‘প্রাককথন’ অংশে আনিস জানাচ্ছেন তার কাছে আরও তথ্য আছে। বিবিধ সীমাবদ্ধতার কারণে বর্তমান বইয়ে তিনি সকলের সব আশা পূরণ করতে পারেননি। পাঠক প্রকাশকের আনুকূল্য পেলে ভবিষ্যতে তিনি তা পূরণ করে দেবেন। রবীন্দ্রনাথ তার সারা জীবনে অনেক দেশ ঘুরেছেন। সে সময়কার বর্ণনা তার কোন কোন লেখায় মিলবে। তার সফরসঙ্গীরাও অনেকে সেই যাত্রার বর্ণনা দিয়েছেন। কিছু তথ্য মিলছে স্থানীয় কারও বর্ণনায়। কিন্তু সবটা কখনও আসেনি। আনিস তার দশ বছরের ইরান বাসকালে নিজস্ব আগ্রহ থেকে সব কিছু খুঁজে দেখার চেষ্টা করেছেন। বেশ কিছু দুষ্প্রাপ্য ছবিও তিনি সংগ্রহ করেছেন। সব মিলিয়ে তার বইটি পারস্যে রবীন্দ্রনাথের অবস্থানকালীন সময়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে প্রকাশিত, তার লেখা নিয়ে প্রকাশিত বই বা পত্রিকার বর্ণনায় আনিস গভীর নিষ্ঠার পরিচয় দিয়েছেন। বইয়ের রচনাকাল, বিষয়বস্তু, সাপ, পৃষ্ঠসংখ্যা, প্রচ্ছদের রং, উৎসর্গ, ছবির ব্যাখ্যা, বিভিন্ন সংস্করণের পার্থক্য কোন কিছুই তার নজর এড়ায়নি। পাঠককে সবটাই জানাতে চেয়েছেন লেখক। এত বিস্তৃতভাবে আলোচনা সচরাচর কম চোখে পড়ে। রবীন্দ্রনাথের পারস্য ভ্রমণের অনেক পরে, এমনকি তার মৃত্যুরও পরে, জন্মের শতবার্ষিকীতে তেহরান জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় দু’দিন ধরে রবীন্দ্র উৎসবের আয়োজন করেছিল। প্রকাশিত হয়েছিল একাধিক স্মারক সংখ্যা। রবীন্দ্রনাথের লেখার সঙ্গে পারসকি রচনার আত্মীয় সম্পর্ক বিচার, তার ওপর কোন কোন পারসিক কবির প্রভাবসহ বহুবিধ রচনা প্রকাশ পেয়েছে এ দেশের পত্রিকায়। তার প্রায় সব ধরনের রচনাই ১৯১৪ সাল থেকে শুরু করে আজ অবধি অনূদিত হয়েছে। প্রকাশিত হয়েছে সংক্ষিপ্ত আকারে তার জীবনী এবং সেই সূত্রে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস। ভারতবর্ষের বাইরে, আগেও বলেছি, রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনের উৎসব হয়েছে শুধুমাত্র পারস্যে এবং তা হয়েছে রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতিতে এবং সরকারীভাবে। বইটির দ্বিতীয় অধ্যায়, অর্থাৎ সংবাদপত্রের খবরগুলো থেকেও বেশ কিছু অভিনব তথ্যের সন্ধান মেলে। একটি তথ্যে বলা হচ্ছে শুধুমাত্র রবীন্দ্রনাথ ও তার সফরসঙ্গীদের থাকার ব্যবস্থা করার জন্যই দুটি ভবনের, যার একটি ইরান সাহিত্য সংসদ ভবন। সংস্কার করা হয়েছিল। এ ভবনের মিলনায়তনটি ব্যবহার করা হচ্ছিল রবিঠাকুরের সাক্ষাতপ্রার্থীদের সঙ্গে আলোচনা ও আপ্যায়নের জন্য। ১৬ এপ্রিলের পত্রিকার খবর থেকে জানা যায় রবীন্দ্রনাথ কতদিন পারস্যে থাকবেন তা নির্দিষ্ট হয়নি। তবে সপ্তাহ দুয়েক তিনি থাকবেন বলে মনে করা হয়। কিন্তু বাস্তবে তিনি অসুস্থ শরীর নিয়েও মাসাধিককাল পারস্যে কাটান। ১৮ তারিখের ‘এডেলাড’ পত্রিকার ১ম পৃষ্ঠায় মোট ৫ কলামের ৩ কলামজুড়ে ছিল রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে বিস্তৃত আলোচনা যা রবীন্দ্রনাথের প্রতি পারসিকদের সম্মান প্রদর্শন ও আগ্রহকেই নির্দেশ করে। এর পরও নানা সময়ে পত্রিকার পাতার অর্ধেক যা বেশি জায়গা দখল করে নিয়েছেন কবি। এখানেই রুশ চিত্রশিল্পী প্রফেসর পেট্রোশেঙ্কো বেশ ক’দিন ধরে রবীন্দ্রনাথের ছবি আঁকেন এবং রবীন্দ্রনাথ দীর্ঘ সময় ধৈর্যের সঙ্গে নিশ্চল বসে থেকে প্রতিকৃতির জন্য পোজ দেন। ৫ মে ধর্ম ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে রবীন্দ্রনাথকে সম্মানসূচক পিএইচডি ডিগ্রী দেয়া হয়। পত্রপত্রিকায় তার চেহারা, খাদ্যাভ্যাস, ধর্মীয় চিন্তা, দর্শন, সাহিত্যসহ জীবনাচরণের সবদিক নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা হয়। পত্রিকার সাংবাদিক তাকে প্রায় সার্বক্ষণিক অনুসরণ করে চলেন এবং তার প্রতিদিনকার জীবনের খুঁটিনাটি খবর পরিবেশন করেন। এভাবে ‘পারস্যে রবীন্দ্রনাথ’ বইতে খুঁজে পাওয়া যাবে রবীন্দ্রনাথের প্রতি পারস্যবাসীর ভালবাসার বহু খবর। এক মাসের বেশি সময় পারস্যে প্রচন্ড ব্যস্ত সময় কাটিয়েছেন কবি। আর এই ব্যস্ততার ছবি নানা সূত্রে খুঁজে পেয়ে একত্রিত করেছেন বইটির লেখক। বইটির পরবর্তী সংস্করণে আশা করব লেখকের কথা অনুযায়ী আরও নতুন তথ্য যুক্ত হবে। নতুন ব্যাখ্যা স্থান পাবে। লেখককে শ্রমসাধ্য এই কাজটির জন্য ধন্যবাদ জানাইতে হয়।
×