ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট স্যাটেলাইট প্রযুক্তির সদর-অন্দর

প্রকাশিত: ০৬:৫১, ৪ মে ২০১৮

বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট  স্যাটেলাইট প্রযুক্তির সদর-অন্দর

নির্ধারিত তারিখ কয়েক দফা পেছানোর পর সর্বশেষ খবরে জানা গেল বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ আপাতত স্থগিত। এটি জিও-স্টেশনারি স্যাটেলাইট বা ভূ-স্থির উপগ্রহ। এর মাধ্যমে বিশ্বের ৫৭তম স্যাটেলাইট ক্ষমতাধর দেশের তালিকায় যুক্ত হবে বাংলাদেশ। এটি উৎক্ষেপনের জন্য গাজীপুরের জয়দেবপুর ও রাঙ্গামাটির বেতবুনিয়ায় দুটি গ্রাউন্ড স্টেশন নির্মাণের কাজ শেষ পর্যায়ে। ইতোমধ্যে গ্রাউন্ড কন্ট্রোল স্টেশনের প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিও আমদানি করেছে বিটিআরসি। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটে ৪০টি ট্রান্সপন্ডার থাকবে, যার ২০টি বাংলাদেশ ব্যবহার করবে। বাকি ২০টি অন্যান্য দেশকে ভাড়া দেয়া হবে। দেশের ৩৭টি স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলের কাছে ফ্রিকোয়েন্সি বিক্রির মাধ্যমে বছরে প্রায় ১২৫ কোটি ডলার আয় হবে। এসব চ্যানেল এখন বিদেশের বিভিন্ন স্যাটেলাইট থেকে ফ্রিকোয়েন্সি কিনে অনুষ্ঠান প্রচার করছে। এতে অনেক বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে। তবে এ টিভি চ্যানেলগুলো এখনকার প্রচলিত কেবলভিত্তিক প্রচারের পরিবর্তে ছোট ডিস এ্যান্টেনার সরাসরি টিভি সিগন্যাল পাবে। তাছাড়া উচ্চগতির ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথ, দেশের দুর্গম, দ্বীপ, নদী ও হাওর এবং পাহাড়ি অঞ্চলে স্যাটেলাইট প্রযুক্তিতে নিরবচ্ছিন্ন টেলিযোগাযোগ সেবা চালুও সম্ভব হবে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ স্থাপনের মাধ্যমে। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে স্বাভাবিক টেলিযোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হলেও উদ্ধারকর্মীরা স্যাটেলাইট সেলফোনে যোগাযোগ রেখে দুর্গত এলাকায় কাজ করতে পারবেন। মোদ্দাকথা, ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১’ মহাকাশে স্থাপনের মধ্য দিয়ে উন্নত-সমৃদ্ধ-প্রযুক্তিনির্ভর ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণ ত্বরান্বিত ও টেকসই হবে বৈকি। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট ফিরে দেখা ১৯৭৫ সালের ১৪ জুন বেতবুনিয়ায় দেশের প্রথম ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র উদ্বোধনের মাধ্যমে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের মহাকাশ যাত্রার সূচনা করে গেছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যাকাণ্ডের পর ওই যাত্রা থেমে যায়। নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে দীর্ঘ ৪২ বছর পর বঙ্গবন্ধুকন্যার নেতৃত্বে লালসবুজের পতাকা বহন করে কক্ষপথে স্থাপিত হতে যাচ্ছে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১। যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা স্পেসএক্সের ‘ফ্যালকন-৯’ রকেট স্যাটেলাইটটি মহাকাশে উৎক্ষেপণ করবে। এটি নির্মাণ করেছে ফ্রান্সের থ্যালেস এ্যালেনিয়া স্পেস। সেখান থেকে এটি নিয়ে যাওয়া হয় যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার কেপ কার্নিভালে। স্পেসএক্সে লঞ্চ ফ্যাসিলিটিতে লঞ্চ ভেহিকলের ইন্ট্রিগ্রেশনসহ প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর এটি মহাকাশের উদ্দেশ্যে উৎক্ষেপণ করা হবে। কাছাকাছি সময়ে বিভিন্ন দেশের নানা ক্যাটাগরির আরও ১৩ টি স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করবে স্পেসএক্স। মহাকাশে উৎক্ষেপণের পর আট দিন উড়ে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট কক্ষপথে স্থাপিত হবে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ১৯৯৭ সালে মহাকাশে স্যাটেলাইট স্থাপনের কাজ শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার নিয়েছিলেন। বিষয়টি তৎকালীন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী লে. জে. (অব.) নুরুদ্দীন খানের দৃষ্টিতে নেওয়া হলে তিনি এতে খুব আগ্রহী হয়ে ওঠেন। এই কর্মযজ্ঞে বেতার সম্প্রচার-বিশেষজ্ঞ মনোরঞ্জন দাস বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন (যার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় রেডিও টুডের মাধ্যমে বাংলাদেশে এফএম রেডিও’র যাত্রা শুরু হয়)। যাহোক, স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণে চলতে থাকে ওই মন্ত্রণালয়ের জোর তৎপরতা। ‘স্পারসো’র তৎকালীন চেয়ারম্যানকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয় সে প্রচেষ্টায়। বস্তুত তখন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের একটি উন্নয়ন প্রকল্প হিসেবে ‘বাংলাদেশের ভূ-স্থির উপগ্রহ প্রেরণের প্রকল্প’ গৃহীত হয় আর পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় কর্তৃক বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে এ-প্রকল্প খাতে অর্থবরাদ্দও রাখা হয়। আর পুরো বিষয়টি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সার্বিক তত্ত্বাবধানে-ই এগুচ্ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় এসে ‘বঙ্গবন্ধু’ নাম থাকার কারণে মহাকাশে স্যাটেলাইট স্থাপনের প্রকল্পটি বাতিল করে দেয়। রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা রক্ষিত হবে নাÑ এই যুক্তি তুলে সাবমেরিন অপটিক্যাল ফাইবার কেবল স্থাপনের প্রস্তাব নাকচের মতোই মারাত্মক ওই পশ্চাদমুখী ও ভ্রান্ত ওই সিদ্ধান্তের মূল হোতা ছিলেন তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত-জোট সরকারের মন্ত্রী ড. মঈন খান। কোনো জাতিকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে পিছিয়ে দিতে এ-রকম একজন মন্ত্রীই যথেষ্ট। আর ওই পশ্চাদমুখী সিদ্ধান্তের জন্যই বাংলাদেশ মহাকাশে অরবিটাল স্লট হারিয়েছে। তাই ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১’ মহাকাশে উৎক্ষেপণের জন্য বাংলাদেশকে রাশিয়ার উপগ্রহ কোম্পানি ইন্টারস্পুটনিকের কাছ থেকে ২১৯ কোটি টাকায় ১৫ বছরের জন্য কক্ষপথ বা অরবিটাল স্লট ক্রয় করতে হয়েছে। স্যাটেলাইট প্রযুক্তির অন্দরমহল যোগাযোগ উপগ্রহ হচ্ছে পৃথিবীকে ঘিরে রকেটের মাধ্যমে কক্ষপথের যথাযথ স্থানে স্থাপিত মহাশূন্যযান যা বেতার সংকেত গ্রহণ ও প্রেরণ করে। স্যাটেলাইট বা যোগাযোগ উপগ্রহ এ-সমস্ত সংকেতকে বিবর্ধিত ও বাছাই করে এমনকি এর গতিপথ নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু এর বিস্তৃতি আরও ব্যাপক। একটি ভূ-পৃষ্ঠস্থ রিপিটর যেখানে দুটো স্থির অবস্থানের মধ্যে যোগাযোগ সংকেত সম্প্রচার ‘রিলে’ করে সেখানে একটি যোগাযোগ উপগ্রহ বিস্তৃত এলাকাব্যাপী স্থির ও ভ্রাম্যমাণ উভয় প্রকারের অবস্থানের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করতে সক্ষম। যে স্যাটেলাইট পৃথিবী থেকে যত বেশি দূরে অবস্থিত তার আবর্তনকাল তত বেশি। পৃথিবীপৃষ্ঠের নিকটবর্তী স্যাটেলাইটের আবর্তনকাল প্রায় ৯০ মিনিট। এদিকে পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৩৫,৮০০ কি.মি দূরের স্যাটেলাইটের আবর্তনকাল ২৪ ঘণ্টা। এবং ৩,৮৪,০০০ কি.মি. দূরের স্যাটেলাইটের আবর্তনকাল ৩০ দিন। স্যাটেলাইটের আবর্তনকাল যোগাযোগ ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু মহাকাশের কোথায় কোন স্যাটেলাইট স্থাপনে এটি-ই একমাত্র বিবেচ্য বিষয় নয়। অন্য ফ্যাক্টরটি হলো, ভ্যান এ্যালেন বেল্ট। তাই আকাশে স্যাটেলাইট স্থাপনে ভ্যান এ্যালেন বেল্টের অবস্থান বিবেচনায় নিতে হয়। ভ্যান এ্যালেন বেল্ট কী? উচ্চ শক্তির আহিত বা চার্জড কণিকা পৃথিবীর ভূ-চৌম্বক ক্ষেত্র দ্বারা আবদ্ধ হয়ে পৃথিবীকে ঘিরে প্রবল বিকিরণ-বন্ধনী বা বেল্ট তৈরি করে। একে ভ্যান এ্যালেন বেল্ট বলে। এতে প্রধানত ইলেক্ট্রন ও প্রোটন থাকে। পৃথিবীপৃষ্ঠের কয়েক শত কিলোমিটার থেকে শুরু করে পৃথিবীর ব্যাসার্ধের (৬৩৭১ কি.মি) আটগুণ পর্যন্ত এ বেল্ট বিস্তৃত। ১৯৫৮ সালে কৃত্রিম উপগ্রহ এক্সপ্লোরার-১ ও এক্সপ্লোরার-২ ব্যবহার করে বিজ্ঞানী জেমস ভ্যান এ্যালেন ও তাঁর সহকর্মীরা এ-বিকিরণ ভেল্টের সন্ধান পান। ভূ- চৌম্বকক্ষেত্রের আওতায় একটি আহিত কণিকার চলার পথকে তিনটি উপরিপাতিত ফলাফল হিসেবে দেখানো যায়। প্রথম-গতিটি হলো চৌম্বক বলরেখা বরাবর দ্রুত প্যাঁচানো গতি চৌম্বক ক্ষেত্র ও কণিকার গতি উভয়ের ওপর লম্বভাবে ক্রিয়াশীল চৌম্বক বলের করণে এ গতির উদ্ভব। এই কণিকা যখন চৌম্বক বলরেখা বরাবর ঘুরতে ঘুরতে উত্তর বা দক্ষিণ মেরুতে পৌঁছায় তখন চৌম্বক্ষেত্র প্রাবল্য বৃদ্ধির কারণে তা আবার প্রতিফলিত হয়-এভাবে কণিকাটি উত্তর ও দক্ষিণ গোলার্ধে ঘোরাঘুরি করতে থাকে। এই প্যাঁচানো গতি ও প্রতিফলনে সৃষ্ট দোলন গতির ওপর উপরিপাতিত থাকে আরেকটি ধীরগতির পূর্ব-পশ্চিম সরণ : ইলেকট্রন পূর্বদিকে এবং প্রোটন পশ্চিম দিকে। এভাবে আটকেপড়া আহিত কণিকা জটিল পথে পৃথিবীর চারদিকে ঘুরপাক খায়। সূর্চ থেকে প্রতিনিয়ত প্লাজমা-প্রবাহ পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্রের ওপর এসে পড়ছে। এ প্রক্রিয়ায় আয়নমন্ডলীয় ইলেক্ট্রনও আয়ন ও প্লজমা গঠন করে এবং এরা কখনও কখনও ত্বরণযুক্তও হয়ে থাকে। এই প্লাজমার কিছু ইলেকট্রন ও প্রোটন ভূ-চৌম্বকক্ষেত্রে আটকা পড়ে ভ্যান এ্যালেন বেল্ট তৈরি করে। পৃথিবীর বাইরে মাহশূন্যের প্লাজমা-প্রতি দেশের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো ভ্যান এ্যালেন বেল্ট। স্যাটেলাইটের ইতিহাস ও পদার্থবিজ্ঞানী আর্থার সি. ক্লার্ক বৈশ্বিক টেলিযোগাযোগ সিস্টেমে স্যাটেলাইট ব্যবহারের বিষয়টি প্রথম প্রকাশিত হয় মে, ১৯৪৫ সাল ব্রিটিশ সাময়িকী ওয়্যারলেস ওয়ার্ল্ড-এ কল্পবিজ্ঞান লেখক ও পদার্থবিজ্ঞানী আর্থার সি. ক্লার্কের এক্সট্রা-টেরিস্ট্রিয়াল রিলে প্রবন্ধে। যেখানে মহাকাশে বহির্জাগতিক রিলে সিস্টেম বর্ণিত। ওই সময়ে তিনি ব্রিটিশ ইন্টারপ্লান্টারি সোসাইটির সেক্রেটারি ছিলেন। ক্লার্ক ভেবেছিলেন একুশ শতকের আগ পর্যন্ত প্রযুক্তিগত ও অর্থনৈতিক কারণে তার স্যাটেলাইট তত্ত্ব বাস্তবে প্রয়োগসাধ্য নয়। তাঁর মতে, স্যাটেলাইট মহাকাশ স্টেশনের মতো এর ভেতরে অবস্থানরত টেকনিশিয়ানসহ চালিত হয়, যারা পুড়ে নিঃশেষ হওয়া রেডিও টিউব প্রতিস্থাপনের কাজে নিয়োজিত। আসলে ক্লার্ক ট্রানজিস্টর ও পরবর্তীতে ইন্টিগ্রেটেড সার্কিটের অগ্রগতির বিষয়টি ভাবতে পারেন নি। বস্তুত ক্লার্কের সেই কল্পনা বাস্তবতায় রূপ নিতে ২০ বছরেরও কম সময় লাগে। ১৯৫৭ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন স্পুৎনিক উৎক্ষেপণের মধ্য দিয়ে পৃথিবীবাসী স্পেস স্যাটেলাইট যোগাযোগে সক্ষম হয়। স্পুৎনিক ভূ-স্থির স্যাটেলাইট ছিল না। সেটা ছিল লিও স্যাটেলাইট। যা মার্কিন বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীদের বাণিজ্যিক ব্যবহারে আরও অত্যাধুনিক স্যাটেলাইট প্রস্তুতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। ১৯৬০ সালের প্রথম দিকে প্রস্তুত করা হয় আমেরিকান সিনকম সিরিজ অব স্যাটেলাইট। যা সিনকম ০৩ নামে ১৯৬৪ সালের টোকিও অলিম্পিকের টিভি কাভারেজ সম্প্রচার করে ক্লার্কের ওই বিখ্যাত প্রবন্ধ প্রকাশিত হওয়ার মাত্র ২০ বছর পর। ১৯৬৫ সালে প্রথম আন্তর্জাতিক স্যাটেলাইট উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের মধ্যে সংযোগ স্থাপনে উৎক্ষেপণ করা হয়। যা ‘আর্লি বার্ড বা ইন্টেলসেট ১’ নামে পরিচিত। ১৯৬৫ সালের পর থেকে নাটকীয়ভাবে বদলে যায় স্যাটেলাইট প্রযুক্তি। স্যাটেলাইট এ্যাস্ট্রনমি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের বাইরে পৃথিবীকে ঘিরে ঘুর্ণয়মান কৃত্রিম উপগ্রহ অথবা দূর মহাবিশ্বের নভোযানে স্থাপিত যন্ত্র দ্বারা মাহজাগতিক বস্তুমালা পর্যবেক্ষণ ও এতদসংক্রান্ত গবেষণা জ্যোতির্বিজ্ঞানের যে শাখায় করা হয় তাকে উপগ্রহ জ্যোতির্বিজ্ঞান। এটি জ্যোতির্বিজ্ঞানের একটি বিশেষায়িত শাখা। এ-কাজে ব্যবহৃত এ্যাস্ট্রনমিক্যাল স্যাটেলাইলস-এ বিশেষ যন্ত্রপাতি বসানো হয়, যা দৃশ্যমান আলোর চেয়ে কম তরঙ্গদৈর্ঘ্যরে বিদ্যুত চুম্বকীয় বিকিরণ রেকর্ড করে। সাধারণত একটি উপগ্রহ থেকে একটি বা দুটি তরঙ্গদৈর্ঘ্য-অঞ্চল পর্যবেক্ষণ করা হয়। জ্যোতির্বিজ্ঞানের এ নতুন শাখায় বিদ্যুৎ-চৌম্বক বর্ণালীর প্রায় পুরো অংশই অন্তর্ভুক্ত। যথা : গামা-রে, এক্স-রে, আলট্রাভায়োলেট-রে, দৃশ্যমান আলো, অবলোহিত আলো ও রেডিও তরঙ্গ। অন্যদিকে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল এ-বর্ণালী পরিসরের প্রায় পুরো বিকিরণকেই বাধা দেয়। মাত্র দুটো জানালা খোলা আছে, যা দিয়ে পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে টেলিস্কোপর সাহায্যে মহাবিশ্বকে দেখা যায়। এর একটি হলো দৃশ্যমান আলোর জানালা এবং অন্যটি রেডিও জানালা। যোগাযোগ স্যাটেলাইটের প্রকারভেদ জিও বা জিও-স্টেশনারী স্যাটেলাইট : ভূস্থির উপগ্রহের বিষয়টা বেশ চমৎকার। এর গতিপথ এমন যে, প্রত্যেকটি উপগ্রহ ভূ-পৃষ্ঠের পরিপ্রেক্ষিতে স্থির; একেকটি ভূ-স্থির উপগ্রহের আপাত অবস্থান একেক নির্দিষ্ট স্থানের ঠিক উপরে, ভূ-পৃষ্ঠ থেকে ৩৫,৭৯৪ কিলোমিটার উচ্চতায়। আপাতদৃষ্টিতে ব্যাপারটা খুবই অদ্ভুত বটে। শূন্যে এমন উঁচুতে কোন বস্তুরই তো স্থির দাঁড়িয়ে থাকার কথা নয়। বরং মধ্যাকর্ষণের প্রভাবে সেটির ধরাপৃষ্ঠে পতিত হওয়াই স্বাভাবিক। এ আশ্চর্য আপাত স্থির অবস্থানের কারণ হলো ভূ-স্থির উপগ্রহের কক্ষপথটি হচ্ছে ক্লার্কের কক্ষপথ। স্যার আর্থার সি. ক্লার্কের নামানুসারে এ নামকরণ। উপগ্রহের গতি-পরিভ্রমণ ব্যাখ্যার জন্য নিউটন-আবিষ্কৃত বিখ্যাত মহাকর্ষ সূত্র তথা চিরায়ত বলবিদ্যার-ই একটি চমৎকার প্রয়োগ এটি। যে কোন সুস্থিত গতিপথে আবর্তক গতির জন্য শর্ত হলো কেন্দ্রমুখী বল ও কেন্দ্রাতিগ বল-এর সাম্য। পৃথিবীকে বৃত্তপথে প্রদক্ষিণরত যে কোন উপগ্রহের ক্ষেত্রে কেন্দ্রমুখীবল নির্ভর করবে ভূ-কেন্দ্র থেকে ওই উপগ্রহের দূরত্ব ও ভরের ওপর আর কেন্দ্রাতিগবল নির্ভর করবে উপগ্রহটির কৌণিক বেগ (মানে কত দ্রুত সেটি পাক খাচ্ছে) ও ভরের ওপর। অতএব পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে (তাই পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকেও, যেহেতু পৃথিবী গোলাকার) ভিন্ন ভিন্ন দূরত্ব বজায় রেখে প্রদক্ষিণরত উপগ্রহসমূহের কৌণিক বেগ ভিন্ন-ভিন্ন হবে এবং সেজন্য আবর্তনকালও ভিন্ন-ভিন্ন হবে। যেহেতু পৃথিবীর নিকটতর বস্তুর ওপর পৃথিবীর আকর্ষণ দূরবর্তী বস্তুর ওপর প্রযুক্ত আকর্ষণ থেকে বিশি, তাই স্থির দূরত্বে থেকে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণরত পৃথিবীর নিকটতর উপগ্রহের কৌণিক বেগ দূরবর্তী উপগ্রহের কৌণিক বেগ থেকে বেশি হতে হবে। অর্থাৎ, কম দূরত্বে থেকে প্রদক্ষিণরত নিকটতর উপগ্রহের আবর্তনকাল, বেশি দূরত্বে থেকে প্রদক্ষিণরত উপগ্রহের আবর্তনকাল থেকে কম হবে। এখন নিউটনীয় বলবিদ্যার সহজ প্রয়োগে এমন দূরত্ব হিসেব করে বের করা যায় যে, একটি বিশেষ দূরত্বে থেকে কোনো উপগ্রহ পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করলে এর আবর্তনকাল হবে পৃথিবী তার নিজের অক্ষে ঘূর্ণনকালের সমান; অর্থাৎ ২৪ ঘণ্টা। হিসাব অনুযায়ী সে দূরত্ব ভূ-কেন্দ্র থেকে ৪২,১৬৫ কি.মি (অর্থাৎ ভূ-পৃষ্ঠ থেকে ৩৫,৭৯৪ কি.মি. কারণ ভূকেন্দ্র থেকে ভূপৃষ্ঠের দূরত্ব হলো ৬,৩৭১ কি.মি) এমন কক্ষপথে উপগ্রহটির দ্রুতি হতে হবে প্রতি সেকেণ্ডে ৩.০৭৫ কি.মি.। এখন এমন দূরত্বের কক্ষপথটি যদি ঠিক বিষুবরেখার বরবর ঊর্ধ্বে হয় অর্থাৎ তা যদি বিষুববৃত্তের সমান্তরাল একটি বৃহত্তর বৃত্তপথ হয় এবং যদি সে কক্ষপথে পরিভ্রমণরত উপগ্রহটির গতি পশ্চিম থেকে পূর্বদিকে হয়, তবে উপগ্রহটি বিষুবরেখার যে স্থানের উপরে থেকে এমন গতিতে অবর্তনের জন্য স্থাপিত হবে,সব সময় ঠিক সে স্থানের ৩৫,৭৯৪ কি. মি. উপরেই সেটি অবস্থান করবে। পৃথিবীপৃষ্ঠের যে কোনো স্থানের পরিপ্রেক্ষিতে সেটি স্থির বলে প্রতিভাত হবে; যদিও তার ‘বিরাম নেই আকাশের মাঝে’। যেহেতু পৃথিবী তার নিজ অক্ষে পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে যতক্ষণে একপাক ঘুরবে (প্রায় ২৪ ঘণ্টা), ততক্ষণে সে উপগ্রহটিও পৃথিবীকে একবার প্রদক্ষিণ করবে। পৃথিবীপৃষ্ঠের যে কোনো স্থান যতক্ষণে পৃথিবীর অক্ষের পরিপ্রেক্ষিতে যতটুকু দূরত্ব অতিক্রম করবে, উপগ্রহটিও ততক্ষণে ততটুকুই কৌণিক দূরত্ব অতিক্রম করবে। তাই উপগ্রটি আবর্তনশীল হলেও পৃথিবীর যে কোনো স্থানের পরিপ্রেক্ষিতে সেটির কোনো আপেক্ষিক গতি থাকবে না। এ-ধরনের কক্ষপথের কথা স্যার আর্থার সি. ক্লার্ক বলেছিলেন। তিনি বর্ণনা করলেন যে, সে কক্ষপথে ১২০ ডিগ্রী ব্যবধানে প্রদক্ষিণরত মাত্র তিনটি উপগ্রহের সাহায্যে সারা পৃথিবীর সব জায়গা একটি বেতার-যোগাযোগ ব্যবস্থার আওতায় আনা সম্ভব। সেখানে পাহাড়-পর্বতের বাধা তো নয়ই, এমনকি পৃথিবীর গোলত্বের বাধাও কোনো সমস্যা নয়। তাই আর্থার সি. ক্লার্কের নামানুষারে ভূ-স্থির উপগ্রহের কক্ষপথটির নাম ক্লার্কস অরবিট। ক্লার্কের কক্ষপথে পরিভ্রমণরত যে কোনো উপগ্রহ যেহেতু পৃথিবীর পরিপ্রেক্ষিতে স্থির, তাই যোগাযোগের ক্ষেত্রে এর ব্যবহারের সুবিধেটা বহুবিধ। প্রথম দিকে, ষাটের দশকের গোড়ায়, এমন উপগ্রহকে কেবল নিষ্ক্রিয় প্রতিফলক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল। অর্থাৎ পৃথিবীর কোনো এক স্থান থেকে কোনো ভূ-স্থির উপগ্রহের দিকে বেতার সংকেত পাঠিয়ে সে উপগ্রহ থেকে প্রতিফলিত সংকেত অন্য স্থান থেকে গ্রাহকযন্ত্রে ধরা হয়েছিল। কিন্তু অচিরেই ব্যবস্থাটির বৈপ্লবিক উন্নয়ন সাধিত হয়, উপগ্রহকে করা হয় সক্রিয় রিপিটার। এ-ব্যবস্থায় ভূমিস্থ উপগ্রহ ভূ-কেন্দ্র থেকে বা কোনো মোবাইল প্রেরক-গ্রাহক ইউনিট থেকে সব ধরনের বেতার-সংকেত-টেলিফোনকল, রেডিও-টিভি অনুষ্ঠান, ইন্টারনেট-বার্তা প্রভৃতি উপগ্রহে পাঠানো হয়; এবং সেখান থেকে আবার সংকেতের শক্তি বৃদ্ধি করে ভূ-পৃষ্ঠের অন্য এক অঞ্চলে পাঠানো হয়। এর ফলে উপগ্রহ রূপান্তরিত হয় শক্তিশালী রিলে কেন্দ্ররূপে, যা বেতার যোগাযোগের এক যুগান্তকারী ব্যবস্থা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ক্লার্কে কক্ষপথেরও এই একটি সীমাবদ্ধতা আছে। আর তা হলো, এক এবং অদ্বিতীয়; বিষুববৃত্তের ঠিক উপরে একটি নির্দিষ্ট উচ্চতায় বিষুববৃত্তের সমান্তরাল সে কক্ষপথটি সম্পূর্ণভাবে সুনির্দিষ্ট; সুতরাং সে কক্ষপথে উপগ্রহ স্থাপনের মতো জায়গাও সীমিত। এদিকে পৃথিবীপৃষ্ঠে যে স্থানের দ্রাঘিমাংশ যত, বিষুববৃত্তের তত দ্রাঘিমাংশের ঠিক বরাবর উপরে ক্লার্কের কক্ষপথের যে বিন্দুটি পাওয়া যাবে, তাই হবে সেই স্থানে ব্যবহার্য কোনো ভূ-স্থির উপগ্রহের সর্বোত্তম অবস্থান। যেমন বাংলাদেশের একটি উপগ্রহ স্থাপন করতে হলে এর আদর্শ স্থান হবে ক্লার্ক কক্ষপথে ৯০ ডিগ্রী দ্রাঘিমাংশ বিন্দু। সে বিন্দুটি ও কক্ষপথে সে বিন্দুর পূর্ব ও পশ্চিমের নিকটবর্তী অংশগুলো আবার ভারত, চীন, রাশিয়া, ভুটান ও মঙ্গোলিয়ারও অংশবিশেষের জন্য আদর্শ ও উপযোগী। কারণ ৯০ ডিগ্রী দ্রাঘিমা রেখাটি সেসব দেশের ওপর দিয়েও গেছে। বস্তুত ক্লার্ক কক্ষপথটির অনেকটা অংশ জুড়েই এমন অবস্থা, স্থান প্রাপ্তির এমন সম্ভাব্য প্রতিযোগিতার পরিবেশ। অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হলো, বাংলাদেশ এখনও ক্লার্ক কক্ষপথে কোনো উপগ্রহ পাঠায়নি। ফলে এর মধ্যেই তার আদর্শ বিন্দু (কক্ষপতটির ৯০ ডিগ্রী দ্রাঘিমাংশ) তো বটেই এর পূর্ব ও পশ্চিমের অনেকটা স্থানেই আগ্রহী অন্য দেশগুলোর উপগ্রহ দিয়ে দখল হয়ে গেছে। এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে যত বিলম্ব হবে ততই কক্ষপথে আমাদের সুবিধাজনক অবস্থান অধরা হয়ে যাবে। মিও বা মিডিয়াম আর্থ অরবিট স্যাটেলাইট : এ স্যাটেলাইট ভূ-স্থির স্যাটেলাইট থেকে পৃথিবীর নিকটবর্তী স্থাপিত হয়ে থাকে। এখন টেলিযোগাযোগে মিও স্যাটেলাইট ব্যবহার হয় না। উল্লেখ্য, পৃথিবীর ১৮,০০০ কি.মি. ভ্রমণরত ২৪টি জিপিএস বা গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম মিও স্যাটেলাইটের দৃষ্টান্ত। লিও বা লো আর্থ অরবিট স্যাটেলাইট : লো আর্থ অরবিট স্যাটেলাইট পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে মাত্র কয়েক শত কি.মি. দূরে স্থাপন করা হয়। সাধারণত এদের ঘূর্ণনকাল প্রায় ৯০ মি. এদের স্থায়িত্বকাল দিন, সপ্তাহ বা কয়েক মাস হয়ে থাকে। দ্রুত গতির কারণে লিও স্যাটেলাইটের পুরো সিস্টেমে অনেক স্যাটেলাইট স্থাপনের প্রয়োজন পড়ে। তাছাড়া পৃথিবীর খুব নিকটে হওয়াতে এর গ্রাউন্ড স্টেশনের খুব শক্তির প্রয়োজন পড়ে না। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট ও মহাকাশ যুগে বাংলাদেশ : মহাবিশ্ব-মহাকাশ অভিযানে কেবল ধনী ও প্রযুক্তিগতভাবে অগ্রসর দেশ নয়, বরং প্রযুক্তি ও অর্থনৈতিকভাবে অপেক্ষাকৃত পিছিয়ে পড়া দেশও অংশ নিচ্ছে এই মহাযজ্ঞে। কারণ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির তো সীমান্ত নেই। আন্তঃরাষ্ট্রীয় যোগাযোগ ও সহযোগিতায় পৃথিবীর নানা দেশ যৌথভাবে এখন মহাকাশ অভিযানে অংশ নিচ্ছে। মঙ্গলগ্রহে প্রেরণ করছে একের পর এক মনুষ্যহীন মহাকাশযান। এর মধ্য দিয়ে বিজ্ঞানীরা জানার চেষ্টা করছে এই গ্রহের অতীতকে। দূর অতীতে এখানে প্রাণ ছিল কি না? মঙ্গলগ্রহের খালগুলো শুকিয়ে গেল কেন? একইসঙ্গে নিকট ভবিষ্যতে মঙ্গলপৃষ্ঠে পদচিহ্ন রাখতে যাচ্ছে মানুষ। লাল ওই গ্রহ হতে পারে মানবজাতির দ্বিতীয় আবাসভূমি। শনিগ্রহের উপগ্রহ টাইটানে জীবনের সন্ধান করছেন বিজ্ঞানীরা। বসবাসেরও স্বপ্ন দেখছেন এবং দেখাচ্ছেনও। মিশন প্রেরণ করা হয়েছে বামনগ্রহ প্লুটোতে-এমনকি সৌরজগতের বাইরে-মহাবিশ্বের হ্যাবিটেবল জোনে। বাংলাদেশও মহাজাগতিক এই কর্মযজ্ঞে যুক্ত হতে যাচ্ছে মহাকাশে কৃত্রিম উপগ্রহ ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১’ উৎক্ষেপণের মাধ্যমে। আর এটি হচ্ছে সৌরজগত ও এর বাইরে-আমাদের ছায়াপথ মিল্কিওয়ে’র অসংখ্য সোলার সিস্টেমের বসবাস উপযোগী কোনো গ্রহে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশের লালসবুজ পতাকা উড়ানোর প্রথম পদক্ষেপ-একটি মাইলফলক-স্বপ্নময় মহাকাশ যুগে প্রবেশের সূচনা...
×