ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

জঙ্গী দমনের মতো মাদক নির্মূলেও ভূমিকা রাখতে হবে

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ৪ মে ২০১৮

 জঙ্গী দমনের মতো মাদক নির্মূলেও  ভূমিকা রাখতে হবে

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে তাঁর সরকারের জিরো টলারেন্স নীতির কথা পুনর্ব্যক্ত করে বলেছেন, বাংলাদেশ হবে একটি শান্তির দেশ এবং আমরা কখনই জঙ্গীবাদকে প্রশ্রয় দেব না। কারণ সন্ত্রাস, জঙ্গীবাদের কোন জাতি নেই, ধর্ম নেই, কিচ্ছু নেই। এই ভুল পথে যাতে ছেলেমেয়েরা না যায় সেজন্য অভিভাবক, শিক্ষকসহ সকলকে নিয়ে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। মাদকের ভয়াল ছোবল থেকে ছেলেমেয়েদের রক্ষায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্থিতিশীল রেখে উন্নয়নের ধারা বজায় রাখার পাশাপাশি দেশব্যাপী মাদকবিরোধী অভিযান চালিয়ে যেতে র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) সদস্যদের নির্দেশ দেন তিনি। তিনি বলেন, জঙ্গী দমনের মতো মাদক নির্মূলেও র‌্যাবকে ভূমিকা রাখতে হবে। বৃহস্পতিবার কুর্মিটোলা সদর দফতরে র‌্যাবের ১৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি র‌্যাবকে অনুরোধ করব, জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে যেমন আমরা অভিযান চালিয়ে সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হয়েছি তেমনি এখন মাদকের বিরুদ্ধেও এই অভিযান অব্যাহত রাখতে হবে। মাদক যারা তৈরি করে, যারা বিক্রি করে, যারা পরিবহন করে এবং যারা সেবন করে সকলেই সমানভাবে দোষী। এটা মাথায় রাখতে হবে এবং সেভাবেই যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং অতিরিক্ত মহাপুলিশ পরিদর্শক ও র‌্যাবের মহাপরিচালক বেনজির আহমেদ অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন। সন্ত্রাস, জঙ্গী দমন, মাদক নিয়ন্ত্রণ, অপহরণ এবং জাল- জালিয়াতিসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় র‌্যাবের বিভিন্ন ভূমিকা সম্পর্কে এবং সুন্দরবনে র‌্যাবের অভিযানে বিশটি জলদস্যুবাহিনীর ২১৭ সদস্যের আত্মসমর্পণ এবং তাদের সাধারণ জীবনে পুনর্বাসন সম্পর্কিত অনুষ্ঠানে পৃথক দুটি ভিডিও চিত্র পরিবেশিত হয়। মন্ত্রিপরিষদ সদস্যবৃন্দ, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাবৃন্দ, সংসদ সদস্যবৃন্দ, তিনবাহিনী প্রধানগণ, মহাপুলিশ পরিদর্শক, মহাপরিচালক বিজিবি, সরকারের উর্ধতন সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাবৃন্দ, র‌্যাব ও পুলিশের উর্ধতন কর্মকর্তাবৃন্দসহ র‌্যাবের সকল স্তরের কর্মকর্তা ও সদস্যবৃন্দ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। এর আগে প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছলে র‌্যাবের একটি সুসজ্জিত বাহিনী প্রধানমন্ত্রীকে গার্ড অব অনার প্রদান করে। অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী উত্তরা আশকোনায় ৮ দশমিক ৫৬ একর জমির ওপর অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধা সংবলিত র‌্যাব সদর দফতর কমপ্লেক্স নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। তিনি শহীদ র‌্যাব সদস্যদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে র‌্যাব সদর দফতরে শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ ‘প্রেরণা ধারা’র উদ্বোধন করেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, মাদক বিরোধী অভিযানে ইতোমধ্যেই যথেষ্ট সাফল্য অর্জন করা হয়েছে। আমাদের ছেলেমেয়েরা যাতে এর ছোবল থেকে দূরে থাকতে পারে তার ব্যবস্থা ব্যাপকভাবে নিতে হবে। এ ব্যাপারে বিশেষভাবে ভূমিকা পালনের জন্য তিনি সকলের প্রতি আহ্বান জানিয়ে মাদকের বিরুদ্ধে বড় বড় অভিযানে র‌্যাবের সাফল্যের জন্য র‌্যাবের সদস্যদের ধন্যবাদ জানান এবং এই অভিযান অব্যাহত রাখারও নির্দেশ দেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ দমন, অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র ও মাদক উদ্ধার, চরমপন্থী দমন এবং ভেজাল বিরোধী অভিযান পরিচালনাসহ সকল ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে দেশের অভ্যন্তরে শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখতে র‌্যাব অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। র‌্যাব দেশের অভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে সকলের আস্থা ও শ্রদ্ধা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। তিনি বলেন, পবিত্র ইসলাম ধর্মের মূলধারা কোরান ও হাদিসের সঠিক ব্যাখ্যা থেকে বিচ্যুতির কারণে উগ্র জঙ্গীবাদের উদ্ভব হয়েছে। এই জঙ্গীবাদীরা সাম্প্রদায়িকতা, সহিংসতা, অরাজকতা ও নাশকতামূলক কর্মকা-ের মাধ্যমে দেশকে অস্থিতিশীল ও নিরাপত্তাহীন করে তোলার অপচেষ্টা চালিয়ে আসছে। কিন্তু র‌্যাব জঙ্গী দমনে অভাবনীয় সাফল্য অর্জনে সক্ষম হয়েছে, যা সর্বমহলে সমাদৃত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ইসলাম শান্তির ধর্ম। কিন্তু আমরা দেখেছি এই ধর্মের নাম করে কিছু মানুষকে বিভ্রান্তির পথে ঠেলে দেয়া হয়েছিল। এমনকি আমাদের ভাল ঘরের উচ্চশিক্ষিত কোমলমতি ছেলেরাও এই বিভ্রান্তির বেড়াজালে পড়ে যায়। তিনি বলেন, মানুষ মারলে বেহশতে যাওয়া যাবে এই বিভ্রান্তিতে পড়ে তারা দেশে যে অস্থিতিশীলতা এবং অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল তার বিরুদ্ধে আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, সশস্ত্রবাহিনী, বর্ডার গার্ড, গোয়েন্দা সংস্থা এবং র‌্যাব বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে। এ অভিযান ভবিষ্যতেও অব্যাহত রাখতে হবে যেন বাংলাদেশকে কেউ সন্ত্রাসী এবং জঙ্গীর দেশ বলে অপবাদ দিতে না পারে, বাংলাদেশের মানুষ যেন শান্তিতে জীবন-যাপন করতে পারে এবং যাতে আমরা আমাদের দেশকে কাক্সিক্ষত উন্নয়নের পথে নিয়ে যেতে পারি। জঙ্গীবাদকে একটি বৈশ্বিক সমস্যা অভিহিত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এটি একটি বৈশ্বিক সমস্যাা হলেও জঙ্গীদমনে বাংলাদেশ বিশ্বে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে সমর্থ হয়েছে। তিনি হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গী হামলা পরবর্তী ১০ ঘণ্টার মধ্যেই জিম্মি নাটকের অবসান এবং পরবর্তীতে এই হামলায় জড়িতদের এবং অন্যান্য সন্ত্রাসি হামলার পূর্ব প্রস্তুতিকালে জঙ্গীদের গ্রেফতারের জন্য র‌্যাব ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকার প্রশংসা করেন। একই সঙ্গে তিনি জঙ্গী দমনে সমাজের সকল শ্রেণী- পেশার মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে তাঁর প্রচেষ্টার কথাও উল্লেখ করেন। তিনি প্রত্যেকের পুত্র বা পোষ্য কোথায় যায়, কার সঙ্গে মেশে, কি করে, তা লক্ষ্য রাখার পাশাপাশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কেউ দীর্ঘদিন অনুপস্থিত থাকছে কিনা তার প্রতি লক্ষ্য রাখতে সংশ্লিষ্ট অভিভাবক এবং শিক্ষকদের প্রতি পুনরায় আহবান জানান। সুন্দরবনে জলদস্যু দমনে র‌্যাবের ভূমিকার প্রশংসা করে সরকারপ্রধান বলেন, এখন পর্যন্ত ২১৭ জলদস্যু আত্মসমর্পণ করেছে, যারা বর্তমানে পুনর্বাসিত হয়ে স্বাভাবিক জীবন যাপন করছে। প্রধানমন্ত্রী সুন্দরবন অঞ্চলে এখনও যারা দস্যুতার সঙ্গে জড়িত তাদের সুস্থ জীবনে ফিরে আসার জন্য সরকার ঘোষিত আত্মসমর্পণের সুযোগ গ্রহণের আহবান জানান। তিনি বলেন, এই কথাটা সকলের কাছে আমি পৌঁছে দিতে চাই- সুস্থভাবে সবাই জীবন-যাপন করুন এবং সুন্দরভাবে বাঁচুন। নিজের সংসার, নিজের পরিবার,নিজের সন্তান; তারাও যেন সমাজে সম্মান নিয়ে বাঁচতে পারে এজন্য আরও যারা এই জলদসুতার সঙ্গে বা দস্যুতার সঙ্গে সম্পৃক্ত তাদের অবশ্যই আমরা জীবন-জীবিকার পথ এবং সুস্থভাবে বাঁচার সুযোগ করে দেব। তিনি বলেন, দেশীয় অসাধু ব্যবসায়ীর পাশাপাশি বিদেশী চোরাকারবারি, জাল মুদ্রা ও পাসপোর্ট প্রস্তুতকারী এবং অবৈধ ভিওআইপি বিরোধী অভিযান পরিচালনা করে রাষ্ট্রীয় রাজস্ব বৃদ্ধিতে এবং বিভিন্ন পালা-পার্বণ-উৎসব এবং ভিআইপি, ভিভিআইপি নিরাপত্তার দায়িত্বেও র‌্যাব অবদান রাখছে। এছাড়া র‌্যাব জননিরাপত্তায় হুমকি ও আতঙ্ক সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, র‌্যাব নকল ও ভেজাল বিরোধী অভিযান জোরদার করেছে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার মাধ্যমে। এই অভিযানও অব্যাহত রাখতে হবে। সাম্প্রতিক পাবলিক পরীক্ষা ও অন্যান্য পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নানামুখী পদক্ষেপের পাশাপাশি র‌্যাবের ভূমিকাও প্রশংসার দাবি রাখে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, র‌্যাবের উপস্থিতিই সেখানে এ ধরনের দুষ্কৃতিকারীদের কাছে একটি অশনি বার্তা হিসেবে কাজ করে। র‌্যাবকে একটি অত্যাধুনিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে প্রধানমন্ত্রী তাঁর সরকারের গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপের উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, র‌্যাবের দক্ষতা ও জনবল বৃদ্ধির অংশ হিসেবে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে ২টি ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের একটিসহ মোট তিনটি নতুন ব্যাটালিয়ন গঠন প্রক্রিয়াধীন। প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে পদ্মা সেতু নির্মাণে বিশ্বব্যাংককে চ্যালেঞ্জ করে নিজস্ব অর্থায়নে এর নির্মাণের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে এই অর্জনকে অব্যাহত রাখার আহ্বান জানিয়ে বলেন, এই অর্জনকে ধরে রাখতে হলে আমাদের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে আরও উন্নত করতে হবে। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই ধারা অব্যাহত রেখে ২০২১ সালের মধ্যে আমরা যখন স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী পালন করব তখন বাংলাদেশ হবে ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত মধ্যম আয়ের দেশ। তিনি বলেন, আমরা এখানেই থেমে যেতে চাই না, আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ যেন উন্নত-সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হয়; অর্থাৎ দক্ষিণ এশিয়ায় সব থেকে উন্নত দেশ হবে বাংলাদেশ। পাশাপাশি জাতিসংঘ নির্ধারিত এসডিজির (সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল) স্থায়ী উন্নয়ন প্রক্রিয়ার সঙ্গে বিভিন্ন পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা এবং ১০ বছর মেয়াদী প্রেক্ষিত পরিকল্পনা রূপায়নের মাধ্যমে আমরা বাংলাদেশকে নির্দিষ্ট সময়ে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছানোর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা ইতোমধ্যে আমাদের প্রক্রিয়া শুরু করেছি। ২০৪১ সালে বাংলাদেশকে কেমন বাংলাদেশ হিসেবে দেখতে চাই, সেই পরিকল্পনাও আমরা এখন থেকেই তৈরি করছি। ‘বাংলাদেশ আমার অহংকার’ র‌্যাবের এই মূলমন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে কাজ করতে র‌্যাবসহ সকল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশ আমার প্রিয় দেশ। লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে এদেশ আমরা অর্জন করেছি, এদেশ আমার অহঙ্কার। তিনি বলেন, আমরা জাতির পিতার স্বপ্নের ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্য মুক্ত সোনার বাংলাদেশ গড়তে চাই। আর সেই বাংলাদেশ গড়তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে আমাদের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যগণ যারা জনগণের শান্তি-নিরাপত্তা বিধান করেন এবং জনগণের পাশে দাঁড়ান। তিনি বলেন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের জনগণের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে কাজ করতে হবে এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে হবে এবং ন্যায় ও সত্যকে সব সময় গুরুত্ব দিতে হবে।
×