ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

শুধুমাত্র ‘খ’ সেট বা নৈর্ব্যক্তিক ৩০ নম্বরের অংশ ফাঁসের প্রমাণ মিলেছে। সুবিধা নিয়েছে ৫ হাজারের মতো শিক্ষার্থী মাত্র ৫ হাজারের জন্য ২০ লাখ শিক্ষার্থীকে ভোগান্তিতে ফেলা ঠিক হবে না

পরীক্ষা বাতিল নয় ॥ এসএসসির প্রশ্ন ফাঁসের তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ শিক্ষামন্ত্রীর

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ৪ মে ২০১৮

পরীক্ষা বাতিল নয় ॥  এসএসসির প্রশ্ন ফাঁসের তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ শিক্ষামন্ত্রীর

স্টাফ রিপোর্টার ॥ এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় আংশিক প্রশ্নফাঁস হলেও কোন পরীক্ষা বাতিল হবে না বলে জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। তিনি বলেন, মুষ্টিমেয় কয়েকজন শিক্ষার্থীর কারণে পরীক্ষা বাতিল করা হবে না। তবে ভবিষ্যতে সবাইকে আরও সতর্ক থাকার আহ্বান জানান মন্ত্রী। বৃহস্পতিবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসে গঠিত যাচাই-বাছাই কমিটির তদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে আয়োজিত ও জেএসসি-জেডিসি পরীক্ষার নিরাপত্তা সংক্রান্ত সভায় শিক্ষামন্ত্রী এ কথা বলেন। সেই সঙ্গে আগামী বছর (২০১৯) এইচএসসি পরীক্ষায় নৈর্ব্যক্তিক (এমসিকিউ) প্রশ্ন থাকছে না, এমনটাই ইঙ্গিত দিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘তবে সংক্ষিপ্ত প্রশ্নের উত্তর লেখার ব্যবস্থা থাকবে।’ প্রশ্নফাঁস যাচাই-বাছাই কমিটির তদন্ত প্রতিবেদনে দেখা গেছে, সম্প্রতি শেষ হওয়া এসএসসি পরীক্ষায় ০ দশমিক ২৫ শতাংশ প্রশ্নফাঁস হয়েছে। শুধুমাত্র ‘খ’ সেট বা নৈর্ব্যক্তিক ৩০ নম্বরের অংশ ফাঁসের প্রমাণ পাওয়া গেছে। এতে সুবিধা নিয়েছে পাঁচ হাজারের মতো শিক্ষার্থী। তবে মাদ্রাসা বোর্ডের কোন প্রশ্ন ফাঁসের প্রমাণ পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে, প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগে গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ এবং সুবিধা নেয়া পরীক্ষার্থীদের চিহ্নিত করে ফলাফল বাতিলসহ ব্যবস্থা, প্রশ্নফাঁসকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি, বিকাশ-রকেটসহ বিভিন্ন ব্যাংকিং মাধ্যমে লেনদেনকারীদের তথ্য সগ্রহ করে সন্দেহজনক মোবাইল নম্বরগুলো চিহ্নিত করার সুপারিশ করা হয়েছে। প্রতিবেদন মূল্যায়ন করে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, মাত্র পাঁচ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য ২০ লাখ শিক্ষার্থীকে ভোগান্তিতে ফেলা ঠিক হবে না। এ কারণে কোন পরীক্ষা বাতিল করা হবে না। তবে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। যাতে ভবিষ্যতে কোনভাবেই প্রশ্নফাঁস না হয়। তিনি বলেন, চলমান এইচএসসি পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁস বন্ধ করা চ্যালেঞ্জ ছিল। সবার সহযোগিতার কারণে এখন পর্যন্ত এইচএসসিতে কোন প্রশ্নফাঁস হয়নি। শিক্ষামন্ত্রী আরও বলেন, অনেকে বিচার বিশ্লেষণ না করেই ঢালাওভাবে প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে অপরাধী বানিয়েছেন। এটি আমাদের জন্য অবিচার কারা হয়েছে। এর আগে এইচএসসি পরীক্ষার সময় শিক্ষামন্ত্রী গণমাধ্যমে জানিয়েছিলেন, ‘বিদ্যমান পরিস্থিতিতে প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকানো শতভাগ নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। পদ্ধতির পরিবর্তন আনা হবে। তবে এত কম সময়ে তা সম্ভব নয়।’ সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘এমসিকিউ আমাদের সামনে চলে এসেছে এবং ছেলেমেয়েদের জন্য এটি কী পরিমাণ বিপজ্জনক হয়েছে। এটাও গার্ডিয়ানরা বুঝতে পারছেন। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী প্রেস কনফারেন্সে বলেছেন। আপনারা লেখেন জনমত নিয়ে আসেন। আমরা এমসিকিউ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিয়ে শিগগিরই জানাব। এটাকে কিছু পরিবর্তনও করতে পারি। পরে সিদ্ধান্ত নেব।’ পাঁচ হাজার পরীক্ষার্থীর পরীক্ষা বাতিল হবে কী না জানতে চাইলে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘এই ছাত্রদের অনেকে আটক আছে। বাকিরা আইনের আওতায় রয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।’ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মোঃ সোহরাব হোসাইন বলেন, ‘শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন বিষয়টি স্পর্শকাতর। বিষয়টির একটি পরিবর্তন আসতে পারে। তবে আমরা এখনই সুযোগটা দিচ্ছি না। এমসিকিউ এখন যে রকম আছে এ, বি, সি, ডি, সে রকম না করে সেটার একটা পরিবর্তন আসতে পারে। আক্ষরিক হতে পারে। এটা টোটালি বন্ধ করে সিকিউতে যেতে হবে। কিন্তু এমসিকিউ প্রশ্ন একজন ছাত্রের পক্ষে কতটা লেখা সম্ভব, সেটা বিবেচনায় নিতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘তার (পরীক্ষার্থীর) জন্য সহনশীল হয়, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে লেখা সম্ভব হয়, সেটা বিবেচনায় নিতে হবে। সেটা মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত দেয়ার বিষয় নয়। আমাদের মাথায় আছে। সঠিক জায়গায় আগে পরীক্ষামূলকভাবে করব। তারপর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেব।’ এর আগে মোঃ সোহরাব হোসাইন গণমাধ্যমে জানিয়েছিলেন ভবিষ্যতে এই পদ্ধতিতে (এমসিকিউ) পরিবর্তন আনা হবে। শুধু টিক চিহ্ন নয়। দু-এক লাইন হলেও লিখতে হবে।’ সভায় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন- শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী কাজী কেরামত আলী, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব সোহরাব হোসাইন, কারিগরি ও মাদ্রাসা বিভাগের সচিব মোঃ আলমগীর, পুলিশ, র‌্যাব, গোয়েন্দা সংস্থা ও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। চলতি এসএসসি ও সমমানের বেশিরভাগ পরীক্ষার প্রশ্নই পরীক্ষা শুরুর কয়েক ঘণ্টা আগে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ফাঁস হয়েছে। বেশ কয়েক বছর ধরে ফেসবুকে বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস হলেও সরকারের পক্ষ থেকে তা অস্বীকার করা হচ্ছিল। সম্প্রতি ভয়াবহ আকারে প্রশ্ন ফাঁসের পর সরকার বলছে, পরীক্ষার কিছুক্ষণ আগে উদ্দেশ্যমূলকভাবে শিক্ষকরা প্রশ্নফাঁস করে দিচ্ছেন। ইতোমধ্যেই প্রশ্নফাঁসকারীকে ধরিয়ে দিলে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ পাঁচ লাখ টাকা পুরস্কার দেয়ার ঘোষণা দিলেও ওই পুরস্কার দেয়ার মতো এখনও কাউকে পাওয়া যায়নি বলে জানা গেছে। এসএসসি পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগের মধ্যে গত ৪ ফেব্রুয়ারি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জাতীয় মনিটরিং এবং আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত কমিটির জরুরী সভায় ১১ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশ ও বিটিআরসি প্রতিনিধি, আটটি সাধারণ শিক্ষা বোর্ড, কারিগরি এবং মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের প্রতিনিধিদের ওই কমিটিতে রাখা হয়। এর আগে এবার বাংলা প্রথমপত্রের প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগের মধ্য দিয়ে শুরু হয় এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা। এরপর শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও প্রশাসনসহ দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর হয়ে উঠলেও ঠেকানো যায়নি প্রশ্নফাঁসের ঘটনা। শেষ পর্যন্ত প্রশ্নপত্র ফাঁসের প্রায় একই অভিযোগ ওঠার মধ্য দিয়েই ২৫ ফেব্রুয়ারি শেষ হয় এসএসসি পরীক্ষার লিখিত অংশ। বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েও প্রশ্নফাঁস ঠেকাতে ব্যর্থ হয়ে পরীক্ষা পদ্ধতিতে ব্যাপক পরিবর্তনের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত অভিযোগে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এখন পর্যন্ত ১৫৩ জনকে গ্রেফতার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এর মধ্যে পরীক্ষার্থী, কোচিং শিক্ষক, অভিভাবক, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ও স্কুল শিক্ষকও রয়েছেন। এ দিকে, এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল আগামী ৬ মে রবিবার প্রকাশ করা হবে বলে জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ৩ থেকে ৭ মে’র মধ্যে ফল প্রকাশের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে সার-সংক্ষেপ পাঠানো হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ৬ মে সময় দেয়া হয়েছে। ওই দিন সকাল ১০টায় প্রধানমন্ত্রীর কাছে ফলের অনুলিপি তুলে দেয়া হবে। এরপর দুপুরে সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলনে বিস্তারিত ফল প্রকাশ করব।’ গত ১ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এসএসসি ও সমমানের তত্ত্বীয় বিষয়ের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। ব্যবহারিক পরীক্ষা ২৬ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয়ে ৪ মার্চ শেষ হয়। সারা দেশে তিন হাজার ৪১২টি কেন্দ্রে মোট ২০ লাখ ৩১ হাজার ৮৮৯ জন পরীক্ষার্থী অংশ নেয়। এর মধ্যে ১০ লাখ ২৩ হাজার ২১২ জন ছাত্র ও ছাত্রীর সংখ্যা ১০ লাখ ৮ হাজার ৬৮৭ জন। এসএসসিতে মোট পরীক্ষার্থী ১৬ লাখ ২৭ হাজার ৩৭৮ জন, মাদ্রাসা বোর্ডের অধীন দাখিল পরীক্ষায় দুই লাখ ৮৯ হাজার ৭৫২ জন এবং কারিগরিতে এক লাখ ১৪ হাজার ৭৬৯ জন পরীক্ষার্থী অংশ নেয়। গত কয়েক বছর থেকে তত্ত্বীয় বিষয়ের পরীক্ষা শেষ হওয়ার ৬০ দিনের মধ্যে ফল প্রকাশ করে আসছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
×