ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বডিবিল্ডারদের টাকায় কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর!

প্রকাশিত: ০৪:৪২, ৪ মে ২০১৮

বডিবিল্ডারদের টাকায় কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর!

রুমেল খান ॥ বাংলাদেশ একটি আজব দেশ। এই দেশটি বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন রেকর্ড গড়েছে। খেলাধুলায়ও। অলিম্পিকে পদক না জেতা সবচেয়ে বেশি মানুষের দেশ হিসেবে। অথচ আশ্চর্যের বিষয়- এদেশে মোট ৪৬ ক্রীড়া ফেডারেশন এবং ক্রীড়া এ্যাসোসিয়েশন আছে এবং এদের বেশিরভাগই নিষ্ক্রিয় এবং অনিয়মে সক্রিয়। এই ৪৬ ফেডারেশন বা এ্যাসোসিয়েশনের মধ্যে অনেক ফেডারেশন আছে যাদের বিরুদ্ধে আছে নানা অভিযোগ, বিতর্ক এবং সমালোচনা। এমনই একটি হচ্ছে বাংলাদেশ শরীর গঠন ফেডারেশন। গত ২৫-৩০ এপ্রিল মঙ্গোলিয়ার উলানবাটরে অনুষ্ঠিত হলো ৫২তম এশিয়ান বডিবিল্ডিং এ্যান্ড ফিটনেস চ্যাম্পিয়নশিপ। এই চ্যাম্পিয়নশিপে অংশগ্রহণের লক্ষ্যে বাংলাদেশ শরীর গঠন ফেডারেশনের কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় সিদ্ধান্ত হয়- চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশ দল থেকে মিস্টার বাংলাদেশ খ্যাত নাজমুস সাকিব ভুঁইয়া, অপর মিস্টার বাংলাদেশ সুমন চন্দ্র দাস ও মিস্টার ঢাকা আতিকুর রহমান শিমুল, দলনেতা হিসেবে বাংলাদেশ বডিবিল্ডিং ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম এবং অফিসিয়াল ডেলিগেট হিসেবে ফেডারেশনের কোষাধ্যক্ষ জহির উদ্দিন চৌধুরী অংশগ্রহণ করবেন। এ জন্য জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে (এনএসসি) ফেডারেশনের পক্ষ থেকে এই পাঁচজনের জিও (সরকারী অনুমোদন পত্র) এবং আর্থিক অনুদান চাওয়া হয়। আবেদনের প্রেক্ষিতে এই চ্যাম্পিয়নশিপে অংশগ্রহণের জন্য এনএসসি বাংলাদেশ দলকে জিওসহ চার লাখ টাকা অনুদান দেয়। গত ১৫ এপ্রিল জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের সচিব মাসুদ করিমের স্বাক্ষরিত অনুমোদন পত্র পায় ফেডারেশন। সবকিছু ঠিকই ছিল। এনএসসি চ্যাম্পিয়নশিপে অংশগ্রহণের জন্য তিন খেলোয়াড়কে আর্থিক সহায়তাও করে। কিন্তু ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক মঙ্গোলিয়াতে যান মাত্র এক খেলোয়াড় আতিকুর রহমান শিমুলকে নিয়ে। সঙ্গে নিয়ে যান কোষাধ্যক্ষ জহিরকে নিয়ে! কিন্তু কেন? দেশসেরা দুই বডিবিল্ডার সাকিব ও সুমনকে রেখে কেন নেয়া হলো শুধুই শিমুলকে? এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেশের বডিবিল্ডিংয়ের সঙ্গে জড়িতদের মধ্যে চলছে ফেডারেশন ও বিশেষ করে বিতর্কিত সাধারণ সম্পাদক নজরুলকে নিয়ে তীব্র সমালোচনা। এনএসসি থেকে আর্থিক সহযোগিতা এবং জিও’তে নাম থাকা সত্ত্বেও কেন মঙ্গোলিয়াতে খেলতে গেলেন না মিস্টার বাংলাদেশ খ্যাত সুমন চন্দ্র দাস? কথা বলে জানা গেল ভেতরের ঘটনা। সুমন জানান, ‘আন্তর্জাতিক কোন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করার জন্য আমাদের বডিটা তৈরি করার জন্য কমপক্ষে দুই মাস সময় প্রয়োজন। মঙ্গোলিয়াতে বাংলাদেশ দল যাবে সেটা জানতে পারি শিমুল ভাইয়ের মাধ্যমে। ফেডারেশনের পক্ষ থেকে আমাকে কোন কিছু জানানো হয়নি। পরে আমি ৮ এপ্রিল সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে কথা বলি। তিনি বলেন তুমি যাবে কি না। আমি বলি এত কম সময়ে ভাল প্রস্তুতি ছাড়া যাওয়া কি ঠিক হবে? ঠিক আছে যা ভাল হয় করেন। এই ঘটনার বেশ কদিন পর নজরুল স্যার ও জহির ভাই আমার জিমে দেখা করতে আসেন। তারা বলেন এনএসসি থেকে দুই কর্মকর্তা ও এক খেলোয়াড় মোট ৩ জনের টাকা দিয়েছে। এখন তুমি বলো শিমুল আর তোমার মধ্যে কে যাবে? তখন আমি বললাম স্যার অল্প সময় আগে জানার ফলে আমার প্রস্তুতি তেমন ভাল না। আপনারা শিমুল ভাইকে নিয়ে যান। তখন তারা খুশি হয়ে আলহামদুলিল্লাহ বলে চলে যান। এরপর আমার সঙ্গে আর কোন যোগাযোগ হয়নি। কিন্তু পরে আমিও জানতে পেরেছি এনএসসি থেকে ৫ জনের জন্য আর্থিক অনুদান বাবদ ৪ লাখ টাকা ও জিও প্রদান করেছে।’ সাকিবের এ বক্তব্য থেকে বোঝা যায় তিনিও সঠিক সময়ে চ্যাম্পিয়নশিপে অংশগ্রহণের বিষয়টি ফেডারেশন থেকে জানতে পারেননি। ফেডারেশন থেকে মঙ্গোলিয়াতে নিয়ে যাওয়া আতিকুর রহমান শিমুল কখনও মিস্টার বাংলাদেশ হননি। দেশে তার সর্বোচ্চ ভাল ফলাফল মিস্টার ঢাকা খেতাব জেতা। শিমুলকে মঙ্গোলিয়াতে নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে ফেডারেশনের কয়েক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে উঠেছে স্বজনপ্রীতিরও অভিযোগ। এদিকে তিন খেলোয়াড়ের বদলে মাত্র একজনকে নিয়ে মঙ্গোলিয়াতে যাওয়া প্রসঙ্গে এনএসসির সচিব মাসুদ করিম বলেন, ‘আমাদের কাছে তিন খেলোয়াড়সহ মোট পাঁচজনের জন্য ফেডারেশন থেকে অনুমতির জন্য আবেদন করা হয়। আমরা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দিই জিও-এর জন্য। অনুমতি হলে আমরা ৫ সদস্যবিশিষ্ট দলকে আর্থিকভাবে চার লাখ টাকা প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। কিন্তু কেন ভাল দু’জন খেলোয়াড়কে রেখে একজনকে নিয়ে যাওয়া হলো, সেটি আমরা ফেডারেশনের কাছে জানতে চাইব। যদি কোন খেলোয়াড় লিখিত অভিযোগ, সংবাদপত্র, অনলাইন বা টিভি খবরের মাধ্যমে আমরা বিষয়টি জানতে পারি তাহলে বিষয়টি নিয়ে ফেডারেশনের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হবে।’ এ প্রসঙ্গে কথা বলার জন্য বডিবিল্ডিং ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলামের সঙ্গে মোবাইলে কথা বলার চেষ্টা করা হলে তার দুটো নম্বরই বন্ধ পাওয়া যায়। তবে বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে গত মঙ্গলবার দেশে ফিরে ঘটনা আঁচ করতে পেরে তিনি ফোন বন্ধ করে রেখেছেন। নজরুলের বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ আছে। গত অক্টোবরে ভারতের মুম্বাইয়ে অনুষ্ঠিত মিস্টার অলিম্পিয়া এ্যামেচার ইন্ডিয়া প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য বাংলাদেশ শরীর গঠন ফেডারেশন থেকে চার সদস্যের শরীর গঠন দল পাঠানো হয়েছিল। এদের তিনজন ছিলেন বডিবিল্ডার (সুমন চন্দ্র দাস, নাজমুস সাকিব ভুঁইয়া এবং আনোয়ার হোসেন)। তারা ভারত যাওয়ার আগে ফেডারেশন যে প্রেসমিট করে সেখানে জানানো হয় ভারতগামী খেলোয়াড়দের সম্পূর্ণ খরচ বহন করছে ফেডারেশন। এছাড়া তিন বডিবিল্ডারকে ১০ হাজার টাকা করে পকেটমানিও দিচ্ছে তারা। কিন্তু অনুসন্ধানে জানা গেছেÑ প্রকৃতপক্ষে বডিবিল্ডাররা সেখানে যাচ্ছেন সম্পূর্ণ নিজেদের টাকায়। ফেডারেশন এখানে নিজেদের ইমেজ বৃদ্ধি করতেই এমন প্রচারণা চালায়। ঠিক যেমনটি করেছিল কয়েকমাস আগে আরেক বডিবিল্ডার হাসিব হলির বেলাতেও। ২০১৬ সালের মধ্য জানুয়ারিতে সিঙ্গাপুরে ‘নাব্বা ওয়ার্ল্ড ফিটনেস ফেডারেশন এশিয়া মাসল ওয়ার’ বডিবিল্ডিং প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে হাসিব অনুর্ধ-২৪ জুনিয়র বিভাগে জিতে নেন স্বর্ণপদক। যা বাংলাদেশের বডিবিল্ডিংয়ের ইতিহাসে প্রথম। অথচ এই বডিবিল্ডারকে দিয়ে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করতে না পারায় বিরাগভাজন হয়ে তাকে আজীবন নিষিদ্ধ করে ফেডারেশন।
×