ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও বাংলাদেশের প্রস্তুতি

প্রকাশিত: ০৪:০৩, ৪ মে ২০১৮

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও বাংলাদেশের প্রস্তুতি

বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধিসহ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিশ্বের উপকূলবর্তী যেসব দেশ সবচেয়ে অরক্ষিত ও হুমকির সম্মুখীন, বাংলাদেশ তার একটি। বিজ্ঞানীরা বলেছেন, ভূপৃষ্ঠের উষ্ণতা যে হারে বাড়ছে তা যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে আগামী ১০০ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল প্লাবিত হবে এবং প্রায় তিন কোটি মানুষ উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন কিছু কিছু অঞ্চলের আবহাওয়ার সঙ্কটময় অবস্থাকে আরও শোচনীয় করে তুলবে এবং উপকূলীয় অঞ্চলে বসবাসকারী, মোটামুটি ঝুঁকিতে থাকা মানুষকে আরও বেশি হুমকির মুখে ফেলবে। দেশের লাখ লাখ নাগরিককে নানা সময়ে ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, দাবদাহ ও খরার মতো মারাত্মক প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে লড়াই করতে হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন বহুলাংশে শুরু হয়েছে আঠারো শতকের শেষ ভাগে শিল্পায়নের জন্য জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের মধ্য দিয়ে। সেই থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমন বেড়েই চলেছে। জাতীয় নিরাপত্তা ঝুঁকি জলবায়ু পরিবর্তন যেসব দেশকে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় ফেলবে, তার মধ্যে প্রথম সারিতে আছে বাংলাদেশ। আমরা যে বদ্বীপে আছি এবং সমুদ্রের সঙ্গে যে সম্পর্ক, তাতে আমরা খুব নাজুক পরিস্থিতিতে আছি। এর বিরূপ প্রভাব এমন চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে যাচ্ছে, যা জাতীয় নিরাপত্তায় হুমকি হিসেবে দেখা দিতে পারে। বাংলাদেশের দক্ষিণে সমুদ্রের স্তর যদি এক মিটার বাড়ে, তাহলে আইপিসিসির প্রাক্কলন অনুযায়ী বাংলাদেশের ১৭ থেকে ২০ শতাংশ জমি সমুদ্র গর্ভে বিলীন হয়ে যাবে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যে জাতীয় কৌশলপত্র প্রণয়ন করা হয়, তাতে প্রায় ২ কোটি মানুষের জলবায়ু উদ্বাস্তু হওয়ার কথা বলা হয়েছে। আমরা অনুমান করতে পারি, এত ছোট দেশে যদি ২০ শতাংশ জমি সমুদ্রে চলে যায় এবং যদি প্রায় ২ কোটি মানুষ উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়, তাহলে তাদেরকে দেশের মধ্যে অন্যত্র স্থানান্তরের সুযোগ নেই। এতে শহর এলাকায় জনসংখ্যার চাপ আরও বাড়বে। সামাজিক স্থিতিশীলতা ভেঙে পড়তে পারে। ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের বিভাগীয় শহরগুলো মানুষের এতটা চাপ সহ্য করতে পারবে না। তাই সামাজিক শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ার হুমকি দেখা দেবে। অতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণ বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিগত আট লাখ বছরের মধ্যে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে ২০১৬-১৭ সালে নির্গত হওয়া কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ সর্বোচ্চ। ফলশ্রুতিতে পৃথিবীর তাপমাত্রা ১ দশমিক ১ ডিগ্রী সেলসিয়াস বেড়েছে। আবহাওয়া ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, কার্বন নিঃসরণের বিদ্যমান ধারা অব্যাহত থাকলে বর্তমান শতাব্দীর মধ্যে বিশ্বের গড় তাপমাত্রা প্রাক-শিল্পবিপ্লব সময়ের তুলনায় ২ ডিগ্রী সেলসিয়াস বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রবল। এতে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে জলবায়ু পরিবর্তনের মারাত্মক প্রভাব পড়বে। গত অর্ধশতক জুড়ে গবেষণা তথ্য নিশ্চিত করেছে যে, বিশ্বের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও আবহাওয়ার তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে কার্বন ও অন্যান্য ‘গ্রিনহাউস গ্যাস’ নিঃসরণের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। বিশ্ব অর্থনীতির চাঙ্গাভাব বহাল থাকার সময় বাড়তি জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার এবং বাতাসে বেশি মাত্রায় কার্বন দূষণ হয়েছে। আবহাওয়ার তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় বৈরী পরিবেশের প্রভাবে ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, খরা, অসময়ে প্রবল বৃষ্টিপাত ও ফসলের মৌসুমে বৃষ্টিহীন, মাটির লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়াসহ অর্থনীতি ও মানুষের জীবন বিপন্ন হওয়ার মতো দুর্যোগ বেড়ে যাবে। খাদ্যনিরাপত্তা ঝুঁকি জলবায়ু পরিবর্তনকে সম্পূর্ণভাবে নিরাপত্তা ঝুঁকি হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। সাধারণত বিশ্বে কয়েক হাজার উদ্বাস্তু সৃষ্টি হলেই নিরাপত্তার বিষয়টি সামনে চলে আসে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় প্রস্তুতি নেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখনও পিছিয়ে আছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে খাদ্য নিরাপত্তায় বড় ধরনের চাপ আসছে। ২০ শতাংশ জমি কমবে, জনসংখ্যা বাড়বে। আর লবণাক্ততা যেটা বাড়বে, তার ফলে উৎপাদনশীলতা হ্রাস পাবে। ইতিমধ্যে মিঠা পানির জলাধারেও লবণাক্ততা এসে যাচ্ছে। তাই খাদ্য উৎপাদনে যে সক্ষমতা এখন আছে, সেখানে বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি হতে পারে। ২০৫০ সালের মধ্যে যে চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা আছে, সেটা ৮ শতাংশ কমে যাবে। গম উৎপাদন কমবে ৩২ শতাংশ। কমবে কৃষিজমি, বাড়বে মানুষ। সুতরাং যে খাদ্যনিরাপত্তা এখন আছে, সেটা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আমরা হয়তো ধরে রাখতে পারব না। সুপেয় পানির সঙ্কট জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের খাদ্যনিরাপত্তা নষ্ট হবে, এর ওপরে পানির নিরাপত্তায় বিরাট চাপ আসবে। বাংলাদেশে সুপেয় পানির বিরাট ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই পানির চক্রগুলো বদলে যাচ্ছে। যখন পানি আসার কথা, তখন পর্যাপ্ত পানি আসছে না। একই সঙ্গে নিম্ন অববাহিকার দেশ হওয়ার কারণে উজান থেকে যে প্রবাহ আসার কথা, সেটাও আসছে না। সেখানে নানা বাধা সৃষ্টি হয়েছে এবং আরও হতে যাচ্ছে। আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে তার আরও অবনতি ঘটবে। শুধু মানুষের জীবন জীবিকার জন্য নয়, পুরো ইকোসিস্টেমকে বাঁচিয়ে রাখতে প্রয়োজন পানির অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করা। লবণাক্ততা বৃদ্ধি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে খুব অল্প সময়ের মধ্যে পরিবেশে মারাত্মক বিপর্যয় ঘটতে পারে। সুন্দরবনে লবণাক্ত পানি ভেতরে চলে আসছে, এ কারণে অনেক গাছপালা মরে যাচ্ছে, সমুদ্রের স্তর বাড়ার কারণে এর একটা অংশ তলিয়ে যাবে এবং যাচ্ছে। সুন্দরবন দুর্যোগ ঠেকায়, তখন আর ঠেকাবে না। সিডর, আইলা, মহসিন হয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ আরও বাড়বে। মানুষের জীবন, জীবিকা ও স্বাস্থ্যের ওপর চাপ বাড়তে থাকবে। পানিবাহিত রোগ বাড়বে। জনগণের জীবন ও মানের ওপর চাপ বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। চিকিৎসা সাময়িকী ল্যানসেট বলছে, সাত কোটির বেশি মানুষ আর্সেনিকে আক্রান্ত হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, এটা বিশ্বের বৃহত্তম গণবিষক্রিয়ার ঘটনা। বৈশ্বিক সঙ্কট বিশ্বজুড়েই নানা সংকট যেন একযোগে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। বিশ্বব্যাপী আর্থিক মন্দা, তেলের মজুদ কমে যাওয়া, জলবায়ু পরিবর্তনের নানামুখী চাপ এবং সন্ত্রাসের উন্মত্ততা, প্রযুক্তির প্রসারে নানা প্রাপ্তি সত্ত্বেও ব্যাপক কর্মচ্যুতি, অর্থ পাচার, জালিয়াতি, নানা মাত্রিক অপরাধের ব্যাপ্তি- এসবই যেন রুগ্ন বিশ্ব ব্যবস্থার গভীর সম্পর্কযুক্ত নানা দিক। বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তন ও সন্ত্রাসবাদের ঝুঁকি সমসাময়িক বিশ্ব সঙ্কটগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভীতিকর হিসেবে সামনের দিকে এগিয়ে এসেছে। এসবের থাবায় আমাদের চারপাশের পরিবেশ ও সমাজ আজ অনেকটাই ক্ষত-বিক্ষত। দিশেহারা প্রজাতি উষ্ণ আবহাওয়ার কারণে বিশ্বের প্রায় অর্ধেক উদ্ভিদ ও প্রাণী নিজ নিজ স্থান পরিবর্তন করেছে। যুক্তরাজ্যের প্লাইমাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞ কামিল পারমেসান বলেন, হাজারো প্রজাতির তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত শতকে অনেক প্রজাতি এলাকা পরিবর্তন করে মেরু অঞ্চল বা উঁচু পাহাড়ি অঞ্চলের দিকে চলে গেছে। সব গবেষণার মধ্যে অর্ধেকের বেশি গবেষণায় দেখা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রজাতির স্থানান্তর ঘটেছে এবং অধিকাংশ বিলুপ্ত প্রায় প্রজাতির ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। অন্যান্য পরিবর্তনের মধ্যে রয়েছে উদ্ভিদে আগাম ফুল ফোটা, পরিযায়ী পাখির আগাম আগমন প্রভৃতি। উদ্ভিদ, গুল্ম, প্রজাপতি, পাখি, স্তন্যপায়ী, উভচর, কোরাল, মেরুদণ্ডহীন ও মাছের ক্ষেত্রে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব প্রবল ভাবে দেখা যাচ্ছে। কৃষি উৎপাদন হ্রাস জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দেশের ঋতু চক্র বদলে যাচ্ছে। এর নেতিবাচক প্রভাব দেশের কৃষি উৎপাদনের ওপরে পড়তে শুরু করেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা করার জন্য যেসব ফসলের জাত ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হচ্ছে তা কৃষকের কাছে পৌঁছাতে হবে। অনেক প্রযুক্তি সঠিকভাবে কাজও করছে না। বাংলাদেশে এখন আর আগের মতো ষড়ঋতুর বৈশিষ্ট্য দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। শীতের পর গ্রীষ্ম আসলেও বসন্ত যেন ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে। হেমন্তের উপস্থিতিও সেভাবে বোঝা যায় না। আবার বর্ষা আসছে নির্ধারিত সময়ের অনেকটা পরে। জলবায়ুর ক্রম পরিবর্তনের সবচেয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে আমনের উৎপাদনের ওপর। যার ফলে কৃষকই সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়ছেন। তাই পরিবর্তিত পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো ধানের জাত উদ্ভাবনের দিকে মনোযোগ না দিলে কৃষকেরা ধান উৎপাদন থেকে সরে এসে সবজির দিকে মাত্রাতিরিক্ত ঝুঁকে পড়বেন। এতে ধান উৎপাদন কমে গিয়ে খাদ্য নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে। ফিড দ্য ফিউচার উদ্যোগের আওতায় যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা মাটির গভীরে সার স্থাপন প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ধানের উৎপাদনে নাইট্রোজেন সারের ব্যবহার কমাতে সহায়তা করছে। এই প্রযুক্তি চালের পুষ্টি বৃদ্ধি ঘটায় এবং চালের উৎপাদন ১৫-২০ শতাংশ বৃদ্ধি করে। চলবে... লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×