ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ভয়াল হামলার সেই রাত!

প্রকাশিত: ০৪:০২, ৪ মে ২০১৮

ভয়াল হামলার সেই রাত!

৮ এপ্রিল সন্ধ্যা থেকে শাহবাগ ফুল মার্কেটের সামনে সহকর্মী ছাত্রনেতাদের নিয়ে আড্ডা দিচ্ছিলাম। রাত ৮টার দিকে হঠাৎ দেখি কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া শুরু হয়েছে। বিকালে মধুর ক্যান্টিন থেকে শাহবাগে আসার পথে আন্দোলনকারীদের মধ্যে শিবির ও ছাত্রদলের চিহ্নিত কিছু লোককে দেখেছিলাম। পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষ দেখে উপলব্ধি হয় যে, আন্দোলনের নামে এই সহিংসতা ভয়াবহ রূপ নিতে যাচ্ছে। তাই নিজের ফেসবুক ওয়ালে স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম ‘আমি শাহবাগ থেকে সরাসরি বলছি, আন্দোলন ভিন্নপথে চলে যাচ্ছে।’ একটি দৈনিকের সিনিয়র সাংবাদিককে রাত ৯টার পর ফোন করে সহিংসতার পুরো ঘটনাটা বলেছিলাম। তিনি জানালেন, এটা মূলত জামায়াত-বিএনপির এজেন্ডা। তারা অনেক আগে থেকেই এই রকম পরিকল্পনা করে আসছে। তারা দেশকে স্বাধীনতা বিরোধীদের আখড়া বানাতে চায়। সরকারকে উৎখাত করতে চায়। ওনাকে অনুরোধ করে বলেছিলাম, সরকার সংশ্লিষ্টদের ঘটনাটা জানান। উল্লেখ্য, এই সাংবাদিকের ভাইয়ের সঙ্গে সরকারের উচ্চমহলের অনেকের বেশ জানাশোনা আছে। জামায়াত-বিএনপি এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে অনেক সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ট্রল করেছিল। এটা আমাকে সত্যি আহত করে। সাধারণ ছাত্রদের নামে যারা এই সহিংসতা করছে তারা জামায়াত-বিএনপির সরাসরি সহযোগিতায় এটা করছে। শিবির-ছাত্রদল কোটা সংস্কার আন্দোলনের নামে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের উদ্বুদ্ধ করে সামনে নিয়ে আসে। শুরুর দিকে এই শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের সুযোগের অপেক্ষায় শিবির ঘাপটি মেরেছিল। ৮ এপ্রিল সন্ধ্যার পর থেকে এই আন্দোলনের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় শিবিরের হাতে। যোগ দেয় বাম ছাত্র সংগঠন ও ছাত্রদলের কতিপয় সন্ত্রাসী। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ‘পুলিশের গুলিতে ছাত্র নিহত’ এই মিথ্যা গুজব ছড়িয়ে শিবির ছাত্রদলে সন্ত্রাসীরা পুলিশের সঙ্গে পুরোদমে সহিংসতা লিপ্ত হয়। ভিসি বাংলো আক্রমণের খবর শুনে সহকারী প্রক্টর আহসান স্যারের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, প্রিন্স, ওদিকের কি খবর, তুমি একটু খোঁজ নাও। আমি বাইক চালিয়ে কাঁটাবন দিয়ে ভিসি চত্বর এসে দেখি দুর্বৃত্তরা ভিসি বাংলোর গেট ভাঙছে, যাত্রী ছাউনি, সিসি ক্যামেরা ভাঙছে। এ সময় আমি সহকারী প্রক্টর আহসান স্যার ও রমনা জোনের এডিসি আব্দুল্লাহ হেল কাফি ভাইকে ভিসি বাংলো ভাঙচুরের ঘটনা জানাই। স্বাধীনতা বিরোধীরা মধ্যরাতে নৃশংসভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য ও তার পরিবারের ওপর হামলা চালায়। নির্মমভাবে ভাঙচুর করে ইতিহাস ঐতিহ্যের ধারক বাহক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের বাংলো। ভাঙচুর-লুটপাটকারীরা গাড়ি আসবাবপত্রে আগুন ধরিয়ে দেয়। এই সময় আমার মনে হয়েছিল, এরা তো একাত্তরের সেই হায়নার দল। এরা আবার জেগে উঠেছে। এরা সাধারণ ছাত্রের নামে কি নির্মম ভয়াবহতা চালাতে পারে তা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস হয় না। এই নৃশংস হামলার ভয়াবহতা দেখেছিলাম ২০০১ সালের অক্টোবরের নির্বাচনের দিন সন্ধ্যার পর আমাদের মাগুরায়। এই সকল হানাদার আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ছত্রছায়ায় দলে অনুপ্রবেশ করে পুরনো আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের নির্মূল করতে চেয়েছিল। ফিরে আসি মূল ঘটনায়। ভিসি বাংলো ভাঙচুরের সময় আমি চিৎকার করে বলেছিলাম, তোমরা এটা ভাঙচুর করো না, আগুন দিও না, এটা আমাদের অস্তিত্ব। ভাঙচুরকারীদের কিছু কর্মী আমাকে মূল ভবনের গেট থেকে ধাক্কাতে ধাক্কাতে মেইন গেটে এর বাইরে বের করে দেয়। তারপর বাইক নিয়ে ছুটে গেলাম মধুর ক্যান্টিনে। ছাত্রলীগের কিছু জুনিয়র কর্মী আমাকে দেখে দৌড়ে এলো। বলল ভাই, শিবির হামলা চালাচ্ছে। আমাদের পাল্টা হামলা চালাতে হবে। তখন ডাকসু ভবনের দিকে এগিয়ে দেখি বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক হ্যান্ডমাইকে ঘোষণা দিচ্ছে আবুবক্কর সিদ্দিক মরেনি। সে আমাদের সঙ্গে আছে, আপনারা শান্ত হোন এই বলতে বলতে আইবিএ-এর সামনে গেল। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক, বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক ও আমার দীর্ঘ এক যুগের রাজনৈতিক সহযোদ্ধা বড় ভাই কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি কাজী এনায়েত, আরিফুর রহমান লিমন ভাইসহ পাঁচ-ছয়শ’ নেতাকর্মী। আমরা সবাই কলা ভবনের পেছন দিয়ে মল চত্বরে যাই। কিছুক্ষণ পর ভিসি বাংলোয় গিয়ে দ্বিতীয় তলা থেকে ভিসি স্যারকে উদ্ধার করে বাইরে বাংলো বাগানে নিয়ে আসি এবং স্যারকে একটা চেয়ারে বসাই। এরপর ছাত্রলীগের সভাপতি-সম্পাদক সহিংসতাকারীদের দিকে (কলা ভবনের সামনের রাস্তা দিয়ে টিএসসির দিকে) এগিয়ে গেলে সহিংসতাকারীরা তাদের ধাওয়া দেয়। ধাওয়া খেয়ে সভাপতি-সম্পাদক ভিসি বাংলোর সামনে অবস্থান নেয়। এ সময় কাজী এনায়েত ও আমার নেতৃত্বে বেশ কিছু ছাত্রলীগের জুনিয়র কর্মীদের নিয়ে সহিংসতাকারীদেরকে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করি। এই সময় দুই পক্ষের মধ্যে ইট পাটকেল ছোড়াছুড়ি হয়। ওদেরকে ধাওয়া করে আমরা যখন হাকিম চত্বরের বাইরে অবস্থান নেই তখন হাকিম চত্বরের ভেতর থেকে ককটেল ও গুলির আওয়াজ শুনতে পাই। এই সময় সহিংসতাকারীরা আমাদের ওপর বৃষ্টির মতো ইট পাথর ছুড়তে থাকে। আমার এসে কলা ভবনের গেটে অবস্থান নেই। আমি ও কাজী এনায়েত যখন সভাপতি-সম্পাদকের কাছে কি করা যায় সিদ্ধান্ত জানতে চাইলাম তখন তারা বলে, উপরে জানিয়েছি, দেখি কি করা যায়। কয়েক মিনিট পর আমরা সাধারণ ছাত্রদের নিয়ে টিএসসির রাজু ভাস্কর্য দখল করে নেই। ওদেরকে ছত্রভঙ্গ করে দেই। শিবির-ছাত্রদল ও সন্ত্রাসীরা বাংলা একাডেমির ভেতর ও বাইরের রাস্তায় অবস্থান করে। সে রাতে হলের গেট ভেঙ্গে যে সকল বোনরা বেরিয়ে এসেছিল তাদেরকে নিরাপত্তা সহকারে আমরা টিএসসির ভেতরে পাঠিয়ে দেই। কারণ, শিবির-ছাত্রদল লাঞ্ছিত করলে মিডিয়া ছাত্রলীগকে দোষ দিয়ে কাহিনী বানাবে। পরে পুলিশ মেয়েদের নিরাপদে হলে পৌঁছিয়ে দেয়। রাতভর সংঘর্ষ শেষে প্রভাতের আলো আসার আগেই সন্ত্রাসীরা গা ঢাকা দেয়। সহিংসতাকারীদের কিছু সংখ্যক কার্জন হলে অবস্থান নেয়। সকাল সাড়ে আটটার দিকে পুলিশের সঙ্গে দোয়েল চত্বরে সর্বশেষে সংঘর্ষ হয়। সে রাতে কিছু শিক্ষক পুলিশ কর্মকর্তা ও সাংবাদিকদের সকাল নয়টা পর্যন্ত পুরো পরিস্থিতি আমি জানিয়েছিলাম। সেই দিনের মিডিয়াকর্মীরা জানে, গোয়েন্দা সংস্থা জানে, শিক্ষক, কর্মকর্ত-কর্মচারী, ক্যাম্পাসের ক্যান্টিন বয়রাও জানে সেই বীভৎস ঘটনার মুহূর্তগুলো। এই নারকীয় ঘটনায় যারা জড়িত ছিল, তাদের অনেকেই ছিল মুখোশধারী এবং হাতে বড় লাঠি। সাধারণ ছাত্ররা এই ঘটনায় বিভ্রান্ত হয়েছিল হয়তো। বেদনাদায়ক ঘটনা যে, হাজার হাজার ছেল হলে অবস্থান করা সত্ত্বেও দানবদের হাত থেকে উপাচার্যের বাসভবন রক্ষা করতে পারেনি। যোগ্য ও সঠিক নেতৃত্ব ও সিদ্ধান্তে ঘাটতি থাকলে অবস্থা যে ভয়াবহ হতে পারে, আবারও তা উপলব্দি করেছি। লেখক : ছাত্রনেতা
×