ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ট্রাফিক আইনের সংস্কার

প্রকাশিত: ০৩:৫৬, ৪ মে ২০১৮

ট্রাফিক আইনের সংস্কার

রাজধানীসহ সারাদেশে সাম্প্রতিককালে উপর্যুপরি সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ও পঙ্গুত্ববরণের পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের সঙ্গে আইন কমিশনের চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের সাক্ষাতকারটি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক, তাৎপর্যপূর্ণ ও গুরুত্ববহ বৈকি। উল্লেখ্য, গত কয়েক সপ্তাহে শুধু রাজধানীতেই কয়েকজন তরুণ, গৃহবধূ ও শিশু মারা গেছে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায়। এর মধ্যে কেউ কেউ দুর্ঘটনায় শুধু হাত বা পা হারিয়েও শেষ পর্যন্ত বাঁচতে পারেনি। পত্রিকান্তরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ৪৩৪ দিনে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তির সংখ্যা প্রায় চার হাজার। অন্যদিকে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত চার মাসে ১ হাজার ৮৭১টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ২ হাজার ১২৩ জন এবং আহতের সংখ্যা ৫ হাজার ৫৫৮ জন। এ অবস্থায় সাবেক প্রধান বিচারপতি বলেছেন, ট্রাফিক আইন পরিবর্তন করা বাঞ্ছনীয় বলে মনে করি। লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালিয়ে দুর্ঘটনায় প্রাণহানি হলে বিদ্যমান আইনে সাজার মেয়াদ কম এবং এ বিষয়ে জামিনের বিষয়টিও পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে। এই বিষয়টি মাথায় রেখে আইনের খসড়া তৈরির প্রক্রিয়া ইতোমধ্যে শুরুও করেছে আইন কমিশন। এটি একটি অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক খবর। অবশ্য এর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন সরকারের একজন মন্ত্রী, যিনি বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক সমিতির সভাপতি। তবে দেশের জনগণ চাইলে এবং জনমত জোরালো হলে বিদ্যমান ট্রাফিক আইনের পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী এবং যত দ্রুত তা প্রণীত ও বাস্তবায়িত হ ততই মঙ্গল। গণমাধ্যমে নানা জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করা সত্ত্বেও দেশে বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনা। এটি একটি উদ্বেগজনক খবর বৈকি। পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৬ সালের তুলনায় ২০১৭ সালে সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েছে ১৫ থেকে ২২ ভাগ পর্যন্ত। তদুপরি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের ৪২ ভাগই পথচারী, যারা নিতান্তই অসতর্কতাবশত দুর্ঘটনাকবলিত হয়ে থাকে। কানে সেলফোন নিয়ে রাস্তা পারাপার, জেব্রা ক্রসিং না মানা, ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার না করা, ট্রাফিক আইন না মানা, ডান-বাম না দেখে বিপথে যানবাহন চালানো, বেপরোয়া ড্রাইভার ইত্যাদি পথচারীদের সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হওয়ার অন্যতম কারণ। সড়ক দুর্ঘটনায় বছরে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ৩৪ হাজার কোটি টাকার বেশি, যা মোট জিডিপির ২ ভাগ। আরও যা দুঃখজনক তা হলো অধিকাংশ ক্ষেত্রে সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ড্রাইভারদের তেমন শাস্তি হয় না। পুলিশ কর্তৃক সড়ক দুর্ঘটনার মামলাগুলো দায়ের করা হয় হেলাফেলা করে। ক্ষতিপূরণ আদায়ও ততোধিক দুঃসাধ্য। জেল-জরিমানার বিধান রেখে সড়ক পরিবহন আইন-২০১৭-এর খসড়া অনুমোদন করা হয়েছে। এই প্রথম সড়ক পরিবহন আইনে যানবাহন চালকদের ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে শিক্ষাগত যোগ্যতার বিধান রাখা হয়েছে ন্যূনতম ৮ম শ্রেণী এবং সহকারীর যোগ্যতা পঞ্চম শ্রেণী পাস। পেশাদার চালকের ক্ষেত্রে বয়সও বেঁধে দেয়া হয়েছে, ২১ বছর। সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধ ও গণপরিবহনে শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য প্রণীত এই আইনে তিন রকম শাস্তি দেয়া যাবে দ-বিধির অধীনে। নরহত্যা (উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে) হলে ৩০২ ধারা প্রযোজ্য হবে। যাতে শাস্তি মৃত্যুদ-। আর খুন নয় এমন ঘটনায় ৩০৪ ধারা অনুযায়ী সাজা দেয়া যাবে যাবজ্জীবন। আর শুধু সড়ক দুর্ঘটনার জন্য হলো ৩০৪ (খ) এর জন্য তিন বছরের কারাদ-। এর ফলে শেষ পর্যন্ত যানবাহন মালিক ও চালকদের স্বার্থই সংরক্ষিত হয়েছে। দেশের নাগরিক সমাজ থেকে শুরু করে যাত্রী কল্যাণে নিয়োজিত বিভিন্ন সংগঠনের নেতাসহ সুশীল সমাজের দাবি ছিল সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা হোক। সে ক্ষেত্রে তা যাবজ্জীবন না হোক, অন্তত ১৪, ১০ অথবা নিদেনপক্ষে ৭ বছরের জেল-জরিমানাসহ ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা রাখা ছিল বাঞ্ছনীয়। তদুপরি বলা হয়েছে, সড়ক দুর্ঘটনার অপরাধ হবে জামিন ও আপোসযোগ্য। তার মানে হলো গণদাবিকে উপেক্ষা করে পরিবহন মালিক ও চালক-হেলপারদের চাপে পড়ে শেষ পর্যন্ত পিছু হটেছে সরকার। তবে সাবেক প্রধান বিচারপতি ও আইন কমিশনের চেয়ারম্যানের বক্তব্যে জনগণের আশা-আকাক্সক্ষারই প্রতিফলন ঘটেছে।
×