ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

ছন্দাদের ক্ষোভ

মে দিবস আসে আর যায়- ভাগ্য বদলায় না ওদের

প্রকাশিত: ০৫:২৩, ৩ মে ২০১৮

মে দিবস আসে আর যায়- ভাগ্য বদলায় না ওদের

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ রাস্তার পাশে রাখা ভ্যানের ওপর বসে আছে কোলের শিশু। আর মা ঝাঁকায় করে বালি টানছেন। মা যখন ঝাঁকা মাথায় মেয়ের পাশ দিয়ে হেঁটে যেদিকে যাচ্ছেন মেয়েও সেদিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাচ্ছে। কিছুক্ষণ এভাবে সড়কের পাশে ড্রেনের কাজে বালি এগিয়ে দেয়ার পর মা এলেন মেয়ের কাছে। মেয়ের তখন খুশির শেষ নেই। খিলখিলিয়ে প্রাণ খুলে হাসতে লাগল। মেয়ের হাসিতে মাও বেজায় খুশি। মেয়েকে উদ্দেশ করে বলতে লাগলেন নানা কথা। কিন্তু মেয়ে তো কথা বলতে পারে না। সে শুধু হেসেই যাচ্ছিল। বুধবার এমন দৃশ্য চোখে পড়ে মালিবাগ চৌধুরী পাড়া ১৩৪/বি সড়কে। চলছে ড্রেনের কাজ। সেখানেই দিনমজুরের কাজ করেন ছন্দা রানী (২৪)। এই মেয়েটি তার। তার আরেকটি মেয়ে আছে। সে বাসায় থাকে। আর এই সন্তানটি একেবারেই ছোট বলে তাকে সঙ্গে নিয়েই কাজ করেন ছন্দা। ছোট্ট এই শিশুটিকে রাস্তার পাশে কোথাও রেখে প্রতিদিন কাজ করেন তিনি। ছন্দারা থাকেন রাজধানীর মেরাদিয়া এলাকায়। এখানে শুধু ছন্দা নন, ছন্দার স্বামী, শ্বশুর ও শাশুড়িও একই কাজ করেন। কথা বলতে গেলে ছন্দা জনকণ্ঠকে বলেন, কথা বলে আর কি হবে। আমাদের তো কোন ভাল হবে না। আমাদের কাজ করেই খেতে হবে। তার বক্তব্য এ রকম যে উন্নতি হবে সর্দার ঠিকাদার বা ওপর মহলের। শ্রমিক শ্রেণীর যারা আছেন, তাদের শ্রমিকই থেকে যেতে হবে। তাদের উন্নতি হবে না। তাদের কথা কেউ ভাবেন। শুধু এভাবেই লিখে নিয়ে যায়, কিন্তু তাদের ভাগ্যের কোন পরিবর্তনে কেউ এগিয়ে আসে না। তিনি আরও জানান, দুই বছর ধরে তিনি নারী হয়ে এভাবে ভারি কাজ করছেন। কখনও বালি টানেন, কখনও মাটি খোঁড়েন, কখনও মাথায় করে মাটি কিংবা সিমেন্ট, খোয়া, বালি-ঢালাইয়ের উপকরণ টানেন বা আরও অনেক ভারি কাজ করেন। দিন হাজিরা হিসেবে পান ৩০০ টাকা। তার দাবি পুরুষের সমান কাজ করেও তিনি একশ টাকা কম পান। এই কাজে একজন পুরুষ পায় ৪০০ টাকা। পুরুষের সমান কাজ করে কম বেতন পাওয়ায়ও তিনি মনে মনে খুবই ক্ষুব্ধ। কিন্তু বলার কেউ নেই। তার দাবি, এই বৈষম্য প্রথা ভাঙ্গার। ছন্দার সঙ্গে কথা বলতে বলতে তার শাশুড়ি কাজল রানী (৫৫) এগিয়ে আসেন। কথা হয় তার সঙ্গে। কথা বলতে বলতে তিনি কেঁদে ফেলেন। তিনি জানান, তাদের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। ক্ষুদ্র ঋণের দায়ে এলাকা ছেড়েছেন। কয়েকটি বেসরকারী সংস্থা থেকে লোন তুলেছিলেন। তা শোধ করার জন্য শহরে এসেছেন। বছর তিনেক হলো রাজধানীতে এসেছেন। যখন যে কাজ পান তাই-ই করেন। ছন্দারা আলাদা থাকে। আর তিনি আর তার স্বামী ও দুই মেয়ে আলাদা থাকেন। কাজ করে যা আয় করেন তা থেকে কিস্তি দেন আর সংসার চালান। ‘কেডায় কয় বেডা আর বেডিগো সমান অধিকার, কিন্তু কামের মজুরির বেলায় আমাগোরে দেয় পুরুষ মাইনষের অর্ধেক ট্যাহা।’ ছন্দার সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে আকলিমা নামের আরেক শ্রমিক বললেন, ‘বছরের পর বছর একটাই কথা হুনি, মাইয়া মানুষে কাম পারে না। এই কারণ দেহাইয়া বেডাগোরে ৭০০ টাকা দিলে আমাগোরে দেয় ৩৫০ টাকা। এইডা কেমুন বিচার? এইসব কথা আপনাগো কাছে কইয়া লাভ নাই, ফজরের ওয়াক্তে ঘুম থাইক্যা উইঠা না খাইয়া আইছি। কথা কইতেও কষ্ট লাগতাছে।’ তারা জানান, ঈদ, পার্বণ, অসুখ বিসুখ ছাড়া তারা প্রতিদিনই কারও না কারও কাছে শ্রম বিক্রি করেন। দুঃখভরা কণ্ঠে জানালেন, তারা সরাসরি কাজ পান না। তাই মজুরি অর্ধেক পান। এলাকার প্রভাবশালী ঠিকাদাররা ভবন মালিকদের সঙ্গে চুক্তি করে বিভিন্ন এলাকায় তাদের কাজে নিয়ে যান। সাধারণত সকাল ৯টা/১০টা থেকে আসরের নামাজের আজান পর্যন্ত কাজ করেন। অনেক সময় বাড়তি কাজ করলেও ওভারটাইম পান না। এদের সঙ্গে কাজ করে আরেক দম্পতি শহিনা বেগম (৬০) ও মোঃ মোস্তফা (৬৫)। শহিনাকে দেখলে মনে হয় তার বয়স আশির উপরে। শরীরের চামড়া কুঁচকে গেছে। বয়সের ভারে হালকা কুঁজো হয়ে গেছেন। ঠিকভাবে হাঁটতেও তার কষ্ট হয়। এমন দৈহিক অবস্থা নিয়ে ঠিক দুপুরের রোদে দেখা যায় স্বামীর সঙ্গে ড্রেনের পাশে কোদাল দিয়ে মাটি খুঁড়ছেন সহিনা বেগম। ঘামে ভিজে আছেন। নিঃশ্বাস টেনে তুলতে অনেক কষ্ট হচ্ছে। তারপরও মাটির ওপর কোদালের আঘাত করে যাচ্ছেন। সহিনাদের গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার রামচন্দ্রপুর। মাস ছয়েক হলো তারা রাজধানীতে এসেছেন। থাকেন মেরাদিয়া এলাকায়। এই বৃদ্ধ বয়সে তারা করছেন কঠোর পরিশ্রম। যে বয়সে তাদের একটু বিশ্রাম প্রয়োজন সেই বয়সেই তারা ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে কাজে নেমেছেন রাস্তায়। সহিনা বেগম জানান, পরিচিত একজনকে কয়েকটি সংস্থা থেকে দেড় লাখ লোন তুলে দিয়েছিলেন। যাকে লোন তুলে দিয়েছিলেন, তিনি এলাকা ছেড়ে পালিয়েছেন। তাই সেই লোন তাদেরই শোধ করতে হচ্ছে। প্রতি মাসে পাঁচ হাজার টাকা কিস্তি দিতে হচ্ছে। কথা বলতে বলতে তারা এই সুযোগে একটু পান খেয়ে নিলেন। এমনিতেই তেমন একটা জিরিয়ে নেয়ার সুযোগ পান না। এদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা সবাই ক্ষুদ্র ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে শহরে এসে কঠোর পরিশ্রম করছেন। সকলের চেহারায় রয়েছে অনিশ্চয়তা আর দুশ্চিন্তার ছাপ। তারা চান এ অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়াতে। তারা চান একটু ভালভাবে বাঁচতে। এত পরিশ্রম করেন তারপরও ঠিকমতো বেতন পান না। অনেক সময় বেতন আটকিয়ে রাখে। কিন্তু ভয়ে কিছু বলতে পারেন না। প্রতি বছরই পয়লা মে শ্রমিক দিবস আসে যায় কিন্তু এসব শ্রমিকদের ভাগ্যেও উন্নতি হয় না। তারা এই দিবসেও অন্যান্য দিনের মতোই কাজ করেন। আপনারা কি এই দিবসটি সম্পর্কে জানেন? এমন প্রশ্নের জবাবে ছন্দা জানান, ‘দিবস টিবস দিয়ে কি হবে। কাজ না করলে তাদের দিন চলে না। আর এই সব দিবস তাদের কোন কাজে আসে না। তারা তিনজনই শ্রমিক দিবস সম্পর্কে কিছুই জানেন না। তারা চান-তাদের ভাগ্যের উন্নয়ন। তা যেভাবে হোক। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহম্মদ বলেন, ‘মাত্র ৪৩ ধরনের শ্রমিকের স্বীকৃতি আছে। অন্য কোন শ্রমিকের স্বীকৃতি নেই। তাদের স্বীকৃতি দেয়ার জন্য আমরা বারবার বলে আসছি। তবে সরকার এ বিষয়ে আলোচনা করতে চায় না।’ জাতীয় ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা করা হলে এরা সবাই স্বীকৃতি পেতেন। তাদের কাজের ধরন অনুযায়ী পরিচয়পত্র দেয়া যায়। ভারতে এ রকম শ্রমিকদের রেশন ব্যবস্থা করা হয়েছে। যারা অসুস্থ হলেও ভাতা পান। এদিকে মহান মে দিবসে সাংবাদিকদের উদ্দেশে শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু জানিয়েছেন, ‘শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন তহবিল থেকে সব ধরনের শ্রমিকদের সহযোগিতা দেয়া হবে। তিনি আরও বলেন, ‘সরকার শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন গঠন করেছে। বর্তমানে ফাউন্ডেশন তহবিলে ৩০০ কোটি টাকার মতো রয়েছে। ‘রিক্সাচালক হোক, কৃষি শ্রমিক হোক সব ধরনের শ্রমিকদের আমরা এই তহবিল থেকে সহযোগিতা দেব।’ প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘কর্মস্থলে কোন শ্রমিক মারা গেলে তার পরিবারকে ২ লাখ টাকা দেয়া হবে। এছাড়া শ্রমিকদের সন্তান মেডিক্যাল কলেজ, প্রকৌশল বা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলে তাদের ৩ লাখ টাকা দেয়া হবে। নারায়ণগঞ্জে শ্রমিকদের জন্য বিশেষায়িত হাসপাতাল নির্মাণ করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
×