ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

দৃষ্টিনন্দন বাহারি ফুল ফোয়ারা, বাগান ‘ভরসার বাতিঘর’

প্রকাশিত: ০৫:২০, ৩ মে ২০১৮

দৃষ্টিনন্দন বাহারি ফুল ফোয়ারা, বাগান ‘ভরসার বাতিঘর’

বাবুল হোসেন ॥ বদলে গেছে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ভেতর ও বাইরের চিত্র। ক্যাম্পাসে গড়ে তোলা হয়েছে বঙ্গবন্ধু উদ্যান। হাসপাতালের প্রধান ফটকে দৃষ্টিনন্দন ফোয়ারা। চারপাশে বাহারি রঙ্গিন ফুল আর ভেষজ বাগান এবং পামট্রির সারি শোভা পাচ্ছে। নেই পুঁতি দুর্গন্ধময় পরিবেশ। নিয়মিত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করায় বিরাজ করছে তকতকে পরিবেশ। ফলে সবখানে বিরাজ করছে প্রশান্তির ছায়া। রোগীদের চিকিৎসা সেবাদানের পাশাপাশি কিছুটা স্বস্তি দিতেই হাসপাতালে কর্তৃপক্ষের এই উদ্যোগ আর আয়োজন। ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাসির উদ্দিন আহমদ জনকণ্ঠকে জানান, কর্তব্যরত চিকিৎসক, নার্স ও কর্মকর্তা কর্মচারীদের একনিষ্ঠ প্রচেষ্টার ফলেই এসব সম্ভব হয়েছে। সর্বশেষ দেশে সরকারী হাসপাতালের মধ্যে প্রথম ময়মনসিংহ মেডিক্যালে জরুরী বিভাগে বহুল প্রত্যাশিত ২৪ ঘণ্টার ওয়ানস্টপ সার্ভিস চালু হাসপাতালে সেবাদান ও রোগীবান্ধব পরিচিতিকে আরও দৃশ্যমান করে তুলেছে। ইতোমধ্যে এর দৃশ্যমান সাফল্য দেখে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় দেশের সবকটি সরকারী হাসপাতালে ওয়ানস্টপ সার্ভিস চালুর নির্দেশনা দিয়েছে। অচিরেই হাসপাতালের করোনারি কেয়ার ইউনিট-সিসিইউতে ক্যাথল্যাব, কিডনি রোগীদের জন্য ডায়ালাইসিস মেশিন, রেডিওলজি বিভাগে সিটিস্ক্যান ও এমআরআই মেশিন স্থাপন হচ্ছে উল্লেখ করে হাসপাতাল পরিচালক আরও জানান, এসব হলে চিকিৎসা সেবায় ময়মনসিংহ মেডিক্যালের বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটবে। তবে এ জন্য প্রয়োজন সকলের আন্তরিক সহযোগিতা। ময়মনসিংহ নাগরিক আন্দোলনের ও জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি এ্যাডভোকেট আনিসুর রহমান খান জানান, হাসপাতালের সেবার মান অতীতের রেকর্ডভঙ্গ করেছে। যে কোন মূল্যে এটি ধরে রাখতে হবে। এক হাজার শয্যার ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ঢোকার পথেই প্রথমে নজর কাড়বে প্রধান ফটকের সামনে দৃষ্টিনন্দন ফোয়ারা। পুরনো ভবনের জরুরী বিভাগ এবং নয়া ভবনের সংযোগস্থলে স্থাপন করা এই ফোয়ারার শীতল জলরাশি রোগীদের মনে প্রতিনিয়ত প্রশান্তির যোগান দিচ্ছে। নয়া ভবনের সামনের বিশাল অংশ জুড়ে শোভা পাচ্ছে দুর্লভ শ্বেত কাঞ্চন ও নীলমণিলতাসহ কনকচাপা, টগর, ডালিয়া, কসমস, সূর্যমুখী, জবা, কৃষ্ণচূড়া, হাসনা হেনা, বাহারি গাদা গোলাপ, জিনিয়া, রঙ্গন, পাতা বাহারসহ নানা প্রজাতির রঙ্গিনসব ফুলের বাগান। প্রধান ফটক পেরিয়ে পুরনো ভবনে ঢোকার পথেও শোভা পাচ্ছে চোখ জুড়ানো রঙ্গিন বাহারি ফুলের বাগান। মেডিক্যাল কলেজ গেট পেরিয়ে হাসপাতালের পেছনের দিক থেকে পুরনো ভবনে ঢোকার পথেও থরে থরে সাজানো দেবদারু ও পামট্রির সারি আর অর্জুন, আমলকি, তুলসি, বেল, দারচিনি, নিম, চালতা, সাজনা, হরিতকির ভেষজ বাগান চোখে পড়বে। নিয়মিত পরিচর্যার কারণে এসব বাগান প্রাণ ফিরে পেয়েছে। সর্বশেষ হাসপাতালের পুবপাশে মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেল ও নার্সিং হোস্টেল এর মাঝখানে গড়ে তোলা হয়েছে বঙ্গবন্ধু উদ্যান। আর তাতে শিশু কিশোরদের বিনোদন ব্যবস্থার পাশাপাশি উদ্যানের ভেতর নানা প্রজাতির ফুলের চারা রোপণ করে মনোরম করা হয়েছে। রয়েছে উন্মুক্ত মঞ্চ, বসার পাকা বেঞ্চ। হাসপাতালের চারপাশের এমন দৃষ্টিনন্দন আয়োজন কেবল রোগীদের প্রশান্তির জন্য হলেও রোগীর স্বজন ও দর্শনার্থীরাও তাতে ভিড় জমাতে দেখা গেছে। ২০১৭ সালের নবেম্বর মাসে হাসপাতালের জরুরী বিভাগে চালু করা ২৪ ঘণ্টার ওয়ানস্টপ সার্ভিস রোগীদের দ্রুত সময়ে সেবাদান নিশ্চিত করার অনন্য মডেল। একই ভবন ও একই ছাদের নিচে নামমাত্র ফি মিলছে ইলেট্রো কার্ডিওগ্রাম-ইসিজি, আলট্রাসনোগ্রাফি, ডিজিটাল এক্সরেসহ জরুরী প্যাথলজি ল্যাবের পরীক্ষার সুবিধা। রয়েছে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের দিনে রাতের সেবাদান কার্যক্রম। জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ থেকে বুকের ব্যথা নিয়ে আসা রোগী মোফাজ্জল হোসেন (৪৮) জানান, ইসিজি আর রক্ত পরীক্ষার পর জানা গেল বুকের ব্যথার কারণ। রাতে পর্যবেক্ষণে রাখার পরদিন কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে ছুটি দিলে স্বজনদের নিয়ে হাসিমুখে ফিরে যান মোফাজ্জল। ইসিজির জন্য মাত্র ১০০ টাকা আর ট্রপোনিন-আই-রক্ত পরীক্ষার জন্য ৬০০ টাকা খরচ হয়েছে তার। হাসপাতালের বাইরে ইসিজি ৩০০ টাকা আর ট্রপোনিন-আই রক্ত পরীক্ষার ফি ১৫০০ টাকার কম নয় বলে জানায় স্থানীয় সূত্র। শেরপুর নকলা থানার নারায়ণখলা গ্রামের গৃহবধূ তাসরিন জাহান অপারেশনের মাধ্যমে সন্তান প্রসব করেন। এ জন্য তাসরিন জাহানের মাত্র ৫৬০ টাকার ওষুধ সামগ্রী কিনে দিতে হয়েছে। এমন অবিশ্বাস্য খরচে হতবাক তাসরিন জাহান ও তার স্বজনেরা। মারাত্মক শ্বাসকষ্টের সঙ্গে তীব্র বুকের ব্যথা নিয়ে আসা চরপাড়া কপিক্ষেত এলাকার ব্যবসায়ী আব্দুল খালেক জানান, করোনারি কেয়ার ইউনিট-সিসিইউতে জীবন রক্ষার ৪৭০০ টাকার দামী ইনজেকশন স্ট্রেপটোকাইনেজসহ সব ওষুধও মিলছে বিনা পয়সায়। ইউরোলজি, প্লাস্টিক ও বার্ন ইউনিট, পেডিয়াট্রিক সার্জারিতেও মিলছে বিনা পয়সার সব চিকিৎসা সেবা। এমনকী নিউরো সার্জারির ক্ষেত্রেও মিলছে বিনা পয়সার চিকিৎসা সেবা! হাসপাতালে নিউরো সার্জারি চালুর পর এ পর্যন্ত ২৬৫ জন রোগীর সার্জারি করা হয়েছে। নিউরো সার্জারি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডাঃ মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ জানান, সরকার ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সহযোগিতার কারণেই এটি সম্ভব হয়েছে। হাসপাতালের নিউনেটাল বিভাগে নব জাতকের জন্য আইসিইউ ইউনিট ও ব্রঙ্কোলাইজার মেশিনসহ অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতির মাধ্যমে অপরিণত শিশুদের জটিল সব রোগের চিকিৎসা সেবা দেয়া হচ্ছে। এতে বহু শিশুর প্রাণ রক্ষা পাওয়ায় কমেছে শিশু মৃত্যুর হার-এমন দাবি এই বিভাগের প্রধান ও মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডাঃ আনোয়ারে হোসেনের। ‘ভরসার বাতিঘর’ বলে পরিচিত হাসপাতালের এই বিভাগে রয়েছে নবজাতকের প্রাণ রক্ষার আধুনিক সব যন্ত্রপাতি। হাসপাতালের নানা জায়গায় ঝুলছে সরকারী বরাদ্দের শতভাগ ওষুধ প্রদানের ঘোষণা। এসব নানা কারণে এক হাজার শয্যার হাসপাতালে প্রতিদিন গড়পড়তায় ২৫০০ থেকে ২৭০০ রোগী ভর্তি থাকছে। এর বাইরে হাসপাতালের বর্হিবিভাগে ৫-৬ হাজার এবং জরুরী বিভাগ ও ওয়ানস্টপ সার্ভিসে আরও ৪০০/৫০০ রোগী চিকিৎসার জন্য ভিড় করছে। সব মিলিয়ে রোগী ও স্বজনসহ ২০ হাজারের বেশি মানুষ প্রতিনিয়ত অবস্থান করছে হাসপাতালে চিকিৎসা সেবার মান বাড়ার পাশাপাশি বিনামূল্যের ওষুধ ও অপারেশন হওয়ার কারণেই হাপসাতালে রোগীর চাপ বেড়েছে বলে মনে করছে সংশ্লিষ্টরা। এতে করে হাসপাতালের রাজস্ব আয়ও বেড়েছে বহুগুণ। গত ২০১২-১৩ অর্থবছরে সার্ভিস চার্জ থেকে রাজস্ব আয় ছিল মাত্র সাড়ে ৩ কোটি। গত ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে এই রাজস্ব আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে আট কোটি টাকার ওপরে। চলতি ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে এই আয় ১২ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। এমতাবস্থায় হাসপাতাল নির্ভর ব্যবসায়ী একটি স্বার্থান্বেষী মহল হাপসাতালের এই উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করতে নানামুখী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ দিকে বাড়তি রোগীর চাপ সামাল ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সার্ভিস চার্জের টাকায় নিয়োগ দেয়া হয়েছে প্রয়োজনীয় বেসরকারী জনবল ও আনসার।
×