ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বেলাল চৌধুরী ॥ শ্রদ্ধাভাজনেষু অগ্রজ - স্বদেশ রায়

প্রকাশিত: ০৪:৪০, ৩ মে ২০১৮

বেলাল চৌধুরী ॥ শ্রদ্ধাভাজনেষু অগ্রজ - স্বদেশ রায়

ঠিক কবে থেকে যে বেলাল ভাইয়ের স্নেহ পেতে শুরু করি তা এখন আর মনে নেই- যেমন মানুষের মনে থাকে না কবে সে প্রথম হাঁটতে শিখেছিল। মফস্বল শহর থেকে এই ঢাকা শহরে এসে হাঁটতে শিখেছি অনেকের হাত ধরে। সেই সব হাতের একটি বড় হাত বেলাল ভাইয়ের। জীবনের বন্ধু চিত্রা, একমাত্র ছেলে সবাই বেলাল ভাইয়ের স্নেহের। তাই বেলাল ভাইয়ের এই মৃত্যুটা আমাদের জন্য পারিবারিক আঘাত। বাস্তবতা হলো ঢাকা শহরে শুধু নয়, দেশে-বিদেশে বসবাস করেন এমন হাজার হাজার বাঙালী পরিবারের আপনজন ছিলেন বেলাল চৌধুরী। বেলাল ভাইয়ের মৃত্যু সংবাদের পরে কোলকাতার অনেক লেখকের ফেসবুকের স্ট্যাটাস দেখে মনে হয়েছে, তাঁরাও তাদের পরিবারের একজনকে হারালেন। সাংবাদিকরা কয়েকজনই ফোন করেছিলেন ধরা গলায়। অন্যদিকে বেলাল ভাইয়ের লাইফ সাপোর্ট যেদিন খুলে নেয়া হয় তার একদিন আগেই রাতে ডাক্তাররা বলেছিলেন, তাদের ডাক্তারি সায়েন্সের সাধ্যের বাইরে এখন বেলাল চৌধুুরী, এখন বাকিটুকু ঈশ্বরের হাতে। রাত এগারোটার দিকে এ খবর পাই বন্ধু রিমির কাছ থেকে। রিমি ফোন করে শুধু স্বদেশ দা বলেই কেঁদে দেন। তার কান্না শুনেই বুঝতে পারি কোন না কোন দুঃখের সংবাদ আমার জন্য অপেক্ষা করছে। কয়েক মিনিট কান্নার পরে রিমি নিজেকে সামলে নিয়ে বলেন, স্বদেশ দা, বেলাল ভাই আর নেই, ডাক্তাররা বলেছেন তিনি এখন তাদের সাধ্যের বাইরে। তারপরে বললেন, স্বদেশ দা আমার জীবনে বেলাল ভাই যা করেছেন, আমাকে যেভাবে সাহস জুগিয়েছেন, তা আর কেউ করেননি। তিনি সব সময় বলতেন, রিমি পারলে জীবনে একটা ইট গাঁথো। এমনিভাবে সমাজে কেউ কেউ যদি একটা ইট গেঁথে যায়, তাহলে একদিন ওই একটি একটি ইট মিলেই ইমারত হয়। রিমি বেলাল ভাইয়ের কথা রেখেছেন। তিনি তার এলাকার স্কুলগুলোতে শিক্ষায় একটা প্রাণ জাগিয়েছেন। তারপরে এখন এমপি। আর আমি মনে করি শেখ হাসিনা, মতিয়া চৌধুরী তাদের মতোই আর যে ক’জন সৎ এমপি আছেন রিমি তাদের একজন। তাই রিমি কান্নাজড়িত কণ্ঠে এই কথাসহ যখন বেলাল ভাইকে নিয়ে আরও অনেক কথা বলে এক পর্যায়ে ফোনটা রেখে দিলেন, তখন আমি চিত্রাকে সংবাদটি দেই। খবর পেয়ে চিত্রা নিশ্চুপ হয়ে বসে রইল তার রুমে। আমিও আমার স্টাডিরুমে এসে ইজিচেয়ারটিতে নিশ্চুপ বসে বসে বেলাল ভাইয়ের মুখটা ভাবতে থাকি। বার বার সেই নায়কের মতো চেহারা, চৌধুরী বংশের আভিজাত্য জড়ানো মুখখানা ভেসে উঠতে থাকে চোখের সামনে। মনে মনে আবারও ভাবি রিমি বেলাল ভাইয়ের নির্দেশ মতো অনেক কাজ করেছেন। তাজউদ্দীনের ওপর কাজ করেছেন, সমাজকর্ম, রাজনীতি ইত্যাদি। আমি তো বেলাল ভাইয়ের কথা রাখতে পারিনি। যখনই কথা হয়েছে অন্তত একবার তিনি বলেছেন, স্বদেশ তুই এই সাংবাদিকতা ছাড়। তোর হাত আছে, চোখ আছে- তুই অনেক বেশি দেখতে পাস, তাই গল্প, উপন্যাস, কবিতা লেখ। সবকিছু ছেড়ে ছুড়ে দিয়ে সাহিত্য নিয়ে থাক। বেলাল ভাইকে কোনদিন বলতে পারেনি, বেলাল ভাই, ছাত্র রাজনীতি করলেও জীবনে রাজনীতি নিয়ে কোন আকাক্সক্ষা আমার নেই। কেউ আমাকে কোনদিন রাজনীতিতে নিতে পারবে না। তাছাড়া রাজনীতিতে যেটুকু জড়িয়েছিলাম তা বঙ্গবন্ধু হত্যার আঘাত সহ্য করতে না পেরে। এখন তাঁর হত্যার বিচার হয়ে গেছে। এখন রাজনীতির প্রতি কোন মোহ নেই। আর শুধু সাহিত্য নিয়েই জীবন কাটাব এমনটা কৈশোরে ভেবেছিলাম কিন্তু সে ভাবনায় কেন আর এখন এগুতে পারি না, তা বেলাল ভাইকে কোনদিন বলতে পারিনি। কিছু কিছু কথা আছে যা শুধু অগ্রজকে বলা যায় না তা নয়, কাউকেই বলা যায় না- নিজের মধ্যেই সেটা থাকে। ১৯৯৬তে আমার উপন্যাস ‘মাছিমপুরের চৌরাস্তা’ বের হওয়ার পরে বেলাল ভাই একদিন বিটিভিতে (তখনও কোন বেসরকারী চ্যানেল সম্ভবত আসেনি) বললেন, তিনি ওই বছর তিনটি ভাল উপন্যাস পড়েছেন, পাকিস্তানের এক লেখকের একটি, আহমদ ছফা ভাইয়ের একটি ও আমার মাছিমপুরের চৌরাস্তার কথা বললেন। লজ্জায় বেলাল ভাইকে ফোন করে ধন্যবাদ জানাইনি। এ ছাড়া মনে মনে লজ্জিত হলাম, আমি তো বইটা বেলাল ভাইকে দেইনি। তিনি নিশ্চয়ই কিনেছেন। কয়েকদিন পরে বেলাল ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হতেই বেলাল ভাইয়ের আবার সেই তাগাদা, সাংবাদিকতা ছাড়, সময় নষ্ট করিসনে, সৃষ্টিশীল কিছু কর, তোর হাত আছে। গাজী ভাই বললেন, ও তো সাংবাদিকতায় ভাল করছে। ছাড়বে কেন? বেলাল ভাই তারপরে অনেক কথা বললেন। রক্তের সম্পর্কের ছোট ভাইয়ের জন্যও মনে হয় অমন করে বলে না কেউ। মাথা নিচু করে সব কথা শুনলাম। তবুও রিমির মতো বেলাল ভাইয়ের কথা রাখতে পারিনি। বেলাল ভাইয়ের মৃত্যুর পরে ইজিচেয়ারে চোখ মুদে তার মুখখানা দেখতে দেখতে ভাবছিলাম, খুব ছোটবেলায় বেলাল ভাইকেও মনে হয় ঈশ্বর বিশ্ব নিখিল লিখে দিয়েছিল দুই বিঘার পরিবর্তে। তাই সবাইকে তিনি এভাবে নিজের ভাই-বোনের মতোই শুধু ভাল বাসতেন না, তারা তার মনমতো হোক এটাই চাইতেন। যেমন আমার অন্য একটি উপন্যাসের (মুনিয়া চোখ) ক্ষেত্রে। এ ক্ষেত্রে অবশ্য শুধু বেলাল ভাই নয়, রিমিও বার বার বলেছেন, ওটা ইংরেজীতে অনুবাদ করতে। ওর বড় বোন রিপি নিজে অনুবাদ করার অনুমতিও চেয়েছিলেন। যা হোক, বেলাল ভাইকে তখন নানা সমস্যার কথা বলে ফাঁকি দিতে চাইতাম। বেলাল ভাই জীবনে কখনও কোন সমস্যার কথা শুনতেন না। তিনি কোন কিছুকে সমস্যা মনে করতেন না। আর শেষ পর্যন্ত আমরাও তাঁর কাছ থেকে শিখি- জীবনে সমস্যা বলে কিছু নেই। যা কিছু আসে জীবনে- সবই পার্ট অব লাইফ। বেলাল ভাই সুধীজনের সঙ্গে মিশতেন। সকলেই ছিলেন তাঁর আপনজন। তবে সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাঁর মিশতে পারার ক্ষমতা ছিল অসাধারণ। গাজী শাহাবুদ্দিন ভাইয়ের সঙ্গে বেলাল ভাইসহ আমরা ঢাকার আশপাশে নানা জায়গায় যেতাম। সেখানে কাঁচাবাজার থাকলে নেমে বাজার করতাম। আর কখনও কখনও গ্রামীণ ওই সব হোটেল-রেস্টুরেন্টে খেতাম। এসব জায়গায় বেলাল ভাই যে কত দ্রুত সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে যেতেন আর তাদের জীবনের গল্প পেট থেকে বের করে নিয়ে আসতেন- সে এক জাদুকরী ক্ষমতা ছিল বেলাল ভাইয়ের। মনে হয় এই জাদুকরী ক্ষমতার কারণে বেলাল চৌধুরী ও শক্তি চট্টোপাধ্যায় ভারতের নানা প্রান্ত ঘুরে অমন চমৎকার সব ফিচার লিখতে পেরেছিলেন। আসলে বেলাল ভাই চলে যাওয়ার পরে গত কয়েকদিনে মনে হচ্ছে বেলাল ভাই যে আমাদের মতো সাধারণদের সাহিত্যচর্চা করার জন্য এত তাগিদ দিতেন, তা মনে হয় তার নিজের অপূর্ণতা থেকে। কারণ জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার পরিধিতে বেলাল ভাই ছিলেন সমুদ্র। কিন্তু কৈশোর থেকে বোহেমিয়ান জীবন আর নানা উত্থান পতনের কারণে বেলাল ভাইয়ের হাত দিয়ে বাংলা সাহিত্য যে পরিমাণ পেতে পারত, তার খুব সামান্যই দিয়ে গেছেন তিনি। বাস্তবে আমাদের দেশে যদি কোন বরোদার রাজা থাকত বা বেলাল ভাইয়ের জন্ম যে ত্রিপুরা রাজ্যে, ওই ত্রিপুরার রাজা থাকতেন- যিনি অকাতরে রবীন্দ্রনাথকে সাহায্য করেছেন- তাদের কেউ যদি বেলাল চৌধুরীর ভার নিতেন- বাংলা সাহিত্যের মধুভান্ডে কলসি ভরে ভরে মধু ঢালতে পারতেন বেলাল চৌধুরী। লেখক নয়, পাঠক হিসেবে তো অন্তত বুঝি, বেলাল চৌধুরীর গদ্যের গাঁথুনির কাছে আমাদের গদ্য কোন গদ্যই নয়। তাই আক্তারুজ্জামান ইলিয়াস, শওকত আলী, সৈয়দ শামসুল হক বাংলা সাহিত্যের উপন্যাস ভান্ডার যতটুকু পূরণ করেছেন তাদের থেকে হয়ত বেশি পূরণ করতে পারতেন বেলাল চৌধুরী। কিন্তু সংসার, সমাজ জীবনের টানাপোড়েন তাকে সে সময় ও সুযোগ দেয়নি। তা ছাড়া বেলাল ভাইয়ের সঙ্গে বিভিন্ন দিনে নানা বিষয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প করে মনে হয়েছে, রাজশেখর বসু (পরশুরাম), সৈয়দ মুজতবা আলী- তাঁরা যেমন বাংলা সাহিত্য ভান্ডারে কিছু নতুন ডায়মন্ড খন্ড দিয়ে গেছেন, সে ক্ষমতা তাঁদের উত্তরসূরি বেলাল চৌধুরীর ছিল। কিন্তু জাগতিক টানাপোড়েন তাঁকে সেটা দিতে দেয়নি। এই অসম্পূর্ণতার যন্ত্রণা থেকে তিনি তাঁর উত্তর প্রজন্মকে বার বার চাবুক মারতেন, তারা যেন তাদের সঠিক কাজটি করে। বেলাল ভাই আপনার কথা মনে পড়তেই দুই চোখ জলে ভরে ওঠে! আপনার সেই শাসন, আদর, আপনার সেই হাতের পরশ, নিজ হাতে খাবার তুলে দেয়া- এসব কিছুই আর পাব না। ফোনের ওপার থেকে আপনার কণ্ঠ আর শুনতে পাব না কোনদিন। জানি, পৃথিবীর এটাই নিয়ম। তার পরেও নিয়ম মানতে বড় কষ্ট হয় মাঝে মাঝে। আপনার মরদেহের ওপর অশ্রুসজল আনিস স্যারকে অনেকটা ঝুঁকে থাকতে দেখে চোখের জল রাখতে পারেনি অনেকেই। বেলাল ভাই, মানুষের সঙ্গে, ছোটদের সঙ্গে কত ভাল ব্যবহার করতে হয়, তা আপনাকে দেখে শেখার চেষ্টা করেছি। পারিনি হয়ত। আপনার কাছে ক্ষমা চেয়ে আপনাকে ছোট করব না। হয়ত পারব না আপনার মতো মানুষের মাঝে, পরবর্তী প্রজন্মের মাঝে নিজেকে বিলিয়ে দিতে- কারণ আপনি যা অর্জন করেছিলেন দীর্ঘ চলমান জীবন দিয়ে, সে অর্জন আমরা করতে পারিনি। তার পরেও বলব, পিতা-মাতার হাত ছাড়ার পরে যাদের হাত ধরে মানুষ হতে শিখেছি, বেলাল ভাই আপনি আমাদের সেই বড় ভাই শুধু নন, শিক্ষাগুরুও ছিলেন। আপনি বেঁচে থাকবেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। আপনি কবি, লেখক, সাংবাদিক- তার পরেও ছিলেন সকলের বেলাল ভাই। [email protected]
×