ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বিশ্বের সবচেয়ে বড়, প্রভাবশালী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক এখন ঝড়ের মোকাবেলা করছে। এতদিন সামনে ছিল ‘ক্যামব্রিজ এ্যানালাইটিকার’ তথ্য ফাঁস, কিন্তু অন্তরালের চিত্রটি সামনে আসায় পরিস্থিতি ভিন্ন ইঙ্গিত দিচ্ছে। মূলত ২০১৬তে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভূমিকার

জাকারবার্গ, হার্টস ও মার্ক টোয়েন

প্রকাশিত: ০৬:৩৯, ১ মে ২০১৮

জাকারবার্গ, হার্টস ও মার্ক টোয়েন

মার্কিন অর্থনীতিতে খুব বেশি সফল ব্যবসায়ীরা কোন না কোন সময় নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার মুখে পড়েছেন। ইতিহাস এই সাক্ষ্যই দেয়। জন ডি. রকফেলার, এ্যান্ড্রু কার্নেগি, জে. পি. মর্গানের মতো ব্যক্তিত্বদেরও সাফল্যের মূল্য দিতে হয়েছে। সংশোধনের প্রতিশ্রুতি, রাজনৈতিক লবিং অথবা দাতব্য কর্ম কোন কিছুতেই তারা রক্ষা পাননি এই নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার ছোবল থেকে। স্ট্যান্ডার্ড ওয়েল নিয়ে মার্কিন শিল্প সম্প্রসারণে রকফেলারের অসামান্য অবদান সত্ত্বেও, ব্যবসায়িক অপকৌশলের কারণে তাকেও সইতে হয়েছে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার ধাক্কা। স্ক্যান্ডাল খুঁজে বেড়ানো অনুসন্ধানী সংবাদিকরা উন্মোচন করেন তার ব্যবসায়িক অপতৎপরতা, ইডা ট্র্যাবেলস তো তার ‘দ্য হিস্ট্রি অব দ্য স্ট্যান্ডার্ড অয়েল কোম্পানি’-তে রীতিমতো ধুয়ে দেন রকফেলারকে। জনমনে জ্বলে ওঠে ঘৃণার আগুন। ১৯১১-তে রকফেলারের স্ট্যান্ডার্ড অয়েল কোঃ অব নিউ জার্সি বনাম ইউনাইটেড স্টেটস মামলায় এক যুগান্তকারী রায়ে; মার্কিন সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতি লুইস ডি. ব্র্যান্ডিস ‘এ্যান্টিট্রাস্ট’কে বলেছিলেনÑ বড় হওয়ার অভিশাপ। বর্তমান অবস্থায় ফেসবুকসহ অন্যান্য ছোট-বড় টেক কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে সহজেই ‘এন্টিট্রাস্টে’ ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব। কোম্পানিগুলোর একচেটিয়া মনোপলি নিয়েও প্রশ্নের অবকাশ আছে। বিনে পয়সায় ব্যবহার করা যায় বিধায় ফেসবুক ব্যবহারকারীরা বিষয়টি অপছন্দ করলেও, এটাই সত্য। এ মুহূর্তে ফেসবুকের সামনে সবচেয়ে বড় শঙ্কার বিষয় হলো জাকারবার্গের করা দাবি। জাকারবার্গ বলছেন ফেসবুক একটি টেকনোলজি কোম্পানি। এটি কোনভাবেই কনটেন্ট পাবলিশার নয়। তার ভাষায় ফেসবুকের নিউজ ফিড এলগরিদমে সামান্য আঁচড়ের মাধ্যমেই বর্তমান সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। এ জন্য তিনি দশ হাজার ‘কনটেন্ট মডারেটর’ নিয়োগ করতে প্রস্তুত। তার এই বক্তব্য বাস্তবের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। গত শতাব্দীর নব্বই দশকের মাঝামাঝি আনীত একটি আইনগত সংশোধনীর কারণে জাকারবার্গের এই দাবি অবশ্যই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। এমন যখন অবস্থা, জাকারবার্গের সামনে সবচেয়ে বড় উদাহরণ হতে পারে, উইলিয়াম র‌্যানডলফ হার্টস ও তার সংবাদপত্র সংস্থার পরিণতি। রাহুগ্রস্ত ফেসবুক বর্তমানে মার্কিন ইতিহাসের সবচেয়ে বড় কনটেন্ট পাবলিশার। জাকারবার্গ এ মুহূর্তে হার্টসের পরিণতি বিবেচনায় নিলে ভাল করবেন। হার্ভার্ড বহিষ্কৃত হার্টস, ১৮৮৭তে বিত্তবান পিতার কাছ থেকে উপহার হিসেবে পান সানফ্রান্সিসকো এক্সামিনার। পিতা আবার সেটির মালিকানা পেয়েছিলেন বাজিতে জিতে। হার্টস যেমন উন্নতমানের ছাপার জন্য বিনিয়োগ করেন, তেমনি মার্ক টোয়েনের মতো লেখকদের নিয়োগ দেন সেরা হওয়ার লক্ষ্য নিয়ে। ১৮৯৪তে হার্টস কিনে নেন দ্য নিউইয়র্ক জার্নাল। পাল্লা দিতে শুরু করেন জোসেফ পুলিৎজারসহ অন্যান্য ১৬টি দৈনিক পত্রিকার সঙ্গে। আমেরিকার প্রতিটি বড় শহরকেন্দ্রিক ৪২টি সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠা করেন। ম্যাগাজিন প্রকাশনাসহ চালু করেন রেডিও সার্ভিস। সাফল্যের সর্বোচ্চ শিখর ১৯৩০-এ তাদের গ্রাহক সংখ্যা ছিল ২ কোটি। অনুপাতটা প্রতি ৪ জন আমেরিকানে একজন । ক্রমবর্ধমান প্রভাব নিয়ে হার্টস চলে আসেন ক্ষমতার কেন্দ্রে। ব্যস্ত হয়ে পড়েন রাজনৈতিক প্রচারণায়। ১৮৯০-এ হার্টস সমর্থন করেন পপুলিস্ট ডেমোক্র্যাটিক প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ইউলিয়াম জেনিংস ব্রায়ানকে। জনৈক নৈরাজ্যবাদীর হাতে প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম ম্যাককেনলি হত্যার পেছনে তার জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে ১৯০১-এ। ‘দ্য জার্নাল ওয়ার’ নামে খ্যাত ‘স্প্যানিশ-আমেরিকান ওয়ার’-এ হার্টসের ভূমিকা তো আজ ইতিহাস। সে যুদ্ধে পরিবেশিত মিথ্যা সংবাদ যা আজ পরিচিত ইয়েলো জার্নালিজম নামে, হয়ে দাঁড়ায় বড় ধরণের রাজনৈতিক ইস্যু। অনেকেই ফেসবুকের বর্তমান ভূমিকার পেছনে জাকারবার্গের হার্ভার্ডে থাকাকালীন রাজনৈতিক স্বপ্নের যোগ দেখছেন যা ছিল হাটর্সেরও। তিনি ১১তম নিউইয়র্ক ডিস্ট্রিকের প্রতিনিধি ছিলেন দু’বার। হাউস ছেড়ে আসেন নিউইয়র্কের গবর্নর হওয়ার স্বপ্নে। দু’বার মেয়র হওয়ার ব্যর্থ চেষ্টার পাশাপাশি ১৯০৪-এর ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থী হিসেবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মনোনয়ন দৌড়ে ব্যর্থ। হার্টস যত বেশি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন তার ব্যবসায়িক পরিস্থিতি তত খারাপের দিকে যেতে থাকে। ১৯২০-এ বিশাল বিনিয়োগ করেন আবাসন ও চিত্র শিল্পে । ১৯২৯-এ মার্কিন অর্থনীতিতে ধসের পর যে সিদ্ধান্ত হার্টসের জন্য বড় বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। কোম্পানির নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন ১৯৩৭-এ। শেষ জীবনে তাকে জীবনযাত্রার ব্যয় নির্বাহে রাশ টানতে হয়েছে। যার বেশির ভাগটাই ব্যয় হতো সেইন্ট সিমিওনে বা বেভারলি হিলসে তার রাজকীয় প্রাসাদের পেছনে। হার্টস ফাউন্ডেশন তার প্রতিষ্ঠাতাকে ত্যাগ করলেও ১৯৪১-এ ‘সিটিজেন কেইন’ সিনেমা তার জীবনের গল্পকে দেয় অমরত্ব। হার্টসের পত্রিকায় নিয়োগকৃত মার্ক টোয়েন কিন্তু কখনই বলেননি, ‘History doesnt repeat itself, but it does rhyme. তাঁর মতে History never repeats itself, but the Kaleidoscopic combinations of the pictured present often seem to be constructed out of the broken fragments of antique legends.’ বর্তমান অবস্থায় ফেসবুক মার্ক টোয়েসের বর্ণিত ক্যালিডোস্কোপ ব্যবহার করে দেখতে পারে। উইলিয়াম র‌্যানডলফ হার্টসের জীবন নিয়ে নির্মিত ‘সিটিজেন কেইন’ আমাদের এমন এক প্রতিভাবানের গল্প বলে, সাফল্য এবং ক্ষমতা যাকে ছিটকে দিয়েছিল বাস্তবতা থেকে দূরে। সিটিজেন জাকারবার্গের হয়ত বিষয়টি পছন্দ হবে না তবুও তিনি সিনেমাটি দেখতে পারেন। তার জন্য ভাবনার খোরাক আছে নিশ্চিত।
×