ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ‘দুর্বার’ আরিফ

প্রকাশিত: ০৬:৩৭, ১ মে ২০১৮

মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ‘দুর্বার’ আরিফ

ডিপ্রজন্ম : দুর্বার নাম কেন বেছে নেয়া? আরিফ চৌধুরী : ‘দুর্বার’ নামের অর্থ অপ্রতিরোধ্য। দুর্বারের হয়ে এখন পর্যন্ত যত কাজ আমরা হাতে নিয়েছি সব বাধাবিপত্তি পেরিয়ে সফলও হয়েছি। আমি দুর্বার, আমি ভেঙ্গে করি সব চুরমার! নজরুলের বিদ্রোহী কবিতার দুর্বার শব্দটি আমার প্রিয় ছিল। দুর্বার শব্দটি আমাদের সকল কাজের সাহস যোগায়। ডিপ্রজন্ম : জেলাশহরে যখন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন কমছে, প্রেক্ষাপটে আপনাদের কাজগুলো বেশ প্রশংসনীয়। কিভাবে দেখছেন- আরিফ চৌধুরী : মানুষ দিন দিন আত্মকেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছে। প্রতিযোগিতার এই যুগে তরুণরা এসব কাজ করা আসলেই কমিয়ে দিচ্ছে, মানবসেবা করাটাও দিন দিন অনেকের কাছে মূল্য হারিয়ে ফেলছে। তার পরও তরুণ সমাজ প্রত্যেকটা সমাজ, সম্প্রদায় তথা দেশের উন্নয়নে সবচেয়ে কার্যকরী ভূমিকা রাখে। পৃথিবীর সব এগিয়ে যাওয়ার গল্পে, সব আলোকিত জীবনের গল্পের সূচনা বা সবচেয়ে বড় অবদানটা কিন্তু কোন না কোনভাবে তরুণদের সঙ্গে সম্পর্কিত। তেমনি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ তরুণ সমাজ। দেশের আনাচে কানাচে তরুণরা বিভিন্নভাবে নিজেদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক কর্মকা-ে সম্পৃক্ত করছে প্রতিনিয়ত। অনেকেই সৃজনশীল উদ্ভাবনীর মাধ্যমে এগিয়ে নিচ্ছে দেশ ও সমাজকে। নারী নির্যাতন, মাদক প্রতিরোধ, শিশুশ্রম বন্ধ ও সামাজিক সহিংসতা নিরসনে কাজ করছে আরও অনেকেই। এগুলোকে সাংগঠনিক রূপদানের মাধ্যমে কার্যপরিধি ও সফলতার হার আরও বৃদ্ধি পাবে বলে আমি মনে করি। দুর্বার ফাউন্ডেশনের শুরুর দিন তখন রোজা ২৫ চলছিল, সে সময় সবাই ব্যস্ত ছিল ঈদের কেনাকাটা নিয়ে। আর আমরা ১১ জন ছিলাম অসহায় রোজদারদের ইফতার বিতরণ নিয়ে। আমরা চেষ্টা করছি তরুণদের দেশের সেবায় উৎসাহী করতে। নতুন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বৃদ্ধিতেও আমরা উৎসাহ প্রদান করে থাকি। ডিপ্রজন্ম : দুর্বার স্কুলের কথা জানতে চাই। আরিফ চৌধুরী : কুমিল্লা শহরে পথশিশুদের মাঝে মাদকের প্রবণতাটা বেড়ে যায়। যা আমরা প্রায় শতভাগ হ্রাস করতে সক্ষম হয়েছি। মাদক নির্মূল নিয়ে কাজ করতে গিয়ে উপলব্ধি করলাম যেসব বাচ্চার অভিভাবক নেই তাদের দেখাশোনা আমাদের করা উচিত। একমাত্র পড়াশোনাই পারে তাদের মাদক থেকে দূরে রাখতে। কুমিল্লাতে সবচেয়ে বেশি পথশিশু অবস্থান করে রেলওয়ে স্টেশনগুলোতে। তাই, দুর্বার স্কুল প্রতিষ্ঠা করি কুমিল্লা রেলওয়ে স্টেশনে এবং লাকসাম রেলওয়ে জংশনে। দুর্বার ফাউন্ডেশন যে সব কাজ করে যাচ্ছে তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ‘দুর্বার স্কুল’ যার মূল লক্ষ্য ‘পথশিশু মুক্ত দুর্বার বাংলাদেশ গড়া।’ পিছিয়ে পড়া পথশিশুদের সমাজ উপযোগী করে গড়ে তোলা। দুর্বার স্কুলের দুটি শাখা মিলিয়ে ১৫০ জনের অধিক বাচ্চাদের মৌলিক মানবিক চাহিদা পূরণে সব সময়ই সচেষ্ট দুর্বার ফাউন্ডেশন পরিচালিত দুর্বার স্কুল। বাচ্চাদের নিয়মিত পাঠদান, সাধ্যানুযায়ী তাদের খাদ্য চাহিদা পূরণ করা। বিভিন্ন উৎসবসহ সর্বদা তাদের পোশাকের চাহিদা পূরণ করা। যে কোন সময় অসুস্থ হয়ে পড়লে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। প্রতিবছর জাতীয় দিবস ও বিভিন্ন উৎসবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা। নিজের জন্মদিনসহ বিশেষ দিনগুলো তাদের সঙ্গেই কাটানো হয় আমাদের। এ ছাড়াও তাদের নিয়ে আমরা নানাবিধ কর্মসূচী গ্রহণ করে থাকি। ডিপ্রজন্ম : দুর্বার স্কুল ছাড়াও আপনারা আর কি কি কাজ করে থাকেন? আরিফ চৌধুরী : মুমূর্ষু রোগীকে নিয়মিত রক্তদান, প্রতিদিন সারা বাংলাদেশে কমপক্ষে ৩০ জনকে রক্ত দানের ব্যবস্থা করে দেই। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রক্তের গ্রুপ নির্ণয় কর্মসূচী গ্রহণ করি। কুমিল্লা জেলায় সীমান্তবর্তী এলাকায় মাদক নির্মূলে সচেষ্ট, সচেতনতা ও প্রশাসনের সহযোগিতা নিয়ে নিয়মিত বাল্যবিবাহ বন্ধ করে যাচ্ছি, বিভিন্ন অঞ্চলে গাছের চারা বিতরণ ও বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষা করছি। বর্তমানে সবচেয়ে বড় সমস্যা ফেসবুক বা আইসিটির অপব্যবহার রোধে আমরা কার্যকরী ভূমিকা পালন করে যাচ্ছি। দুর্বারের ১৭০০ অধিক স্বেচ্ছাসেবী প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এসব স্বেচ্ছাসেবী কার্যক্রম নিয়মিত অব্যাহত রাখছে। ডিপ্রজন্ম : নিজের সম্পর্কে কিছু বলুন। আরিফ চৌধুরী : কুমিল্লা জেলার একটি সীমান্তবর্তী গ্রামেই আমার জন্ম। পড়াশোনার পাশাপাশি এসব সেবামূলক কাজের নেশা ছোটবেলা থেকেই। আমার মা বাবা দু’জনই মুক্তিযোদ্ধা তাই সেই অনুপ্রেরণা নিয়ে ছোটবেলা থেকেই দেশের জন্য কিছু না কিছু করার নেশা ছিল। দেশের জন্য কি করতে পারলাম, এসব প্রশ্নের উত্তরের খোঁজেই এসব কাজ করা। দুর্বার নিয়ে কাজ করতে করতে এখন সবাই আমাকে ‘দুর্বার’ নামেই ডাকেন। ডিপ্রজন্ম : জয়বাংলা ইয়ুথ এ্যাওয়ার্ড প্রাপ্তির গল্পটা...। আরিফ চৌধুরী : আসলে কাজ করেই যাচ্ছিলাম। এ্যাওয়ার্ডের বিষয়টা ছিল না। সব সময় ভেবে যাচ্ছি আমাদের লক্ষ্য পূরণই আমাদের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।এটা কল্পনাশক্তির বাইরে ছিল যে, বাংলাদেশের তরুণদের সর্বোচ্চ জাতীয় সম্মাননা ‘জয় বাংলা ইয়ুথ এ্যাওয়ার্ড ’ দেশ সেরা হয়ে গ্রহণ করব। যখন প্রথম শুনলাম দুর্বার ফাউন্ডেশন এ্যাওয়ার্ডের জন্য মনোনীত হয়েছে সে সময় খুশিতে আত্মহারা হয়েছিলাম। আমরা সকল দুর্বার স্বেচ্ছাসেবী অনেক আনন্দ করেছিলাম সেদিন। এ্যাওয়ার্ড প্রদানকালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আইসিটি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় আমাদের কাজের প্রশংসা করে আমাদের উৎসাহিত করেছেন। এ্যাওয়ার্ড নিয়ে যখন কুমিল্লায় ফিরি তখন সর্বস্তরে আমাদের সংবর্ধিত করা হয়েছিল। কুমিল্লার মুখ উজ্জ্বল করতে পেরে আমাদেরও খুব আনন্দ হচ্ছিল। সময়গুলো জীবনের সর্বোত্তম সময় ছিল। কুমিল্লা অঞ্চলসহ সারা বাংলাদেশে একটি জনপ্রিয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন হিসেবে রূপলাভ করে দুর্বার। এই এ্যাওয়ার্ড আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছানোর পথ সহজ করে দিয়েছে। আমাদের এতবড় স্বীকৃতি দেয়ার জন্য কৃতজ্ঞতা জানাই সিআরআই ও ইয়াং বাংলার প্রতি। এ্যাওয়ার্ডটি আমাদের কাজগুলোকে সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করেছে। সারা বাংলাদেশে ভাল একটি নেটওয়ার্ক সৃষ্টিতে সহযোগিতা করেছে। ডিপ্রজন্ম : ভবিষ্যত পরিকল্পনা। দুর্বার ভাবনা। আরিফ চৌধুরী : আমাদের লক্ষ্য ‘পথশিশুমুক্ত, মাদকমুক্ত, বাল্যবিবাহমুক্ত দুর্বার বাংলাদেশ গড়া।’ পথশিশুদের নিয়ে আমাদের স্থায়ী বাসস্থানসহ স্কুল করার ইচ্ছে। ইচ্ছে আছে অনেক কিছু করার কিন্তু সাধ্য সীমিত। তাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিনীত চাওয়া, সারা বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় যাতে কমপক্ষে একটি করে হলেও পথশিশুদের আবাসস্থল করে দেন। যেখানে পথশিশুরা তাদের সকল মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে পারবে। দুর্বার ভাবনা বিশালাকার, দেশে লক্ষ্য অর্জনের পর আমাদের সংগঠনকে আন্তর্জাতিক রূপ দেয়ার ইচ্ছে আছে। যেখান থেকে সারাবিশ্বে পথশিশু বা পিছিয়ে পড়া মানুষ আছে তাদের সহযোগিতা করা হবে। বাংলাদেশকে রক্ষা করতে সারাবিশ্বে পরিবেশ বিপর্যয়রোধে আমরা ভূমিকা রাখতে চাই।
×