ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

নিম্নমানের নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার

বাঘারপাড়ায় আশ্রয়ণ প্রকল্পে দুর্নীতি

প্রকাশিত: ০৪:০৯, ১ মে ২০১৮

বাঘারপাড়ায় আশ্রয়ণ প্রকল্পে দুর্নীতি

স্টাফ রিপোর্টার, যশোর অফিস ॥ বাঘারপাড়ায় প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। প্রকল্পের প্রায় ১শ’ কোটি ৩২ লাখ টাকার অধিকাংশই লুটপাট হয়েছে। এ দুর্নীতি তদন্তে ইতিমধ্যে খুলনা বিভাগীয় কমিশনার জেলা প্রশাসনকে দায়িত্ব দিয়েছে। তদন্তে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) হুসাইন শওকত মাঠে নেমেছেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের প্রকল্প উপ-পরিচালক এসএম হামিদুল হক জানিয়েছেন, এ ব্যাপারে সত্যতা পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। ১৯৯৭ সালের ১৯ মে কক্সবাজার জেলাসহ পার্শ্ববর্তী এলাকা ঘূর্ণিঝড়ে আক্রান্ত হওয়ায় বহু পরিবার গৃহহীন হয়ে পড়ে। ওই সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উক্ত এলাকা পরিদর্শনে যান। তিনি মানুষের দুঃখ-দুর্দশা দেখে অত্যন্ত সহানভূতিশীল হয়ে গৃহহীন পরিবারসমূহকে পুনর্বাসনের তাৎক্ষণিক নির্দেশ দেন। সেই থেকে বর্তমান সরকার বিভিন্ন ধাপে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করে আসছে। এই প্রকল্পের আওতায় বাঘারপাড়ার হতদরিদ্রদের জন্যও কাজ শুরু হয়। উপজেলার ১৩২টি পরিবারকে আওতায় আনা হয়। যার সার্বিক দায়িত্ব পান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাহনাজ বেগম। অথচ তিনি ওই গৃহ নির্মাণ প্রকল্পের ১শ’৩২টি গৃহ নির্মাণে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। এতে অতি নিম্নমানের নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রতিটি ঘর নির্মাণে খরচ হওয়ার কথা ১ লাখ টাকা। অভিযোগ উঠেছে ১৩২টি ঘর নির্মাণে, প্লান, ডিজাইন অনুযায়ী করা হয়নি। নীতিমালা অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী অফিসারের তত্ত্বাবধানে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) দ্বারা সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে (ডিপিএম) এ ঘরগুলো নির্মাণের কথা থাকলেও প্রকল্পের নক্সা ডিজাইন ও প্রাক্কলনের কথা চিন্তা না করে গৃহহীন মানুষের অর্থ আত্মসাৎ করে নি¤œমানের নির্মাণ সামগ্রী দিয়ে ঘর তৈরি হয়েছে। নির্মাণ কাজের সঙ্গে শ্রমিক হিসেবে উপকারভোগী পরিবারকে রাখার নির্দেশ থাকলেও তা মানা হয়নি। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে আহ্বায়ক করে পাঁচ সদস্যের (পিআইসি) কমিটি করা হলেও তা কাগজ-কলমে সীমাবদ্ধ, বাস্তবে নয়। অভিযোগ রয়েছে প্রতিটি উপকারভোগীর কাছ থেকে মালামাল সরবরাহ বাবদ খরচ নিয়েছেন উপজেলা নির্বাহী অফিসের অফিস সহকারী আসাদুজ্জামান। আসাদুজ্জামানের বাড়িতে ঘর নির্মাণের মালামাল রেখে তা নেয়ার সময় উপকারভোগীদের পরিবহন খরচ দিতে বাধ্য করা হয়েছে। দেখা গেছে বাঘারপাড়ার নারকেলবাড়িয়া ইউনিয়নের অন্তারামপুর, আজমপুর, রায়পুর ইউনিয়নের শালবরাট গ্রামে এ অনিয়ম ও অর্থ আত্মসাতের সত্যতা পাওয়া গেছে। প্রতি বান্ডিল টিনে ব্যয় কমানো হচ্ছে ১ হাজার থেকে ১২ শ’ টাকা। যার মোট পরিমাণ ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা। প্রতিটি ঘরে আট শ’ ইট দেয়া হয়েছে। এ ইটের মান নিয়ে অধিকাংশ উপকারভোগী অভিযোগ দিয়েছেন। এক নম্বর ইটের বদলে দেয়া হয়েছে দুই নম্বর ইট। যা ১৫ শ’ থেকে ১৬ শ’ টাকা কম পেয়েছে প্রতিটি পরিবার। ঘরের নক্সায় ঢালাই দেয়ার কথা থাকলেও কোন ঘরেই তা দেয়া হয়নি। মেঝে ও পিলারে ব্যবহার হয়েছে একেবারেই নিম্নমানের খোয়া। ঘর নির্মাণের সময় শ্রমিকদের দুপুরে খাবারও দিতে হয়েছে উপকারভোগীকে। যা তাদের দেয়ার কথা ছিল না। তার কাঁটা, পেরেক, তার, কব্জা, ছিটকিনি, স্ক্রুর, ওয়াশার, মেঝের রং এসব কিছুই কিনে দিতে হয়েছে উপকারভোগীদের। ২শ’ ৭৫ বর্গ ফুটের এ ঘরে দশমিক ৩৬ এমএম টিন দেয়ার কথা থাকলেও দেয়া হয়েছে দশমিক ৩২ এমএম টিন। তাও আবার নিম্নমানের। এখানেই শেষ নয়, এ কাজে প্রতি ১শ’ বর্গফুট খোয়ায় চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা বাচানো হয়েছে। মেঝেতে ঢালাইয়ের নিচে পলিথিন দেয়ার কথা থাকলেও তা নেয়া হয়েছে উপকারভোগীর কাছ থেকে। পিলারের অগ্রভাগে সিআইজি শিটের প্লেট, নাট-বোল্ট ব্যবহারের কথা থাকলেও তা ব্যবহার হয়নি। ১৭টি পিলারের স্থলে দেয়া হয়েছে ১৬টি। ৪টি করে রডের বদলে দিয়েছে ৩টি। ৬টি জানালার বদলে ২টি দেয়া হয়েছে। দরজায় রং করার নিয়ম থাকলেও তা লাগেনি। ঘরের বেড়া ও চালে কাঠ ব্যবহারে তালিকায় ছিল শাল, গর্জন, জারুল, কড়াই, শিশু, তাল, পিতরাজ, দেবদারু, আকাশমনি। তালিকা এড়িয়ে শুধু দেবদারু আর নিম্নমানের মেহগনি কাঠ ব্যবহার করা হয়েছে। স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন প্রতিটি ঘর নির্মাণে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকার বেশি হবে না। প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা ফিরোজ আহম্মেদ জানান, এ সম্পর্কে প্রকল্পের সভাপতি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সব জানেন। তার কিছু জানা নেই। নাম প্রকাশ অনিচ্ছুক একাধিক ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জানিয়েছেন, কাজের মান একেবারে খারাপ। নিম্নমানের ইট উপকারভোগীদের দিয়ে ফ্লোরে মাটি ভরাট করানো হয়েছে। এদিকে প্রকল্পের প্রথম ধাপের ১শ ৩২টি ঘরের নির্মাণ কাজ ৯০ শতাংশ শেষ হয়েছে। এসব ঘরের কাজে উপকারভোগীদের কাছ থেকে বিভিন্ন উপকরণ নেয়ার অভিযোগসহ নানা অনিয়মের খবর সংবাদপত্রে প্রকাশিত হওয়ায় খুলনা বিভাগীয় কমিশন অফিসের নির্দেশে যশোরে অতিরিক্তি জেলা প্রশাসক (সাবিক) হুসাইন শওকত সম্প্রতি বাঘারপাড়ার এ প্রকল্পের বিভিন্ন জায়গা ঘুরে দেখেছেন। এ ব্যাপারে তিনি জানান, বাঘারপাড়ার আশ্রয়ণ প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। সম্প্রতি খুলনা বিভাগীয় অফিস থেকে এ ব্যাপারে তদন্তে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তার ভিত্তিতে তিনি এ প্রকল্পের কাজ দেখতে এসেছেন। তবে আরও ব্যাপক খোঁজ নিয়ে এ ব্যাপারে তিনি তথ্য দিতে পারবেন বলে নিশ্চিত করেন। অপর একটি সূত্র জানিয়েছে, উপজেলা নির্বাহী অফিসার শাহনাজ বেগম অনিয়ম দুর্নীতির তদন্ত করতে নিজেই ৪ সদস্যের কমিটি গঠন করেন। কমিটিতে সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) আহ্বায়ক করা হয়। বাকি ৩ সদস্য হচ্ছেন উপজেলা প্রকৌশলী, প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। তবে তদন্তের সময় কোন চেয়ারম্যানকে সঙ্গে নেয়া হয়নি। কমিটি মাঠ পর্যায়ে অনেক অনিয়মের তথ্য পান। অথচ কয়েকটি ঘরের টিন বদল ছাড়া আর কোন পরিবর্তন হয়নি। আজমপুর গ্রামের জামির হোসেন, রামকৃষ্ণপুরের শরিফুল ইসলাম, অন্তরামপুর গ্রামের মাকসুদা খাতুনসহ কমপক্ষে ৮০ জন উপকারভোগীর কাছ থেকে নেয়া হয়েছে ৩ থেকে ১০ হাজার টাকার উপকরণ। তবে সম্প্রতি শালবরাট গ্রামের পুষ্প রাণী দেবনাথ ১৮ এপ্রিল ও শিখা রাণী দেবনাথ ২২ এপ্রিল তাদের ব্যয় হওয়া টাকা ফেরত চেয়ে নির্বাহী অফিসারের কাছে লিখিত আবেদন করেছেন। এসব অনিয়মের ব্যাপারে বক্তব্য নেয়া হলে উপজেলা নির্বাহী অফিসার শাহনাজ বেগম জানিয়েছেন, কোন অনিয়ম বা আর্থিক দুর্নীতির সঙ্গে তিনি জড়িত নন। তিনি আরও জানান, নানা অভিযোগের কারণে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে ছিলেন। তাতে অনিয়ম ধরা পড়েনি। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আশ্রায়ণ-২ প্রকল্পের উপ-প্রকল্প পরিচালক এসএম হামিদুল হক জানিয়েছেন, বাঘারপাড়া সম্পর্কে অভিযোগ আসছে, অনিয়ম পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
×