ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পোশাকে ছিনতাই-ডাকাতি

রাজশাহী অঞ্চলে জঙ্গীদের কৌশল বদল, যুক্ত হচ্ছে নারীরাও

প্রকাশিত: ০৫:২০, ৩০ এপ্রিল ২০১৮

রাজশাহী অঞ্চলে জঙ্গীদের কৌশল বদল, যুক্ত হচ্ছে নারীরাও

মামুন-অর-রশিদ, রাজশাহী ॥ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর নজরদারি ও অভিযানে কোণঠাসা হয়ে পড়া জঙ্গীরা এখন সরাসরি হামলার শক্তি হারিয়েছে। তবে তাদের তৎপরতা কমেনি। এখন তারা নানা ছদ্মবেশে কৌশল পরিবর্তন করে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে। বিশেষ করে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ অঞ্চলজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়া জঙ্গীরা নানা কৌশলে সংগঠিত হচ্ছে। তারা কখনও দোকানদার-হকার, নলকূপ মিস্ত্রী, বাস-ট্রাকচালকের সহকারী সেজে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে আসছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতার থেকে বাঁচতে বাইরের লোকদের দলে না টেনে নানা ছদ্মবেশ নিয়ে থাকা জঙ্গীরা নিজেদের পরিবারের সদস্য, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবকেই এখন জঙ্গীবাদী মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ করছে। সম্প্রতি রাজশাহী অঞ্চলে গ্রেফতার হওয়া জঙ্গীদের জিজ্ঞাসাবাদ করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছে র‌্যাব। চলতি বছরের এপ্রিল মাসেই রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নাটোর জেলায় অভিযান চালিয়ে অন্তত ৪০ জঙ্গীকে গ্রেফতার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। সর্বশেষ রবিবার চাঁপাইনাবগঞ্জ থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে জামায়াতুল মুজাহেদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) সক্রিয় ৫ সদস্যকে। এ অঞ্চলে গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে জেএমবি, আনসার আল ইসলাম ও হিজবুত তাওহিদের সদস্যরা রয়েছে। এর আগে গত ২৬ এপ্রিল রাজশাহীর চারঘাট থেকে বিদেশী পিস্তল ও জিহাদী বইসহ লোকমান হাকিম নামের এক জঙ্গীকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। তার কাছ থেকে তিন রাউন্ড গুলিসহ একটি বিদেশী পিস্তল ও দুইটি জিহাদী বই উদ্ধার করা হয়। লোকমান হাকিম এলাকায় নলকূপ মিস্ত্রি সেজে জঙ্গী তৎপরতা চালাচ্ছি। এসব জঙ্গীরা নানা কৌশলে নারীদেরও টার্গেট করে দলে ভেড়াচ্ছে। রাজশাহীতে গ্রেফতার হওয়া জঙ্গীদের মধ্যে একই পরিবারের ৫ নারী সদস্যও রয়েছে। এদিকে রাজশাহীতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পোশাকে ছিনতাইয়ের সঙ্গেও যুক্ত হয়েছে জঙ্গীরা। বাহির থেকে অর্থের যোগান বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে তারা এ পথ বেছে নিয়েছে। সম্প্রতি রাজশাহীতে গ্রেফতার জঙ্গীদের কাছ থেকে এমন তথ্যও পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। বিশেষ করে নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন আনসার আল ইসলামের সদস্যরা রাজশাহীতে কয়েকটি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটনায় বলে র‌্যাব জানায়। র‌্যাব রাজশাহীর অধিনায়ক লে. কর্নেল মাহাবুবর রহমান বলেন, ‘তাদের (জঙ্গীদের) তৎপরতা আগে যেমন ছিল, এখনও তেমন রয়েছে। তবে ধরনটা বদলেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে অনেক জঙ্গী মারা যাওয়ায় তাদের সক্ষমতা কমে গেছে। এখন তারা ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম বাদ দিয়ে ছদ্মবেশে সদস্য সংগ্রহ, অস্ত্রের ট্রেনিংয়ের মতো কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। একই সঙ্গে তারা ছিনতাই করে অর্থ সংগ্রহ করছে। তবে জঙ্গীদের ওপর গোয়েন্দা নজরদারি রয়েছে। তাদের ধরার কাজে সাধারণ মানুষও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সহায়তা করছে। র‌্যাব সূত্র জানায়, ‘গত বছরের ৫ অক্টোবর দুপুরে রাজশাহী নগরের মতিহার থানার বাইপাস সড়কে ইটখোলা এলাকায় ডিবি পুলিশ পরিচয়ে রহমান জুট মিলের সাড়ে ১৭ লাখ টাকা ছিনতাই হয়। এছাড়াও ২০১৬ সালের ১৯ ডিসেম্বর নগরের রাজপাড়া থানার ডাবতলায় গরু ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ৪৪ লাখ টাকা ডিবি ও র‌্যাবের পোশাক পরে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। এর আগে গত ১০ আগস্ট কাপাশিয়ায় বিকাশ কর্মীকে গুলি করে ১২ লাখ টাকা ছিনতাই করা হয়। এছাড়াও রাজশাহী শহরেও আরও কয়েকটি ছিনতাইয়ের ঘটনার ঘটে। এ সব ঘটনা ঘটিয়েছে নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন আনসার আল ইসলামের সদস্যরা। র‌্যাবের সূত্রমতে, রাজশাহী অঞ্চলে আনসার আল ইসলামের ৩০ থেকে ৩৫ সক্রিয় সদস্য রয়েছে। তাদের সঙ্গে জেএমবি ও হিজবুত তাওহিদের সদস্যরাও যুক্ত হয়েছে। এদের মধ্যে দুইজন এক সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পোশাক তৈরির ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করত। তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পোশাক তৈরি করে ছিনতাই কাজে ব্যবহার করছে। র‌্যাব জানায়, ২০০২ সালে জেএমবিতে যোগদান করে রাজশাহী নগরীর বেলকুপুর থানার মাহেন্দ্রা গ্রামের আলিম উদ্দিনের ছেলে লোকমান হাকিম। এরপর থেকে নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠনটির একজন আঞ্চলিক নেতার অধীনে সে দলীয় সভা আয়োজন, উগ্রবাদী বই বিতরণ, ইয়ানতের টাকা আদায়, জিহাদী দাওয়াত ইত্যাদি কর্মকা-ে অংশ নেয়া শুরু করে। পরবর্তী সময়ে সে রাজশাহী জেলার পবা এলাকার জেএমবি নেতা মোজাম্মেল হক ওরফে মোজার বাড়িতে দলীয় সভায় অংশগ্রহণ করে। ওই সভা থেকে মোজাসহ সংগঠনের ১২ সদস্যকে পুলিশ গ্রেফতার করলেও লোকমান হাকিম ও আরও কয়েকজন পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। এরপর থেকে লোকমান হাকিম নলকূপের মিস্ত্রির ছদ্মবেশে সহযোগী সদস্যদের নিয়ে সংগঠনের কাজে বিভিন্ন এলাকায় যাতায়াত শুরু করে। ছদ্মবেশে সে সংগঠনের পক্ষ থেকে ইসলামী দাওয়াত দেয়াসহ জেএমবির নতুন সদস্য সংগ্রহের দায়িত্ব পালন করছিল। র‌্যাব জানায়, নগরীর মতিহারের জোকাবিলে লোকমান হাকিম শারীরিক ও অস্ত্র চালানো প্রশিক্ষণ নেয় বলে জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছে। শুধু লোকমান নয়, এর আগে গ্রেফতার হওয়া জঙ্গীরাও জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে, ছদ্মবেশ নিয়ে এখন তারা তাদের তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। সূত্র জানায়, নতুন সদস্য সংগ্রহ, তাদের জঙ্গীবাদী মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ করা, প্রশিক্ষণ দেয়া ইত্যাদি কাজের পাশাপাশি রাজশাহী অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জঙ্গীরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পোশাক পরে ছিনতাই-ডাকাতিও করছে। তাদের লক্ষ্য, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সুনাম নষ্ট করা। র‌্যাব জানায়, একদল জঙ্গী এখন নিজেদের পরিবারের সদস্যদের জঙ্গী মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ করছে। এরপর আত্মীয়-স্বজনদের মধ্য থেকে নতুন সদস্য সংগ্রহ করে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে। গত ১৮ এপ্রিল রাজশাহী নগরীর কাশিয়াডাঙ্গা ও গোদাগাড়ী উপজেলার ছয়ঘাটি থেকে ছয় নারীসহ একই পরিবারের সাত জেএমবি সদস্যকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দা পুলিশ। এর মধ্যে হাসান আলী নামের জেএমবির তালিকাভুক্ত এক সদস্য রয়েছে, যার গোদাগাড়ীর বেণীপুর ‘জঙ্গী’ হামলার সঙ্গে সম্পৃক্ততা রয়েছে। গ্রেফতার হওয়া বাকি ছয় জন হলো হাসান আলীর স্ত্রী শেফালী খাতুন (৩৫), তার দুই মেয়ে ফারিহা খাতুন কনা (১৭) ও হানুফা খাতুন (১৯) এবং তার ভাই মৃত রেজাউল করিমের তিন মেয়ে ফারজানা আক্তার সুইটি (১৭), রাজিয়া সুলতানা তিশা (২২) ও রোজিনা সুলতানা কলি (২৫)। সাত জঙ্গীকে গ্রেফতারের পর রাজশাহীর পুলিশ সুপার মোঃ শহীদুল্লাহ বলেছিলেন এসব জঙ্গীরা বিভিন্ন সময় হামলার পরিকল্পনা করেছে বলে স্বীকার করেছে। এজন্য তারা জেএমবির অন্য সদস্যদের সঙ্গে মিলিত হয়ে গোপনে বৈঠকও করেছে বলে জানিয়েছে। ছয় নারীসহ সাত জনকে গ্রেফতার প্রসঙ্গে রাজশাহী জেলা পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) পরিদর্শক আতাউর রহমান বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের কঠোর নজরদারি ও অভিযানের কারণে জঙ্গীরা প্রকাশ্যে তাদের তৎপরতা চালাতে পারছে না। তবে জঙ্গীদের একটা অংশ ছদ্মবেশে তৎপর রয়েছে। আরও একটা অংশ নিজের পরিবারের সদস্য, বন্ধু-বান্ধবদের জঙ্গী মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ করছে। তিনি আরও জানান, ছদ্মবেশে তৎপর জঙ্গীদের ধরতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারি আরও কঠোর করা হয়েছে। একইসঙ্গে আগের মামলার তদন্ত সর্তকতার সঙ্গে করা হচ্ছে।
×