ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অনিচ্ছা নির্বাসন বুকে টেনে নেয়া ঘোলাটে চাঁদ, প্রতিবাদী তারুণ্য

প্রকাশিত: ০৫:১৬, ৩০ এপ্রিল ২০১৮

অনিচ্ছা নির্বাসন বুকে টেনে নেয়া ঘোলাটে চাঁদ, প্রতিবাদী তারুণ্য

মোরসালিন মিজান ॥ খুব কম সময় বেঁচে ছিলেন রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। তবে যেটুকু বেঁচে থাকা তার পুরোটাই কবিতার সঙ্গে। হৃদয়ে যে ভালবাসার বোধ, যে মান অভিমান, যে বেদনার বিস্তার ঘটেছিল তার সবই কবিতার কাছে সঁপে দিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। নিজের সময়কে কবিতায় ধারণ করেছিলেন। সময়ের ব্যবচ্ছেদ করেছিলেন নির্মোহভাবে। ‘জাতির পতাকা আজ খামচে ধরেছে সেই পুরনো শকুন...।’ এর চেয়ে সত্য উচ্চারণ আর কী হতে পারে? মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে উল্টোপথে হাঁটতে দেখে রুদ্র-ই এমন সাহসী উচ্চারণ করেছিলেন। এই রুদ্র দুর্লভ। এই রুদ্র নিজেই কবিতা। আবৃত্তির মঞ্চ। তাই প্রতিনিয়ত স্মরণ করা হয় প্রিয় কবিকে। তবে রবিবার ছিল বিশেষ আয়োজন রুদ্রমেলা। হ্যাঁ, কবির প্রয়াণের পর তার বন্ধু সুহৃদ ও কবিতার অনুরাগীরা ১৯৯২ সালে প্রথম এই মেলার আয়োজন করেছিলেন। কয়েক বছরের মধ্যে এটি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে স্মরণ করার বড় প্ল্যাটফর্মে পরিণত হয়। তবে মাঝখানে বন্ধ ছিল। এখন আবার আয়োজন করা হচ্ছে। রবিবার ছিল ১৬তম আয়োজন। রুদ্র সংসদ আয়োজিত মেলায় ছিল কবিতা থেকে আবৃত্তি, সঙ্গীত, নৃত্যসহ নানা আয়োজন। এবারের স্লোাগান নির্বাচন করা হয়- ‘ভাষার কসম খেয়ে আমরা দাঁড়াবো ঘিরে/ আমাদের মাতৃভূমি, জল, অরণ্য, জমিন...।’ বৃষ্টিবিঘ্নিত সকালে চারুকলার বকুলতলায় শুরু হয় অনুষ্ঠান। দিনব্যাপী মেলার উদ্বোধন করেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সৈয়দ হাসান ইমাম। বিশেষ অতিথি ছিলেন কবি মোহাম্মদ নুরুল হুদা, কামাল চৌধুরী ও অসীম কুমার উকিল। মেলা উদ্যাপন কমিটির আহ্বায়ক গোলাম কুদ্দুছের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন মেলা উদ্যাপন কমিটির সদস্য সচিব ও রুদ্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক কামাল পাশা চৌধুরী। অনুষ্ঠানে সৈয়দ হাসান ইমাম বলেন, মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে কবিদের মধ্যে সবচেয়ে বলিষ্ঠ কণ্ঠটি ছিল রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর। অল্প বয়সে আবুল হাসান ও রুদ্রকে হারিয়ে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে বলে আক্ষেপ করেন তিনি। গোলাম কুদ্দুছ বলেন, রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ মানুষ, দেশ ও মুক্তিযুদ্ধের প্রতি দায়বদ্ধ ছিলেন। এখনকার অনেক তরুণদের মধ্যে আমরা সেটা দেখি না। ভোগবাদী জীবন ত্যাগ করে দেশ সমাজ ও মানুষের জন্য কাজ করার জন্য তরুণদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। কবির সঙ্গে অনেক স্মৃতি শিল্পী কামাল পাশা চৌধুরীর। সেসব স্মৃতি রোমন্থন করে তিনি বলেন, ঢাকা কলেজে পড়ার সময় রুদ্র ও আমার একসঙ্গে শিল্প-সংস্কৃতির যাত্রা শুরু হয়। রুদ্র ছিলেন বিদ্রোহী। তখন নানা ঘটনার প্রেক্ষিতে কবিরা বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিলেন। সে সময়ের বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে স্লোগান দিলে, লিখলে বা গাইলে সাজা হতো সাত বছরের জেল। এরপরও স্বৈরাচারবিরোধী কবিতা লিখেছিলেন রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। পরবর্তীতে সব অশুভর বিরুদ্ধে হাতিয়ার হিসেবে রুদ্রর দ্রোহ একটি ধারা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় বলে জানান তিনি। অন্য বক্তারা বলেন, বাংলার প্রতিবাদী কাব্যধারায় রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এক অনিবার্য নাম। মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের উত্তাল কাল পর্বে আবির্ভূত এই কবি একাধারে দ্রোহ-প্রেম-স্বপ্ন ও সংগ্রামে নিবিষ্ট সাধক ছিলেন। সকল অসাম্য, শোষণ স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ উচ্চারণ তাকে আলাদা পরিচিতি দিয়েছে। উদ্বোধনী পর্ব শেষ হতেই ঝড় নামে। বৃষ্টি শুরু হয়। বকুলতলার মাটি যখন ভিজে একাকার তখন মঞ্চে ওঠেন লায়লা আফরোজ। রুদ্র থেকে তিনি শুনিয়ে যানÑ বৃষ্টি হলে মাটি কাঁপে, লাশগুলো আবার দাঁড়াতে চায়।/হাত বাঁধা, চক্ষু বাঁধা, বেয়ানেটে ছিন্নভিন্ন দেহ-/লাশগুলো আবার দাঁড়াতে চায়...। কবিতার পর সঙ্গীত। সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠীর শিল্পীরা গেয়ে শোনান ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’ ও ‘হিমালয় থেকে সুন্দরবন’ গান দুটি। এভাবে কবিতা ও গানে গানে এগিয়ে চলে অনুষ্ঠান। আয়োজনের পুরোটা সময় মধ্যমণি হয়ে ছিলেন রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। তার কবিতাই ঘুরে ফিরে আসে। বাচিক শিল্পী নাজমুল আহসান রুদ্র’র অভিমানগুলোকে সামনে আনেন। কবির হয়ে উচ্চারণ করেন, ‘আমি সেই অনিচ্ছা নির্বাসন বুকে টেনে নেয়া ঘোলাটে চাঁদ/ আমাকে আর কি বেদনা দেখাবে?’ তামান্না রহমানের কণ্ঠে ছিল বিখ্যাত কবিতা ‘মানুষের মানচিত্র।’ রুদ্র’র ‘বিশ্বাসের হাতিয়ার’ আবৃত্তি করেন সুবর্ণা আরফিন। চমৎকার আবৃত্তি করেন মাহফুজা আক্তার। প্রিয় কবিতার ভাষায় কবিকে ভালবাসা জানান তিনি। ছিল দলীয় আবৃত্তি। অনুষ্ঠানে দলীয় সঙ্গীত পরিবেশন করে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠী, ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠী, বহ্নিশিখা ও আনন্দন। ছিল নাচের পরিবেশনা। রবীন্দ্রনাথের ‘মম চিত্তে নিতি নৃত্যে’ গানের সঙ্গে দলীয় নাচ পরিবেশন করে নৃত্যজন। এভাবে বিভিন্ন পরিবেশনার মাধ্যমে প্রয়াত কবিকে স্মরণ করা হয়। ভালবাসা জানানো হয়। দিনব্যাপী আয়োজনের দ্বিতীয় পর্ব অনুষ্ঠিত হয় বিকেলে। এ পর্বটিও বৃষ্টির কবলে পড়ে। তবে রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর প্রতি ভালবাসা প্রকাশ তাতে থেমে থাকেনি। থেমে থাকবে না।
×