ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

কক্সবাজারে স্বস্তি পরিষদ প্রতিনিধিদলের রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন

মিয়ানমারকেই রোহিঙ্গা সঙ্কটের সমাধান করতে হবে

প্রকাশিত: ০৫:০১, ৩০ এপ্রিল ২০১৮

মিয়ানমারকেই রোহিঙ্গা সঙ্কটের সমাধান করতে হবে

মোয়াজ্জেমুল হক/ এইচএম এরশাদ ॥ রোহিঙ্গা সঙ্কট মিয়ানমার তৈরি করেছে, মিয়ানমারকেই এর সমাধান করতে হবে। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বাংলাদেশ-মিয়ানমারের মধ্যে গঠনমূলক আলোচনার মাধ্যমে সম্পন্ন হবে। রোহিঙ্গাদের অবশ্যই ফেরত নিয়ে নিরাপদ জীবনের ব্যবস্থা করতে হবে। রোহিঙ্গাদের নিরাপদে প্রত্যাবাসনসহ সৃষ্ট সঙ্কট সমাধানে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করবে। মিয়ানমার সরকারের কাছ থেকে প্রতিনিধি দল জানতে চাইবে তারা নিরাপত্তা পরিষদের এ উদ্যোগের সঙ্গে কিভাবে যুক্ত হবে। নিরাপত্তা পরিষদের এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে রাশিয়া এবং চীনও একমত হয়েছে বলে জানান দিলেন নিরাপত্তা পরিষদ প্রতিনিধিদল। বাংলাদেশে সফররত জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ প্রতিনিধিদল রবিবার সকালে কক্সবাজারের কুতুপাংলয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তাদের মতামত তুলে ধরেন। সংবাদ সম্মেলনের আগে প্রতিনিধিদলের সদস্যরা কক্সবাজার সীমান্তের তুমব্রু জিরো পয়েন্টে, উখিয়ার কুতুপালংয়ে আশ্রয় গ্রহণকারী রোহিঙ্গাদের পরিস্থিতি সরেজমিনে পরিদর্শন করেন। এ সময় তারা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া ও ক্ষতিগ্রস্ত রোহিঙ্গা সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেন। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসে আশ্রয় গ্রহণ করার পর সার্বিকভাবে যে সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে তা সরেজমিনে পর্যবেক্ষণে এবং ক্ষতিগ্রস্তদের বক্তব্য জানতে শনিবার বিকেলে কুয়েত এয়ারলাইন্সের একটি বিশেষ ফ্লাইটযোগে ইরাক থেকে সরাসরি কক্সবাজার আসেন জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ১৫টি দেশের ২৬ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল। প্রতিনিধিদলে নেতৃত্ব দিচ্ছেন নিরাপত্তা পরিষদের পক্ষে গুস্তাভো মেজা সুআদ্রা। নিরাপত্তা পরিষদের ৫ স্থায়ী সদস্য যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, রাশিয়া, চীন এবং অস্থায়ী সদস্য বলিভিয়া, গিনি, ইথিওপিয়া, কাজাখস্তান, কুয়েত, নেদারল্যান্ডস, পেরু, পোল্যান্ড, সুইডেন, আইভরিকোস্টসহ সংশ্লিষ্ট দেশের প্রতিনিধি সফরে রয়েছেন। আজ সোমবার প্রতিনিধিদল মিয়ানমারের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করবে। রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন ॥ রবিবার সকাল নয়টায় জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিনিধি দলের সদস্যরা প্রথমে যান পার্বত্য এলাকা নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু সীমান্তের নোম্যানসল্যান্ডে। সেখানে প্রায় ৬ হাজার রোহিঙ্গা রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছে। প্রতিনিধিদলের সদস্যরা এসব রোহিঙ্গার বেশকিছু সদস্যের সঙ্গে দেখা করে দুঃখ বেদনার কথা অবহিত হন। পরে তারা যান উখিয়ার বালুখালি ময়নারঘোনার আশ্রয় ক্যাম্পে। এরপর প্রতিনিধিদলের সদস্যরা চারভাগে বিভক্ত হয়ে যান কুতুপালং শিবিরে। সদস্যরা পৃথক পৃথকভাবে কুতুপালংয়ের ডি-৫ ব্লকে অবস্থানরত বেশকিছুসহ অন্যান্য স্থানে আশ্রিত রোহিঙ্গার সঙ্গে কথা বলেন। তুমব্রুর জিরো পয়েন্টে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের অবস্থা পরিদর্শনকালে আশ্রয় গ্রহণকারী কিশোরী রোহিঙ্গা আমেনা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। সে প্রতিনিধিদলের সদস্যদের জানায়, তার চোখের সামনে বাবা সৈয়দ আলম ও মা সখিনাকে মিয়ানমার সেনা সদস্যরা গুলি করে হত্যা করেছে। প্রতিনিধিদলের সদস্যরা কিশোরী আমেনার বাবাসহ রাখাইনে হত্যার শিকার সকলের বিচার পেতে সহযোগিতার আশ্বাস দেন। নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদের কুতুপালং ক্যাম্প পরিদর্শনকালে কয়েক রোহিঙ্গা ব্যানার প্ল্যাকার্ড সঙ্গে নিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। এ সময় তাদের পক্ষ থেকে স্লোগান দেয়া হয়, ‘আমাদের দেশ বাংলাদেশ নয়, আমরা মিয়ানমারে ফিরে যেতে চাই। আমাদের অধিকার ফিরে পেতে চাই। আমাদের ওপর বর্বর নির্যাতনের বিচার চাই। এ সময় পুলিশ ও আনসার সদস্যরা বিক্ষোভকারীদের বাধা দেয়। ফলে কোন ধরনের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়নি। প্রতিনিধিদলের সংবাদ সম্মেলন ॥ কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন শেষে প্রতিনিধিদলের সদস্যরা উপস্থিত গণমাধ্যম কর্মীদের প্রেস ব্রিফিং করেন। সাংবাদিকদের সঙ্গে নিরাপত্তা পরিষদের এসব সদস্য রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিনিধি সরেজমিনে পরিদর্শন করে বক্তব্য দেন। তাদের পক্ষ থেকে বলা হয়, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সদস্যদের ওপর যা ঘটে গেছে তা বেদনাদায়ক। রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে নিরাপত্তা পরিষদ কাজ করছে এবং কাজ করে যাবে। প্রতিনিধিদলের পক্ষ থেকে জানানো হয়, রোহিঙ্গাদের অবশ্যই ফেরত নিতে হবে এবং তাদের নিরাপদ জীবন নিশ্চিত করতে হবে। তবে এ প্রক্রিয়ায় কিছু সময় লাগতে পারে। রোহিঙ্গাদের দুর্দশা দেখার পর প্রেস ব্রিফিংয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পিয়ার্স বলেন, আমরা (প্রতিনিধিদলের সদস্য) বাংলাদেশ সফর শেষে মিয়ানমারে যাব। মিয়ানমার সরকারের কাছ থেকেও শুনতে চাইবেন সমস্যা সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে কিভাবে তারা যুক্ত হতে পারে। পিয়ার্স আরও বলেন, রোহিঙ্গা সঙ্কট মোকাবেলায় আমরা নিরাপত্তা পরিষদের সমর্থন দেয়ার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করব। এমন সিদ্ধান্ত নেব, যা রোহিঙ্গাদের উপকারে আসে। প্রতিনিধিদলের নেতৃত্বাদানকারী গুস্তাভো মেজা সুআদ্রা জানান, আমরা এ সঙ্কট দেখে খুবই উদ্বিগ্ন। পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছি আমরা। রোহিঙ্গাদের জন্য যেন কিছু করতে পারি সে লক্ষ্যে সমস্যা সরেজমিনে ভালভাবে জানার জন্য আমরা এখানে এসেছি। কুয়েতের প্রতিনিধি মনসুর আল উভাইদি বলেন, আমরা এখান থেকে মিয়ানমারে যাব এবং সেখান থেকে নিউইয়র্কে ফিরে গিয়ে রোহিঙ্গা ইস্যুটি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আলোচনায় আনব। তবে তিনি একথাও বলেন, আমরা এমন কোন প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি না যে এ ব্যাপারে দ্রুত কোন ব্যবস্থা নিতে পারব। অন্যান্য সদস্য বলেন, মিয়ানমার-বাংলাদেশের মধ্যে গঠনমূলক আলোচনার মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন সম্পন্ন হবে। প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে রাশিয়া ও চীনও একমত হয়েছে। ব্রিফিংয়ে রাশিয়া ও চীনের কূটনীতিকরাও তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। এসব প্রতিনিধিদের বক্তব্যে রোহিঙ্গারা যাতে স্বেচ্ছায়, নিরাপদে স্বদেশে ফিরে যেতে পারে সে ব্যাপারে তারা কাজ করার অঙ্গীকার প্রদান করেন। প্রেস ব্রিফিংয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমও বক্তব্য রাখেন। তিনি বলেন, নিরাপত্তা পরিষদের এই প্রতিনিধিদলের সফর রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য রাষ্ট্রের এই প্রতিনিধিদলের সদস্যরা বিকেলে কক্সবাজার থেকে ঢাকায় ফিরে যান। আজ সোমবার সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তারা সাক্ষাত করবেন। এরপর তারা সরাসরি যাবেন মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুনে। সেখান থেকে যাবেন মংডুতে। মংডু থেকে তাদের হেলিকপ্টারযোগে রাখাইন রাজ্য পরিদর্শনে নেয়ার কথা রয়েছে। তবে ঢাকা ছাড়ার আগে সোমবার সকালে বিমানবন্দরে সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখবেন তারা। রোহিঙ্গা পরিস্থিতি দেখতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের এই প্রতিনিধিদল শনিবার বিকেলে কক্সবাজারে পৌঁছেন। সেদিন সন্ধ্যায় হোটেল রয়েল টিউলিপে নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিনিধিদের প্রেস ব্রিফিং করেন। এ সময় পররাষ্ট্র পতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব ও মেরিটাইম এ্যাফেয়ার্স বিভাগের প্রধান রিয়ার এ্যাডমিরাল (অব) খুরশেদ আলম এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ পূর্ব অনু বিভাগের মহাপরিচালক তারেক মাহমুদসহ অন্য কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। এ সময় ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন এবং প্রথা ও অপ্রথাগত নিরাপত্তা ঝুঁকি-এই তিনটি বিষয়ে আলাদা আলাদা ব্রিফিং করা হয়। প্রতিনিধি দলের কাছে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সরাসরি হস্তক্ষেপ কামনা করা হয় বাংলাদেশের পক্ষে। ব্রিফিংয়ে জানানো হয়, সমস্যার মূল কারণ রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে তাদের নাগরিকত্ব না থাকা, ১৯৭৮, ১৯৯২, ২০১২, ২০১৬ এবং ২০১৭ সালে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সদস্যদের ওপর যে বর্বরতার ঘটনা ঘটেছে এর নেপথ্যের মূল কারণ ছিল রোহিঙ্গাদের সে দেশে নাগরিক নয় বলে ঘোষণা দেয়ার জের। প্রতিনিধিদলের সম্মানে নৈশভোজ ॥ জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিনিধিদল রবিবার বিকেলে ঢাকায় ফিরে আসে। সন্ধ্যায় হোটেল রেডিসনে প্রতিনিধিদলের সম্মানে এক নৈশভোজের আয়োজন করা হয়। এতে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমসহ সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা অংশ নেন। প্রতিনিধিদলের সদস্যরা রবিবার হোটেল রেডিসনেই অবস্থান করেন। ওআইসির পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা রোহিঙ্গাদের দেখতে আসছেন ॥ আগামী ৪ মে ওআইসিভুক্ত দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা উখিয়া-টেকনাফে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের দেখতে আসছেন। এরপর ৫ ও ৬ মে ঢাকায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ওআইসি পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের ৪৫তম সম্মেলনে যোগ দেবেন তারা। ওআইসি জোটের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের এ বৈঠকে রোহিঙ্গা সঙ্কট অন্যতম এজেন্ডা হবে বলে সরকারী সূত্রে জানানো হয়েছে।
×