ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

শুরু হয়েছে প্রতিস্থাপন কাজ ॥ ডিসেম্বরে আরও ১৩ হাজার পরিণত হচ্ছে চলন্ত বোমায়

মেয়াদোত্তীর্ণ ১৩ হাজার অটোরিক্সা ধ্বংস করা হচ্ছে ঢাকা-চট্টগ্রামে

প্রকাশিত: ০৪:৫৮, ৩০ এপ্রিল ২০১৮

মেয়াদোত্তীর্ণ ১৩ হাজার অটোরিক্সা ধ্বংস করা হচ্ছে ঢাকা-চট্টগ্রামে

রাজন ভট্টাচার্য ॥ তিন দফা মেয়াদ বাড়ানোর পর এবার মেয়াদোত্তীর্ণ সিএনজি চালিত অটোরিক্সা ধ্বংস করছে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি, বিআরটিএ। পাশাপাশি ঢাকা ও চট্টগ্রামের দুই মহানগরীতে নতুন অটোরিক্সা রিপ্লেসমেন্টের কাজও চলছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে মেয়াদ পেরিয়ে যাওয়া ১৩ হাজার অটোরিক্সা ধ্বংস করার কথা জানিয়েছেন কর্তাব্যক্তিরা। ঢাকায় আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে অটোরিক্সা প্রতিস্থাপনের কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। পরিবহন বিশেষজ্ঞ, মালিক ও শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কয়েকদফা মেয়াদ বাড়ানোর পর ঢাকা ও চট্টগ্রামের বেশিরভাগ অটোরিক্সা চলন্ত বোমায় পরিণত হয়েছিল। যে কোন সময় ঘটতে পারত মারাত্মক দুর্ঘটনা। চালক ও যাত্রীরা মোটেও এসব যানবাহনে নিরাপদ ছিল না। তাই বারবার অটোরিক্সার মেয়াদ না বাড়াতে তাগিদ দেয়া হচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত জনস্বার্থের কথা বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে অটোরিক্সার মেয়াদ না বাড়ানোর পরামর্শ দেয়। এরপর থেকে মেয়াদ শেষ হওয়া গাড়ি ধ্বংস করতে শুরু করে বিআরটিএ। সরকারী এই পরিবহন নিয়ন্ত্রণ সংস্থাটির ইকুরিয়া কার্যালয়ে ও চট্টগ্রামে এই ধ্বংসযজ্ঞ চলছে। নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক আশীষ কুমার দে বলেন, আমরাও বারবার তাগিদ দিয়েছি মেয়াদ শেষ হওয়া গাড়ি ধ্বংস করতে। এখন প্রত্যাশা থাকবে সরকার দ্রুততম সময়ের মধ্যে যেন ঢাকার গণপরিবহন বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়। পাশাপাশি মেয়াদ শেষ হওয়া বাস চলাচল বন্ধ করে নতুন বাস নামানোর উদ্যোগ বাস্তবায়ন করবে। জানা গেছে, পহেলা এপ্রিল থেকে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ-বিআরটিএর ঢাকার ইকুরিয়া কার্যালয়ে অটোরিক্সা ধ্বংসের কাজ শুরু করে। চট্টগ্রামের বালুচরায় বিআরটিএ কার্যালয়ে এ কাজ শুরু হয়েছে ১২ এপ্রিল থেকে। অটোরিক্সাগুলো ভেঙ্গে ফেলার পর প্রতিটি অটোরিক্সার মালিককে একই নম্বরপ্লেটে নতুন অটোরিক্সার নিবন্ধন দেয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বিআরটিএর ঢাকা বিভাগীয় উপপরিচালক মাসুদ আলম। ঢাকায় মেয়াদোত্তীর্ণ ফোরস্ট্রোক থ্রি-হুইলার স্ক্র্যাপকরণ কমিটির আহ্বায়ক মাসুদ বলেন, ‘দ্রুততম সময়ের’ মধ্যে এসব কাজ করা হচ্ছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই অটোরিক্সা প্রতিস্থাপন প্রক্রিয়া শেষ করতে পারবেন বলে আশাবাদী তারা। ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগর থেকে ১৫ বছরের পুরনো ১৩ হাজার অটোরিক্সা তুলে দিতে গত ১৫ মার্চ বিআরটিএকে চিঠি দেয় সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ। এতে ঢাকায় আগামী সেপ্টেম্বর এবং চট্টগ্রামে জুলাইয়ের মধ্যে অটোরিক্সা প্রতিস্থাপন প্রক্রিয়া শেষ করতে বলা হয়। প্রতিস্থাপন দ্রুত করতে প্রয়োজনে দুই মহানগরে একাধিক স্থানে কাজ করার নির্দেশনা দেয়া হয়। ওই চিঠি পাওয়ার পর ঢাকা ও চট্টগ্রামে দুজন উপ-পরিচালককে প্রধান করে একটি আহ্বায়ক কমিটি গঠন করে দেয় বিআরটিএ। এ কমিটির অধীনে পুরনো অটোরিক্সা প্রতিস্থাপন কাজ হচ্ছে। বিআরটিএ কর্মকর্তারা জানান, ঢাকায় ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত তিন হাজারের বেশি অটোরিক্সা মালিক তাদের অটোরিক্সা প্রতিস্থাপনের জন্য আবেদন করেছেন। গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ৯২০ অটোরিক্সা ধ্বংস করা হয়েছে। প্রতিদিন ৭০ করে অটোরিক্সা ধ্বংস করা হচ্ছে। তবে গাড়ির চেসিস, ইঞ্জিন নম্বর ঠিকমতো বোঝা না যাওয়ায় কিছু অটোরিক্সা ধ্বংস করা হয়নি। বিশেষজ্ঞ মতামত নেয়ার পর সেগুলো ধ্বংস করা হবে। ঢাকায় ১৩ হাজার ৬৫২ এবং চট্টগ্রামের ১৩ হাজার মিলিয়ে ২৬ হাজার ৬৫২ অটোরিক্সা চলাচল করছে। এর মধ্যে ঢাকায় ২০০২ সালে পাঁচ হাজার ৫৬১ এবং চট্টগ্রামে সাত হাজার ৪৫৯ নিবন্ধন দেয়া হয়। এই ১৩ হাজার ২০ অটোরিক্সার মেয়াদ শেষ হয়েছে গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর। বাকিগুলোর মেয়াদ শেষ হবে এ বছরের ৩১ ডিসেম্বর। ১৫ বছর পূর্ণ হওয়া অটোরিক্সার মেয়াদ আরও বাড়াতে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছিলেন মালিকরা। তবে এসব অটোরিক্সার গ্যাস সিলিন্ডার ‘চলন্ত বোমায়’ পরিণত হয়েছে অভিযোগ করে সেগুলো প্রতিস্থাপনের দাবি জানান চালকরা। দুই পক্ষের পাল্টাপাল্টি অবস্থানের মধ্যে অটোরিক্সাগুলোর মেয়াদ বাড়ানো যায় কি না তা জানতে গত বছরের ১৩ নবেম্বর বুয়েটের যন্ত্রকৌশল বিভাগে চিঠি দেয় বিআরটিএ। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর বুয়েট কর্তৃপক্ষ গত ৬ মার্চ বিআরটিএকে চিঠি দিয়ে জানিয়ে দেয়, এসব অটোরিক্সার মেয়াদ আর বাড়ানো যাবে না। বিআরটিএ বলছে, পুরনোগুলো ধ্বংসের পাশাপাশি নতুন অটোরিক্সার নিবন্ধন দেয়াও চলছে একই সঙ্গে। ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত মিরপুর কার্যালয় থেকে ১৫০ এবং ইকুরিয়া কার্যালয় থেকে ৬৩ নতুন অটোরিক্সা নিবন্ধন করা হয়েছে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। এদিকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত চট্টগ্রামে ৫৫৪ অটোরিক্সা ধ্বংস এবং নতুন ১৫ অটোরিক্সার নিবন্ধন দেয়া হয়েছে বলে বিআরটিএর চট্টগ্রাম বিভাগীয় উপপরিচালক শহীদুল্লাহ কায়সার জানিয়েছেন। বিআরটিএ কর্মকর্তারা জানান, প্রতিস্থাপনের জন্য মালিকদের আবেদনের পর অটোরিক্সার নম্বর অনুযায়ী পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়। মালিকরা তাদের অটোরিক্সা নিয়ে বিআরটিএ কার্যালয়ে হাজির হন। সেখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তাদের অটোরিক্সা ধ্বংস করা হয়। বিস্ফোরক অধিদফতরের সহায়তায় অটোরিক্সার সিলিন্ডার পরবর্তীতে ধ্বংস করা হবে বলে জানান সংস্থাটির সহকারী পরিচালক শামসুল কবির। তিনি বলেন, এগুলো আমরা রেখে দিচ্ছি। আমাদের এখানে এসব সিলিন্ডার ধ্বংস করার মতো অভিজ্ঞ লোকজন নেই। এ কারণে স্ক্র্যাপের কাজ শেষ হওয়ার পর বিস্ফোরক অধিদফতরের সহায়তায় এগুলো ধ্বংস করা হবে। তাদের কাছে সব অটোরিক্সা মালিকের পূর্ণ তথ্যসহ তালিকা রয়েছে জানিয়ে বিআরটিএর ঢাকা বিভাগীয় উপপরিচালক মাসুদ আলম বলেন, একটা অটোরিক্সা স্ক্র্যাপ করার পর মালিকদের আর কোন কাগজ দেয়া হচ্ছে না। আগের কাগজপত্র নিয়ে আমাদের কাছে এলেই নতুন করে নিবন্ধন পাচ্ছেন। প্রতিস্থাপন প্রক্রিয়া শেষে ইতোমধ্যে প্রায় আড়াই শ’র মতো অটোরিক্সা রাস্তায় চলাচল শুরু করেছে বলে জানান তিনি। অটোরিক্সা প্রতিস্থাপন প্রক্রিয়া শুরুর পর ঢাকার মগবাজার এলাকার অটোরিক্সা বিক্রয়কেন্দ্র ও মেরামত কারখানায় ভিড় বেড়েছে। অটোরিক্সা শ্রমিক ইউনিয়নের নেতা হানিফ খোকন বলেন, আমরা অটোরিক্সার মেয়াদ বাড়ানোর বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছি। কারণ আগে যাত্রী ও চালকের নিরাপত্তার কথাটি বিবেচনায় নিতে হবে। আমরা সে বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়েছি। সরকার আমাদের সঙ্গে একমত ছিল। কিন্তু মালিকরা কখনই চায়নি অটোরিক্সার ভেঙ্গে দেয়া হোক। তিনি বলেন, আরও অল্প সময়ের মধ্যে অটোরিক্সা ধ্বংস করে নতুন গাড়ি নামানোর কাজ শেষ করতে হবে। নইলে রাজধানীতে গণপরিবহন সঙ্কট দেখা দেবে।
×