ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ধ্বংসের মুখে যশোরের প্রথম প্লাস্টিক কারখানা

প্রকাশিত: ০৪:২৪, ৩০ এপ্রিল ২০১৮

 ধ্বংসের মুখে যশোরের প্রথম প্লাস্টিক কারখানা

স্টাফ রিপোর্টার, যশোর অফিস ॥ বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড-বিডিবিএল (পূর্বের নাম বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক)-এর কারসাজি আর অর্থ আত্মসাতের কারণে ধ্বংস হতে যাচ্ছে যশোরের প্রথম প্লাস্টিক কারখানা, যশোর প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। শুধু ধ্বংস হতে যাচ্ছে না, পথে বসতে যাচ্ছেন উদ্যোক্তারা। শিল্পটি বাঁচিয়ে রাখতে উদ্যোক্তারা সরকারের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। কেবল হস্তক্ষেপ কামনাই করেননি, অর্থমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে দেখা করার জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু সেটিও বিডিবিএলের কারণে হচ্ছে না। বিডিবিএলের কর্মকর্তারা কোন প্রকার মতামত প্রদান না করার কারণে অর্থমন্ত্রীর সাক্ষাত মিলছে না বলে যশোর প্লাস্টিকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আব্দুল গণি জানিয়েছেন। জানা গেছে, ১৯৮১ সালে আব্দুল গণি যশোরের চাঁচড়ায় যশোরের সর্বপ্রথম প্লাস্টিক সামগ্রী নির্মাণ কারখানা, যশোর প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিজ নামে একটি উৎপাদনমুখী শিল্প গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন। কারখানাটি গড়ে তোলার লক্ষ্যে তৎকালীন শিল্প ব্যাংকে ঋণ পাওয়ার আবেদন করেন আব্দুল গণি। ব্যাংক থেকে লিমিটেড কোম্পানি করার শর্ত দেয়া হয়। সেই মোতাবেক নয় পরিচালক ও চার শেয়ারহোল্ডার নিয়ে একটি লিমিটেড কোম্পানি গঠন করা হয়। এই কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হন আব্দুল গণি। লিমিটেড কোম্পানি হওয়ার পর ১৯৮৩ সালে প্রথম ঋণ মঞ্জুরি অনুমোদন করে শিল্প ব্যাংক। অনুসন্ধানে জানা গেছে, শিল্প ব্যাংক ১৯৮৩ সালের ২ নবেম্বর ১৫ লাখ, ১৯৮৫ সালের ১৩ অক্টোবর ১৫ লাখ, ১৯৮৮ সালের ৪ আগস্ট ৮ লাখ ১৭ হাজার ও ১৯৮৮ সালের ৮ ডিসেম্বর ৮৫ হাজার টাকা ঋণ দেয়। শর্ত ছিল পরিচালক মনোয়ার হোসেন ও ইয়াকুব আলীর নামের সম্পত্তি ব্যাংকের কাছে বন্ধক রাখতে হবে। কিন্তু উল্লেখিত দু’পরিচালকের সম্পত্তি হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স কর্পোরেশনে বন্ধক থাকায় প্রকল্পের স্বার্থে আব্দুল গণি তার পিতা ও দু’চাচার নামে থাকা ৯৬ শতক জমি শর্তসাপেক্ষে ব্যাংকে বন্ধক রাখেন। পরবর্তীতে প্রকল্প বাস্তবায়ন হলেও বন্ধক রাখা সম্পত্তি অবমুক্ত করেনি ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। ১৯৮৬ সালের ৯ আগস্ট যশোর প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিজ কোম্পানি হিসেবে রেজিস্ট্রেশন প্রাপ্ত হয়। প্রকল্পের নির্মাণ কাজ শুরু হয় ১৯৮৭ সালের জানুয়ারি মাসে। শিল্প ব্যাংকের তৎকালীন ঝিনাইদহ শাখা কর্তৃপক্ষ ১৯৮৭ সালের ২৯ এপ্রিল ও ১৯৮৮ সালের ২৩ আগস্ট প্রকল্পটি পরিদর্শন করেন। ১৯৮৭ সালে প্রকল্পের মেশিন আমদানির জন্যে টেন্ডার আহ্বান করা হয়। এ লক্ষ্যে ১৯৮৭ সালের ৩০ ডিসেম্বর পরিচালক ও শেয়ারহোল্ডারদের সাধারণ সভা ডাকা হয়। অডিট রিপোর্ট অনুমোদন পায় ১৯৮৭ সালের ৩০ জুন। এরপর ১৯৯০ সালের ৬ মার্চ জয়েন্ট স্টক কোম্পানির রেজিস্ট্রেশন পেতে আবেদন করা হয়। এ জন্য জমা দিতে হয় ৫শ’ ১০ টাকা; যার রশিদ নম্বর ২৪৬৭৭। এরপরই পরিচালক মনোয়ার হোসেন ষড়যন্ত্র শুরু করেন। মেশিন আমদানির টেন্ডারে মনোয়ার হোসেনের এক বন্ধু অংশগ্রহণ করেন। তিনি টেন্ডারে ৫০ হাজার ডলার ওভারইনভয়েজিং করার কারণে ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ কয়েক পরিচালক বাধা দেন। তখনই মনোয়ার হোসেন হাত মেলান ব্যাংকের সেই সময়ের মেশিনারিজ বিভাগের প্রধান রেজাউল কুদ্দুসের সঙ্গে। ১৯৮৮ সালের ৪ অক্টোবর ব্যাংকের অনুমোদন সাপেক্ষে দরপত্র খোলা হয়। এরপর ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে ১৯৮৯ সালের ২৪ আগস্ট মনোয়ার হোসেন গ্রুপ আলাদা সভা করে মনোয়ার হোসেনকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক নির্বাচিত করেন। এ সিদ্ধান্ত একই বছরের ৯ ডিসেম্বর ব্যাংকের খুলনা বিভাগীয় অফিসে জানানো হয়। অথচ ওই তারিখেই শিল্প ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় থেকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল গণিকে টেলিগ্রাম করে ডেকে নিয়ে মেশিন ছাড় করার বিষয়ে আলোচনা করেন কর্মকর্তারা। এসব কর্মকা-ে ব্যাংক কর্মকর্তা রেজাউল কুদ্দুসসহ ঝিনাইদহ শাখার কর্মকর্তারা জড়িত ছিলেন। জানা গেছে, ব্যাংক কর্মকর্তাদের যোগসাজশে চট্টগ্রাম বন্দরের কতিপয় কর্মকর্তা মেশিন ছাড় করাতে আড়াই পার্সেন্টের স্থলে সাড়ে সাত পার্সেন্ট ডিউটি দাবি করেন। আড়াই পার্সেন্ট ডিউটিতে মেশিনারিজ ছাড় করাতে এমডি আব্দুল গণি ১৯৮৯ সালের ২৭ নবেম্বর যশোর ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন এবং ৫ ডিসেম্বর খুলনা বিনিয়োগ বোর্ড থেকে পত্র নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে যান। সেখানে গিয়ে জানতে পারেন আব্দুল গণি আর এমডি নেই। ব্যাংকে যোগাযোগ করলে সেখান থেকে জানানো হয় ১৯৮৯ সালের ২৪ আগস্টের সভায় মনোয়ার হোসেন এমডি নির্বাচিত হয়েছেন। এরপর ১২ বছর প্রকল্পটি দখল করে রাখে মনোয়ার পক্ষ। পরবর্তীতে মনোয়ার হোসেনের ব্যবস্থাপনায় পরিচালনা পর্ষদের অনুকূলে নতুন করে ৭৯ লাখ টাকা ঋণ মঞ্জুর করে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ; যার বেশিরভাগই লুটপাট হয়ে যায়। মঞ্জুরিকৃত অর্থ তছরুপের সঙ্গে ব্যাংকের ঝিনাইদহ শাখার তৎকালীন ব্যবস্থাপক খলিলুর রহমান খান ও আরেক কর্মকর্তা আবদ-উল-মতিন চৌধুরীসহ প্রধান কার্যালয়ের শাখা নিয়ন্ত্রণ উপবিভাগের কর্মকর্তারা জড়িত ছিলেন বলে অনুসন্ধানে জানা গেছে। পরিচালনা পর্ষদ গঠন করার পর যৌথ মূলধনী কোম্পানি ও ফার্মসমূহের নিবন্ধন পরিদফতর থেকে অনুমোদন করানো বাধ্যতামূলক হলেও পরিদফতরের নথিতে এ ধরনের কোন কাগজপত্রাদি পাওয়া যায়নি। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঋণ মঞ্জুরির সঙ্গে ব্যাংক কর্মকর্তা বিধূ ভূষণ নাথ, প্রকাশ চৌধুরী, সাদিকুর রহমান ভূইয়া ও নিজাম উদ্দিন জড়িত ছিলেন। ঋণ মঞ্জুরিপত্রে ব্যাংকের খুলনা বিভাগীয় অফিসের কর্মকর্তা হান্নান খান ও রেজাউল কুদ্দুস স্বাক্ষর করেন। ঋণের প্রথম কিস্তির ১৩ দশমিক ৬৯ লাখ টাকার মধ্যে ৯ দশমিক ৯৩ লাখ টাকা ব্যয়নের বিষয়টি ১৯৯১ সালের পয়লা মের পরিদর্শন প্রতিবেদনের ভিত্তিতে উপস্থাপিত হলে ওই বছরের ২২ জুন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তা অনুমোদন দেন। ওই সময় ব্যয়নের সঙ্গে জড়িত ছিলেন ব্যাংক কর্মকর্তা জাফির আহমেদ, সাহাদাত হোসেন, নবিদুল আলম ও আব্দুল করিম। প্রথম কিস্তির অবশিষ্ট ৩ দশমিক ৭৬ লাখ টাকা ঝিনাইদহ শাখা থেকে ১৯৯১ সালের ২১ এপ্রিল ব্যয়ন দেয়া হলেও এ সংক্রান্ত কোন কাগজপত্র নথিতে পাওয়া যায়নি। জালিয়াতির মাধ্যমে ব্যাংকের দেয়া ঋণের টাকা ‘নয়ছয়’ হওয়ার বিষয়টি তিন সদস্যের তদন্ত কমিটির কাছে ধরা পড়লেও তা আমলে নেয়া হয়নি। সর্বশেষ, আব্দুল গণিসহ তার পক্ষের পরিচালকরা অর্থ তছরুপের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে অভিযোগ করলে সেখান থেকে একটি তদন্ত হয়। তদন্তে কারখানা বিল্ডিংয়ের ছাদ পর্যন্ত দেয়াল, দু’কক্ষবিশিষ্ট অফিস ও একটি বাথরুমের ছাদ পর্যন্ত দেয়াল, ইলেক্ট্রিক সাবস্টেশন রুমের ছাদ পর্যন্ত দেয়াল, ফ্যাক্টরির সীমানা প্রাচীর সম্পন্ন, ফ্যাক্টরির ভেতরের রাস্তার উন্নয়ন ও একটি টিউবওয়েল স্থাপন করার প্রমাণ পায়। তাতে প্রমাণিত, ব্যাংক থেকে দেয়া ঋণের বেশিরভাগ অর্থ আত্মসাত করা হয়েছে। এ অবস্থায় ২০০১ সালে প্রকল্পটি আব্দুল গণির অনুকূলে ফেরত দেয়া হয়। ফলে, ব্যাংক ঋণের সমস্ত দায়ভার আব্দুল গণিসহ তার পক্ষের পরিচালকদের ঘাড়ে গিয়ে পড়েছে। বিডিবিএল ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা ঋণের সুদাসলে দু’কোটি টাকা আদায় করতে আব্দুল গণির পারিবারিক সম্পত্তির বিরুদ্ধে মামলা করেছে। যেটি যশোরের একটি আদালতে বিচারাধীন। ইতোমধ্যে বিডিবিএলের পক্ষ থেকে আদালতে কোম্পানির সম্পত্তির নিলাম বিজ্ঞপ্তির জন্য আবেদন করা হয়েছে। যে সম্পত্তির বর্তমান বাজারদর প্রায় চার কোটি টাকা। এতে ঋণ না নিয়েও পৈত্রিক সম্পত্তি হারানোর ভয়ে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন মি. গণিসহ অন্যান্য পরিচালকের পরিবার। তারা সম্পত্তির নিলাম ঠেকিয়ে কোম্পানিটি পুনরায় চালু করতে পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এ বিষয়ে বিডিবিএলের যশোরের ব্যবস্থাপক আবু বাক্কার সিদ্দিকীর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, যশোরে কেবল মামলা সংক্রান্ত তথ্য রয়েছে। এর বাইরে আর কিছু বলতে পারেননি তিনি। মি. সিদ্দিকী বলেন, এ বিষয়ে সবকিছু হেড অফিস দেখাশোনা করছে। এসব বিষয়ে জানতে ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের ডিজিএম (ডিসি) মোহাঃ শাহাজান ও এজিএম জাহেদ হাসানকে একাধিকবার ফোন করলেও তারা তা রিসিভ করেননি।
×