ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ড. মোঃ শাহজাহান কবীর

আউশ ধানের আবাদ এবং প্রাসঙ্গিকতা

প্রকাশিত: ০৩:৪৩, ৩০ এপ্রিল ২০১৮

আউশ ধানের আবাদ এবং প্রাসঙ্গিকতা

(গতকালের চতুরঙ্গ পাতার পর) রোগ ব্যবস্থাপনা আউশ মৌসুমে ব্যাকটেরিয়াজনিত পাতা পোড়া, খোলপোড়া, বাদামি দাগ, খোল পচা, টুংরো, বাকানি, এবং শিকড়ের গিট সচরাচর দেখা যায়। তবে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ রোগ হলো খোলপোড়া, ব্যাকটেরিয়াজনিত পাতা পোড়া, টুংরো ও বাকানি রোগ। খোলপোড়া রোগ দমনের জন্য পটাশ সার সমান দু’কিস্তিতে ভাগ করে এক ভাগ জমি তৈরির শেষ চাষে এবং অন্য ভাগ শেষ কিস্তি ইউরিয়া সারের সঙ্গে মিশিয়ে প্রয়োগ করতে হবে। পর্যায়ক্রমে ভেজা ও শুকনা পদ্ধতিতে সেচ ব্যবস্থাপনা অনুসরণ করতে হবে। রোগ দমনে ফলিকুর, নেটিভো, স্কোর ইত্যাদি ছত্রাকনাশক যথাযথভাবে প্রয়োগ করতে হবে। ব্যাকটেরিয়াজনিত পাতাপোড়া ও লালচে রেখা রোগের প্রাথমিক অবস্থায় ৬০ গ্রাম এমওপি, ৬০ গ্রাম থিওভিট ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ৫ শতাংশ জমিতে প্রয়োগ করতে হবে। থোড় বের হওয়ার আগে রোগ দেখা দিলে বিঘা প্রতি ৫ কেজি পটাশ সার উপরি প্রয়োগ করতে হবে। বিক্ষিপ্তভাবে দু’একটি গাছে টুংরো রোগের লক্ষণ দেখা দিলে, আক্রান্ত গাছ তুলে পুঁতে ফেলতে হবে। রোগের বাহক পোকার উপস্থিতি থাকলে, হাতজালের সাহায্যে অথবা আলোক ফাঁদ ব্যবহার করে সবুজ পাতা ফড়িং মেরে ফেলতে হবে। হাত জালের প্রতি টানে যদি একটি সবুজ পাতা ফড়িং পাওয়া যায় তাহলে বীজতলায় বা জমিতে কীটনাশক, যেমন মিপসিন, সেভিন অথবা ম্যালাথিয়ন অনুমোদিত মাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে। বাকানি রোগ দমনের জন্য অটোস্টিন ৫০ ডব্লিউপি বা নোইন দ্বারা বীজ অথবা চারা শোধন করা (১ লিটার পানিতে ৩ গ্রাম অটোস্টিন ৫০ ডব্লিউপি বা নোইন মিশিয়ে তাতে ধানের বীজ অথবা চারা ১০-১২ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখা)। আক্রান্ত গাছ সংগ্রহ করে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। ফসল কাটা, মাড়াই ও সংরক্ষণ শীষে ধান পেকে গেলেই ফসল কাটতে হবে। অধিক পাকা অবস্থায় ফসল কাটলে অনেক ধান ঝরে পড়ে, শীষ ভেঙ্গে যায়, শীষকাটা লেদাপোকা এবং পাখির আক্রমণ হতে পারে। তাই মাঠে গিয়ে ফসল পাকা পরীক্ষা করতে হবে। শীষের অগ্রভাগের শতকরা ৮০ ভাগ ধানের চাল শক্ত ও স্বচ্ছ এবং শীষের নিচের অংশে শতকরা ২০ ভাগ ধানের চাল আংশিক শক্ত ও স্বচ্ছ হলে ধান ঠিকমতো পেকেছে বলে বিবেচিত হবে। এ সময়ে ফসল কেটে মাঠেই বা উঠানে এনে মাড়াই করতে হবে। তাড়াতাড়ি মাড়াইয়ের জন্য ব্রি উদ্ভাবিত মাড়াই যন্ত্র ব্যবহার করা যায়। ধান মাড়াই করার জন্য পরিচ্ছন্ন জায়গা বেছে নিন। কাঁচা খলায় সরাসরি ধান মাড়াই করার সময় চাটাই, চট বা পলিথিন বিছিয়ে নেয়া উচিত। এভাবে ধান মাড়াই করলে ধানের রং উজ্জ্বল ও পরিষ্কার থাকে। মাড়াই করার পর অন্তত ৪-৫ বার রোদে শুকিয়ে নিতে হবে। ভালভাবে শুকানোর পর ঝেড়ে নিয়ে গোলাজাত করুন। বাদলা দিনে কোন উপায় না থাকলে ধান মাড়াই করে সাধ্যমত ঝেড়ে বস্তায় ভরে যে কোন জলাশয়ে ২/৩ হাত গভীর পানিতে খুঁটির সঙ্গে বেঁধে ডুবিয়ে রাখুন যেন ধানের বস্তা ডুবন্ত অবস্থায় মাটির সংস্পর্শে না আসে। এভাবে ১০ দিন পর্যন্ত পানির নিচে রাখলেও ধান নষ্ট হয় না। ধান পানিতে ডুবানোর ফলে কিছুটা গন্ধ হলেও সিদ্ধ করার পর ভালভাবে শুকানো হলে আর গন্ধ থাকে না। . বীজ সংরক্ষণ ভাল ফলন পেতে হলে ভাল বীজের প্রয়োজন। এ কথা মনে রেখেই কৃষকভাইদের ঠিক করতে হবে কোন জমির ধান বীজ হিসেবে রাখবেন। যে জমির ধান ভালভাব পেকেছে, রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণ হয়নি এবং আগাছামুক্ত সে জমির ধান বীজ হিসেবে রাখতে হবে। ধান কাটার আগেই বিজাতীয় গাছ সরিয়ে ফেলতে হবে। মনে রাখতে হবে গাছের আকার-আকৃতি ও রং, ফুল ফোটার সময় ও শীষের ধরন, ধানের আকার আকৃতি, রং ও শুঙ এবং সর্বশেষ ধান পাকার সময় আগে-পিছে হলেই তা বিজাতীয় গাছ। সকল রোগাক্রান্ত গাছ অপসারণ করতে হবে। এরপর বীজ হিসেবে ফসল কেটে এবং আলাদা মাড়াই, ঝাড়াই ও ভালভাবে রোদে শুকিয়ে মজুদ করুন। বীজ ধান সংরক্ষণে যেসব পদক্ষেপ নেয়া উচিত সেগুলো হলো - ক্সমাড়াইয়ের পর থেকে ৫-৬ দিন রোদে ভালভাবে শুকিয়ে নিতে হবে যেন বীজের আর্দ্রতা শতকরা ১২ ভাগের নিচে থাকে। দাঁত দিয়ে বীজ কাটলে যদি কটকট শব্দ হয় তাহলে বুঝতে হবে বীজ ঠিকমতো শুকিয়েছে। ক্সপুষ্ট ধান বাছাই করতে কুলা দিয়ে কমপক্ষে দু’বার ঝেড়ে নেয়া যেতে পারে। ক্সবায়ুরোধী পাত্রে বীজ রাখা উচিত। বীজ রাখার জন্য ড্রাম ও বিস্কুট বা কেরোসিনের টিন ব্যবহার করা ভাল। পাত্র ভালভাবে পরিষ্কার করে শুকিয়ে নিতে হবে। ক্সধাতব অথবা প্লাস্টিক ড্রাম ব্যবহার করা সম্ভব না হলে, মাটির মটকা, কলস বা মোট পলিথিনের থলি ব্যবহার করা যেতে পারে। মাটির পাত্র হলে পাত্রের বাইরের গায়ে দুবার আলকাতরার প্রলেপ দিয়ে শুকিয়ে নিতে হবে। ক্সরোদে শুকানো বীজ ঠা-া করে পাত্রে ভরতে হবে। পাত্রটি সম্পূর্ণ বীজ দিয়ে ভরে রাখতে হবে। যদি বীজের পরিমাণ কম হয় তবে বীজের উপর কাগজ বিছিয়ে তার উপর শুকনো বালি দিয়ে পাত্র পরিপূর্ণ করতে হবে। ক্সপাত্রের মুখ ভালভাবে বন্ধ করতে হবে যেন বাতাস ঢুকতে না পারে। বীজ পাত্র মাচায় রাখা ভাল, যাতে পাত্রের তলা মাটির সংস্পর্শে না আসে। ক্সগোলায় ধান রাখলে ১ মণ ধানের জন্য আনুমানিক ১২০ গ্রাম নিম বা নিশিন্দা অথবা বিষকাটালির পাতা গুঁড়া করে মিশিয়ে দিয়ে সংরক্ষণ করলে পোকার আক্রমণ প্রতিহত হয়। (সমাপ্ত) লেখক : মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট
×