ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ১৬৪ কোটি টাকা

কর্ণফুলী নদীর ওপর আরেকটি সেতু নির্মাণের উদ্যোগ

প্রকাশিত: ০৭:১৩, ২৯ এপ্রিল ২০১৮

কর্ণফুলী নদীর ওপর আরেকটি সেতু নির্মাণের উদ্যোগ

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ চীন, মিয়ানমার এবং ভারতের সঙ্গে রেল নেটওয়ার্ক স্থাপনের লক্ষ্য নিয়ে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর ওপর আরেকটি সেতু নির্মাণের প্রাক-প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে সরকার। কালুরঘাটে বিদ্যমান রেলসেতু ভেঙ্গে দুইপাশে সড়কসহ একটি রেলসেতু নির্মাণের পূর্ণাঙ্গ প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগে (একনেক) পাঠিয়েছে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল কর্তৃপক্ষ। প্রস্তাবে ২০২০ সালের শুরুতে কাজ শুরু করার কথা বলা হয়েছে। একনেকে পাঠানো প্রস্তাব অনুযায়ী কাজ শুরু হলে ২০২৩ সালে নতুন সেতুর ওপর দিয়ে ট্রেন এবং সড়কযানে কর্ণফুলী সেতু পাড়ি দেবে দক্ষিণ চট্টগ্রামসহ কক্সবাজারের মানুষ, এমনটাই বলছেন রেল কর্মকর্তারা। দক্ষিণ চট্টগ্রামের বোয়ালখালী এবং চট্টগ্রাম নগরীর সঙ্গে সংযোগ স্থাপনকারী কালুরঘাট রেলসেতুটি জরাজীর্ণ হয়ে পড়ায় দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে লাখ লাখ মানুষকে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। এই সেতুর কারণে চট্টগ্রাম-দোহাজারী রেল যোগাযোগও বন্ধের উপক্রম হয়েছে। চট্টগ্রামের জনপ্রতিনিধিরা বিভিন্ন সময় এই সেতু নির্মাণের বিষয়ে জোরাল আশ্বাস দিলেও চলতি বছরে এসে সেটি আলোর মুখ দেখতে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে,‘কালুরঘাটে কর্ণফুলী নদীর ওপর একটি রেল কাম রোড সেতু’ নামে একটি ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রপোজাল (ডিপিপি) তৈরি করে ২০১৭ সালের ২১ সেপ্টেম্বর রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল কর্তৃপক্ষ সেটি ঢাকায় রেলভবনে পাঠায়। ২৭ সেপ্টেম্বর রেলভবনে মহাপরিচালকের সভাপতিত্বে প্রকল্প পরীবীক্ষণ কমিটির সভায় সেটি উত্থাপন করা হয়। পরীবীক্ষণ কমিটি তাদের কিছু সিদ্ধান্ত জানিয়ে সেই ডিপিপি পুনর্গঠন করে আবারও পাঠানোর নির্দেশ দেয়। এরপর ১ নবেম্বর আবারও ডিপিপি পুনর্গঠন করে রেলভবনে পাঠানো হয়। ১১ ডিসেম্বর রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিবের সভাপতিত্বে পুনর্গঠিত ডিপিপির ওপর প্রকল্প যাচাইবাছাই কমিটির সভা হয়। সচিব আবারও কিছু পর্যবেক্ষণ উল্লেখ করে সেটি পুনর্গঠনের জন্য ফেরত পাঠান। চলতি বছরের ৩০ জানুয়ারি ডিপিপি দ্বিতীয় দফা পুনর্গঠন করে রেলভবনে পাঠানো হয়। গত ২৭ মার্চ সংশোধিত ডিপিপি রেলপথ মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগে (একনেক) পাঠানো হয়েছে। রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (সেতু) গোলাম মোস্তফা বলেন, একনেকে ডিপিপি যাচাই বাছাই চলছে। আশা করছি খুব শীঘ্রই সেটি একনেকের সভায় উঠবে। একনেকে ডিপিপি অনুমোদন হলে কনসালটেন্ট নিয়োগ করা হবে। তারা ডিজাইন তৈরি করবে। ডিজাইন তৈরিতে লাগবে এক থেকে দেড় বছর। এরপর টেন্ডার হবে। ২০২০ সালের শুরুতে আমরা নির্মাণকাজ শুরু করতে পারব বলে আশা করছি। তবে সবকিছু নির্ভর করছে একনেকের সভায় প্রকল্প অনুমোদনের ওপর। সূত্রমতে, প্রকল্প প্রস্তাবনায় ২০১৮ সালের মার্চে প্রকল্পের কাজ শুরুর কথা বলা হয়েছে। ২০২৩ সালের ৩১ আগস্ট কাজ শেষে সেতু খুলে দেয়া যাবে বলে এতে উল্লেখ করা হয়েছে। সেতুটি নির্মাণের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ১৬৪ কোটি ৯৮ লাখ ৮৯ হাজার টাকা। এর মধ্যে ১ হাজার ১৪৬ কোটি টাকা দিতে সম্মত হয়েছে দক্ষিণ কোরিয়ার ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট কো-অপারেশন ফান্ড (ইডিসিএফ)। বাকি টাকার যোগান দেবে বাংলাদেশ সরকার। সূত্রমতে, প্রস্তাবিত এই সড়কসহ রেলসেতুর দৈর্ঘ্য ধরা হয়েছে শূন্য দশমিক ৭২ কিলোমিটার। সেতুতে রেললাইনের দুইপাশের সংযোগ সড়কের প্রস্থ হবে ১০ দশমিক ৩ মিটার। সেতুর সঙ্গে ১ দশমিক ৬৯ কিলোমিটার অভিগমন সড়কও নির্মাণ করা হবে। প্রকল্পে কালুরঘাটে জানে আলী হাট রেলস্টেশন পুনর্নির্মাণও অন্তর্ভুক্ত আছে। সেতুতে ওঠানামার সময় বিদ্যমান সঙ্কেতবাতি আধুনিকায়ন, প্রয়োজনীয় সরঞ্জামসহ একটি পূর্ণাঙ্গ টোলপ্লাজা নির্মাণসহ সেতুর ওপর রেললাইনের অবকাঠামো নির্মাণের বিভিন্ন বিষয় সংযুক্ত আছে এই প্রকল্প প্রস্তাবনায়। সূত্রমতে, সেতুটি নির্মাণ হলে ৯ ধরনের সুবিধার কথা বলা হয়েছে প্রকল্প প্রস্তাবনায়। এর মধ্যে আছে, চট্টগ্রামের সঙ্গে কক্সবাজারের নিবিড় রেল যোগাযোগ তৈরি হবে ও জরাজীর্ণ সেতুটি ভেঙ্গে ফেলা যাবে। স্থানীয় জনসাধারণের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটবে ও দেশের অর্থনীতির অগ্রগতির স্বার্থে আশপাশের অঞ্চলগুলোর মধ্যে আন্তঃযোগাযোগ স্থাপিত হবে। চীন, মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সম্ভাব্য রেল যোগাযোগের জন্য প্রস্তাবিত ট্রান্স এশিয়ান রেল নেটওয়ার্ক প্রকল্পে যুক্ত হওয়ার ক্ষেত্র তৈরি হবে। পণ্যবাহী পরিবহন এবং যাত্রীরা দ্রুত ও নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছতে পারবে। চট্টগ্রামের দক্ষিণে এবং কক্সবাজার জেলায় ট্রেনের মাধ্যমে বিপুল সংখ্যক যাত্রী ও পণ্য একসঙ্গে পরিবহন করা যাবে। বাণিজ্যিক নগরী চট্টগ্রামের যানজট কমে আসবে। সেতু পারাপারে ট্রেনযাত্রায় ১০ মিনিট সময় কমবে এবং সড়কযানে কমবে ১৫ মিনিট। বর্তমানের চেয়ে আরও বেশি পরিমাণে ট্রেন চালু করা যাবে এবং কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়িতে প্রস্তাবিত গভীর সমুদ্রবন্দর বাস্তবায়নও সহজ হবে। রেল কর্মকর্তারা বলেছেন, প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণের যে প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন আছে, সেটির সুফলও নির্ভর করছে কালুরঘাটে নতুন সেতু নির্মাণের ওপর। দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্পের পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, একটি মহাসড়কের কোন অংশে যদি খানাখন্দক থাকে তাহলে গাড়ি ঠিকমতো চলাচল করতে পারে না। দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন হচ্ছে। কিন্তু কালুরঘাট সেতু দিয়ে যদি ট্রেন যেতে না পারে তাহলে এই প্রকল্পের যে উদ্দেশ্য সেটা তো পূরণ হবে না। সারাদেশ থেকে নির্বিঘেœ যাতে ট্রেন কক্সবাজারে পৌঁছতে পারে, সেজন্য কালুরঘাটে জরুরী ভিত্তিতে সেতু নির্মাণ করা উচিত। বৃটিশ আমলে নির্মিত বর্তমান কালুরঘাট সেতুর বয়স ৮০ বছরেরও বেশি। আশির দশকে এরশাদ সরকারের আমলে কর্ণফুলী নদীর ওপর অস্থায়ীভাবে একটি কাঠের সেতু নির্মাণ করা হয়েছিল। পরে সেই সেতু তুলে নতুন একটি সেতু নির্মাণ করা হয়। এই সেতুটি শাহ আমানত সেতু নামে পরিচিত। কালুরঘাটে বিদ্যমান রেলসেতু ভেঙ্গে নতুন একটি সড়কসহ রেলসেতু নির্মাণের জন্য আন্দোলন করে আসছিলেন দক্ষিণ চট্টগ্রামবাসী। বোয়ালখালী-কালুরঘাট সেতু বাস্তবায়ন পরিষদের আহ্বায়ক আব্দুল মোমিন বলেন, আমাদের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশার ফল হিসেবে সরকার একটি সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। আমরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে কৃতজ্ঞ। আমরা চাই, একনেকে দ্রুত এই প্রকল্পটি পাস করা হোক। সেতু নির্মাণের কাজ দ্রুত শুরু হবে এবং দক্ষিণ চট্টগ্রামের লাখ লাখ মানুষ তাদের প্রতিদিনের দুর্ভোগ থেকে মুক্তি পাবে।
×